ইউরো সফরের গল্প: পর্ব-৩, প্যারিস আর ডাচ শহরে অভিযান

১০ম দিন

আমরা ভোর বেলায় ঠিক ঠিক সময়ে স্টুটগার্টের স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে প্যারিসে যাওয়ার পরের ট্রেনটা ঘণ্টাদুয়েক পর।

পরিকল্পনা ছিল, মালপত্র মালগুদামে রেখে স্টেশনলাগোয়া পুরোনো স্টুটগার্ট ঘুরে দেখব। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বৃষ্টিতে আটকে রইলাম অপেক্ষা ঘরে। সেখানে একটু ঘুম দিয়ে আমরা উঠে পড়লাম ফরাসি টিজিভি দোতলা দ্রুতি ট্রেনে।

কি সুন্দর ট্রেন, ওয়াই-ফাইওয়ালা। আমি পেয়েছি দোতলার জানালার পাশের সুন্দর আসন। আমার বাকি দুই ভ্রমণসঙ্গী আবার জায়গা পেয়েছে অন্য বগিতে। তাই একাকী দুই পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর ফেসবুকিং করতে করতে প্যারিসের অপেক্ষায় রইলাম। ট্রেনের বগিতে আমার সামনের সিটগুলোতে ধোপদুরস্ত পোশাকের এক দঙ্গল মার্কিন তরুণ–তরুণীর দল বেশ উচ্চ স্বরে গল্প করে যাচ্ছে আর কারণে–অকারণে হেসে উঠছে।

ইশ্‌, পরে টিকিট কাটার কারণে আমার অন্য দুই সাথি থেকে আলাদা বসে বেচারার একা একা লাগছিল। আমিও তাদের দেখে সেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক টাকার বাসের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম, সে সময় আমরা হইহুল্লোড় করতে করতে পুরো পথ কাটিয়ে দিতাম। এসব ভাবতে ভাবতে প্যারিস চলে এল।

আরও পড়ুন

আমরা গারে দ্য এস্ট এসে নেমে দুই দিনের প্যারিস পাস কিনলাম। সেটা দিয়ে মেট্রো করে আমাদের এয়ারবিএনবির কাছাকাছি এসে পড়লাম। মেট্রো থেকে বেরিয়ে দেখি প্যারিসেও টিপটিপ বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটেই এয়ারবিএনবিতে পৌঁছলাম। সেখানে মালপত্র রেখে পোশাক পাল্টে আমাদের প্যারিস অভিযান শুরু করলাম। প্রথমে আমরা হাজির হলাম ম’মার্তে নামের এক উঁচু টিলায়। এখানে এক বিখ্যাত গির্জা দাঁড়িয়ে আছে, এটার নাম sacre-coeur basilica.

এর সামনের প্রসারিত সিঁড়ি থেকে পুরো প্যারিস দৃশ্যমান। বৃষ্টির মধ্যেও পর্যটকদের ছবি তোলার হিড়িক।

বৃষ্টির তোড়ে আমরা গির্জার ভেতরে আটকে ছিলাম ঘণ্টাখানেক। গির্জার উঁচু টিলার নিচেই হচ্ছে প্যারিসের বিখ্যাত চিত্র ও শিল্পের আখড়া।

এখানেই আছে বিখ্যাত ক্যাবারে ‘মুলা রুজ’ আর তার ছাদে লাগানো বায়ুকল।

আমরা এসব ছেড়ে মেট্রো করে চলে গেলাম প্যারিসের বিখ্যাত শপিং মল ‘গ্যালারি লাফায়েত’-এর উদ্দেশে। এর ছাদ থেকে প্যারিসের সূর্যাস্ত বেশ ভালো লাগে।

কিন্তু সেদিন বৃষ্টি ছিল বলে ছাদ বন্ধ, তাই অগত্যা আমরা সেখানে চকলেট আর কফি খেয়ে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে আইফেল টাওয়ার দেখতে বের হলাম। বৃষ্টি বলে ওপরে ওঠা মানা, তাই আমরা পাশের ট্রোকাডারো নামের জায়গার এক উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে রাতের জাজ্বল্যমান আইফেল টাওয়ার দেখলাম। বৃষ্টির তোড় কমে গেলেও পাশের ক্লাবের পার্টিওয়ালাদের গগনবিদারী চিৎকার কিন্তু কমেনি।

এরপর ‘সজে লিজে’Champs Elysees Avenue নামের এক বিখ্যাত রাজপথ ধরে আর্ক ডি ট্রাওম্ফে হাজির হলাম। এটা অনেকটা দিল্লি গেটের মতো। এটাও প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ফরাসি আর তার উপনিবেশগুলোর নিহত সৈনিকদের স্মরণে বানানো হয়েছে। এটাকে কেন্দ্র করে এখান থেকে ছয় কি সাতটা রাস্তা প্যারিসের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে। রাতের ‘সজে লিজে’ খুবই ভালো লাগে, এখানে একটা চকলেটের দোকান থেকে অল্প কিছু চকলেট খেলাম আর কৃপণের মতো পাশের ম্যাকডোনাল্ডে খেলাম। এ রাজপথ ঠিক চলে গেছে ল্যুভ জাদুঘরের দিকে, আরেক পাশ গেছে লা দিফা (La Defense) এর গগণচুম্বী ভবনওয়ালা এলাকার দিকে।

বেশ রাত হয়ে গেছে, লোকজন ঘরে ফিরছে, আমরাও সে রাতের জন্য ক্ষান্ত দিলাম।

আরও পড়ুন

১১তম দিন

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ল্যুভ জাদুঘর রওনা দিলাম। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় স্বয়ং মোনালিসা। তাই দেরি না করে ল্যুভে হাজির হলাম।

এঘর–ওঘর করে সবকিছু এফোঁড়–ওফোঁড় করে ফেললাম। এবারেরটা নিয়ে ল্যুভে আমার তৃতীয়বার আসা।

সারাটা দিন ল্যুভ ঘুরেটুরে বিকেলে আরেকটা শপিং মলে গেলাম। সন্ধ্যার পর আমরা সবাই মিলে গেলাম শহরের মাঝে Tuileries Garden. এখানে চলছিল এক মেলা।

সেখানে অপেক্ষায় ছিল আমার ফুফাতো বোনের মেয়ে। সে এখানে ‘সায়েন্স পো’ নামের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই সূদুর মেলবোর্ন থেকে মাস্টার্স করতে এসেছে। তার কথামতো মজার মজার সব প্যারিসিয়ান স্ট্রিট ফুড খেলাম। সঙ্গে স্পেনিস গরম–গরম চুরোস ততোধিক উষ্ণ গলিত চকলেটে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেলাম মজা করে।

সবাই মিলে গল্প করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেছে। আমরা ফিরতি পথে মেট্রোতে করে বাসার কাছাকাছি নামলাম। আবাসে ফেরার আগে সেখানের এক তুর্কি রেস্তোরাঁয় মজার সব খাবার খেয়ে বাসায় এসে দিলাম ঘুম। আগামীকাল সকালে আবার থ্যালিস নামের দ্রুতি ট্রেনে যেতে হবে নেদারল্যান্ডসের অনন্য সব আধুনিক স্থাপত্যের শহর রটারডাম।

১২তম দিন

বেশ সকালের ট্রেনে প্যারিস থেকে থ্যালিস নামের দ্রুতি ট্রেনে শেষ সকালে হাজির হলাম রটারডাম শহরে। সেখানে অপেক্ষা করছিল আমার পুরোনো এক বন্ধু। আমরা স্টেশন থেকে সামান্য দূরে তার বাসায় ঘাঁটি গাড়লাম। আইসল্যান্ড যাওয়ার আগপর্যন্ত সেটাই হবে আমাদের আবাস।

আমার বন্ধু আর ভাবী হলো রন্ধন পটীয়সী। নানান রকম বাঙালি আর ফিউসন খাবারদাবার খেয়ে আমরা সামান্য বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলাম পাশের শহর ডরড্রেখট। যেতে হবে বিখ্যাত রাইন নদী ধরে। বন্ধু আর ভাবী হলো আমাদের গাইড।

মজার কথা বলি, আমরা সবাই রটারডাম শহরের খেয়াঘাটে গেলাম সাইকেল চালিয়ে। বসুন্ধরা থাকি বলে এখনো সাইকেল চালাই, তাও এই পথ পাড়ি দিতে জান বের হয়ে গেছে আর পা দুটো যেন শরীর থেকে খুলে আসতে চাচ্ছে।

শেষে ছোট ফেরিলঞ্চে করে আমরা এসে হাজির হলাম ছোট্ট এ শহরে। সঙ্গে ছিল আমাদের সাইকেল। কি সুন্দর নদীর দুই পাশের দৃশ্য। মন ভালো করে দেয়। এর মধ্যে আমরা কয়েকটা পুরোনো বায়ুকল দেখলাম। এরা আকারে ছোট আর আজকাল দেখতে পাওয়াই যায় না। এখনকার আধুনিক বায়ুকলগুলো বিশাল, সামনাসামনি না দেখলে বোঝানো যাবে না।

শহরটা কি সুন্দর। ঘাটের কাছে ছোট বাজারে কত্ত জিনিস বিক্রি হচ্ছে।

আমরা কত রকমের যে চিজ দেখলাম আর ডাচ ক্যারামেল চকোলেট খেলাম। এসব দেখে গাংচিল গুলি ওড়াউড়ি করছিল ছো মেরে নেওয়ার জন্য।

সাইকেল দিয়ে শহরটা ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ফেরার সময় হয়ে গেছিল।

আমরা ফিরতি ফেরিলঞ্চে আবার রটারড্যাম ফিরে এলাম।

রাতে মজার সব খাবার খেয়ে দিলাম ঘুম। আগামীকাল যাচ্ছি আমরা আইসল্যান্ড। আমাদের ইচ্ছা নর্দার্ন লাইটস বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখা।

আমাদের বিমান ছাড়বে আমস্টারডামের শিপুল বিমানবন্দর থেকে।

১৩তম দিন-

আমার ডাচপ্রবাসী বন্ধুও যাবে আমাদের সঙ্গে। বন্ধুর এক ডাচ বন্ধু আমাদের তার গাড়িতে করে নামিয়ে দিল শিপুল বিমানবন্দরে। আমরা লাউঞ্জে এটা–সেটা খেয়ে উড়াল দিলাম আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকিয়াভিক। আমাদের বিমান ডাচ এয়ার এভিয়া।

আমাদের বিমানটা যখন রিকিয়াভিক নামল, ততক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে।

আমাদের আগে থেকে কেটে রাখা এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেস বাস শহরে নিয়ে যাবে। আমরা বাসস্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম। আমি জীবনেও এত্ত ঠান্ডা বাতাসের মাঝে পড়িনি। যেন হাড্ডির মধ্যে গিয়ে আঘাত করছে। আমার পরনে ছিল তিন–চার স্তরের পোশাক। তাও বাধা মানে না। কি ভয়ংকর। এই ঠান্ডার মধ্যে এক্সপ্রেস বাস রাতের অন্ধকার ভেদ করে শহরে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আজ রাতেই আমাদের নর্দান লাইটস (Northern Lights) দেখার ট্যুর প্যাকেজ কাটা এই একই এক্সপ্রেস বাস কোম্পানির সঙ্গে। তাই এরা একটা pit stop-এ নিয়ে এল। মাঝরাতে আমাদের নিয়ে আরেকটা বিশালাকার বাস শহরের বাহিরে এক খোলা জায়গায় নিয়ে গেল।

আমরা কি ভীষণ ভাগ্যবান। সে রাতেই দেখে ফেললাম উত্তর মেরু জ্যোতি বা Northern Lights.

যদিও ক্ষীণ, কিন্তু গাইড বলল, এটাই নাকি ভালো, খালি চোখে সাদাটে ঘোলাটে, কিন্তু ক্যামেরার এক্সপোসারে বেশ ভালো এসেছিল। একদম রঙিন।

এ রকম উত্তেজনার মধ্যে আমরা ভুলে গেছিলাম যে তাপমাত্রা বেশ ঋণাত্মক। মাইনাস ১০ থেকে ১৫ হবে। ট্যুর অপারেটরদের দেওয়া গরম–গরম চকলেট পানীয় আমাদের তপ্ত রেখেছিল হয়তো!

অবশেষে সেই বিশালাকার বাস আমাদের আগে থেকে ঠিক করা এয়ারবিএনবিতে না নামিয়ে একটু দূরে নামাল।

ভাগ্য ভালো সঙ্গে আমার ডাচপ্রবাসী বন্ধু ছিল। তার ইউরোপীয় মুঠোফোনের নেট দিয়ে গুগল ম্যাপ দেখে দেখে হাজির হলাম বাসায়। এটা হবে আগামী তিন দিনের জন্য আবাস। আমাদের জায়গা হলো চিলেকোঠায়। একদম ত্রিভুজের নিচে। আমরা এসেই ঘুমিয়ে গেলাম। কারণ, পরদিন যাব আমরা Golden Circle সফরে।

সেই গল্পগাথা হবে পরের পর্বে...

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]