ইউরো সফরের গল্প পর্ব-৪: আইসল্যান্ড অভিযান
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে হলো সাতটায়। বাইরে তখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। অবাক ব্যাপার। নভেম্বরের দিনগুলো এসব উত্তরের দেশগুলোতে সংক্ষিপ্ত হয়। আমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আবারও গুগল ম্যাপ দেখে হাজির হলাম প্যাকেজ ট্যুরের বাসস্টপে। দুনিয়ায় লোক এই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে। বাতাস তো না যেন ঘূর্ণি। এদের কি শীত লাগে না?
বাস হাজির হলো আধা ঘণ্টা পর। বাসে উঠে রওনা দিয়ে শহরের বাইরে আসতেই দেখি সূর্য উঠতে শুরু করেছে। পুরা আইসল্যান্ডের সাগরতীর সমভূমি আর দ্বীপের মধ্যে অনেক অনেক পাহাড়–পর্বত। এসব সমভূমি উপকূলগুলোতেই মানুষ থাকে। এদের সমভূমিতে প্রায় কোনো গাছপালা নেই। আছে ঘাস আর গুল্মের মতো ঝোপ। খাঁ খাঁ প্রান্তর। একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে কেমন অস্বস্তি লাগে। ঠিক পৃথিবীর মনে হয় না। পশুপাখিও বিরল। এদের এখানে ফল–ফসল খুবই কম হয়। জিনিসপত্র ভয়াবহ রকম দামি। সবকিছু কিনে আনতে হয় মূল ইউরোপ থেকে। এরা ছিল জেলে আর জীবন ছিল কষ্টের। আর এখন পর্যটনের কল্যাণে এদের আর্থিক অবস্থা ভালো। মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসা উষ্ণ প্রস্রবণগুলোতে যন্ত্র বসিয়ে এরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাসাবাড়িতে প্রায় বিনা মূল্যে সরবরাহ করে। আর মৎস্য শিকার করে এরা এখন অনেক বড়লোক। তাই এরা এত দামের খাবারদাবার কিনতে পারে। আমরা সকালে স্যান্ডউইচ আর কফি খেলাম, দাম পড়ল ১৪+৫ ইউরো। চিন্তা করা যায়?
আমার ডাচপ্রবাসী বন্ধু বুদ্ধি করে ট্যুরের বাসটা একটা বাথরুম ব্রেক দিতেই সেখানের গ্রোসারি শপ থেকে পাস্তা, পাউরুটি, সস, নানান রকম পনির, ইনস্ট্যান্ট নুডলস আর অনেকখানি মাখন কিনে নিলো। এসব দিয়ে আমরা ঘরেই স্যান্ডউইচ, পাস্তা আর নুডলস বানিয়ে খেয়েছি পরের তিন–চার দিন। এসব না কিনলে আমরা ফতুর হয়ে দ্বীপ থেকে আর ফিরতে পারতাম না। দ্বীপান্তরি হয়ে সারা জীবন আইসল্যান্ড থেকে যেতে হতো।
যাহোক, আমাদের বাস চলতে চলতে হাজির হলো একটা বিশাল গোলাকার হ্রদের ধারে। kerid crater হচ্ছে এটার নাম। অনেক আগে ধূমকেতু থেকে আছড়ে পড়া গ্রহাণু বা meteorite–এর ধাক্কায় বিশাল গর্ত বা crater হয়ে গেছে, ফলে মাটি বিচূর্ণ হয়ে গোল হয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। আর গর্তে এখন দেখা যাচ্ছে টলটলে বরফগলা পানি। অবিশ্বাস্য।
সেখান থেকে যাওয়ার পথে আমাদের নিয়ে এল এক উষ্ণ প্রস্রবণে। নির্দিষ্ট সময় পরপর সেখানে ভীষণ গর্জন করে পানি আর বাষ্প অনেক ওপরে উদ্গিরণ হয়। সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। তার কিছু পাশে আবার দেখি আইসল্যান্ডের টাট্টুঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা এত ছোট আর কেশরে এদের চোখমুখ ঢেকে যায়। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা হয়। এদের সঙ্গে সামান্য গাজর খাইয়ে বেশ কটা ছবি তুলে ফেললাম।
আমাদের আজকের সফরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে বিখ্যাত গুলফস জলপ্রপাত। এর বিশালতা আর পানির স্রোতের গর্জন আমি লিখে বোঝাতে পারব না। seeing is believing.
আমি তো আর নায়াগ্রা দেখিনি, কিন্তু এর যে পানির স্রোতের তোড়, চিন্তার বাইরে। বেশ অনেক দূর থেকে এর গর্জন–তর্জন শোনা যায়। শেষবিকেলে হাজির হলাম থিংভেলির ন্যাশনাল পার্কে। সেখানে উত্তর আমেরিকার ট্যাকটনিক প্লেট মিলিত হয়েছে ইউরোপীয় প্লেটের সঙ্গে। এখানে এলে আপনি দুই প্লেটের মিলনরেখায় একটা লম্বা গর্তের মতো লম্বা বিভেদরেখা দেখতে পারবেন, যেটার দুই পাশে উত্থিত পাথরশ্রেণি। এখানেই মধ্যযুগে আইসল্যান্ডের বিভিন্ন গ্রামের মাতবরেরা মিলিত হয়ে ইউরোপের প্রথম parliament বা সংসদ তৈরি করেছিল। বেশ মজার ব্যাপার, তাই না?
সেই বিহ্বলতা বুকে নিয়ে সেদিনের মতো আবাসে ফিরে এলাম।
সেইরা তে আমার ডাচপ্রবাসী বন্ধুর বানানো মুখরোচক পাস্তা খেয়ে দিলাম ঘুম। বলতেই হবে, পাস্তার স্বাদ ছিল যেকোনো মিশেলিন স্টার রেস্তোরাঁর স্বাদের মতো।
আমাদের আগামীকাল যেতে হবে পশ্চিম উপকূলের স্নেয়াফেলসেন উপদ্বীপে।
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: ns@prothomalo.com
১৫তম দিন
এ সফরটা একটু দামি। আমরা ছোট একটা ট্রেইলারে করে ১০–১২ জন ভিন্ন ভিন্ন দেশের পর্যটক পশ্চিম উপকূলে রওনা হলাম বেশ সকালে। রিকজাভিক থেকে বেশ দূরের পানে গাড়িটা একটানা ছুটে চলল। আপনারা যাঁরা টিভিতে ‘গেম অব থ্রোনস’–এর কাহিনির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা আজকের এ সফরে বেশ উল্লসিত হবেন। সেটার কল্যাণে আইসল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের দিগন্তবিস্তৃত দৃশ্যের সঙ্গে আপনারা পরিচিত। এই সিরিজের বেশ কিছু দৃশ্যায়নে এ উপকূলে ছিল। আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছি। বিশাল বিশাল বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ, অদ্ভুত সাগরসৈকত আর অতিপ্রাকৃত ভূমিরীতি, আমরা তো বিমোহিত। সেখান থেকে ফেরার পথে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। ভাবতেই পারবেন না কী অপ্রত্যাশিতভাবে আকাশে আবারও ভেসে উঠেছিল সেই মেরু জ্যোতি বা northern lights.
আমরা ভীষণ ভাগ্যবান যে দুই রাত মেরু জ্যোতি দেখতে পেয়েছি। যেন বাতাসে সাদা পর্দা আকাশজুড়ে এপাশ–ওপাশ করছে। আমরা ট্রেইলার থামিয়ে এক খোলা মাঠের মধ্যে এটা উপভোগ করলাম। আমরা হকচকিত, নির্বাক।
এটার জন্য রিকজাভিক ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল।
আগামীকাল আমরা বের হব দক্ষিণ উপকূল দেখতে। তাই এসেই বাসায় বানানো নুডলস আর স্যান্ডউইচ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
১৬তম দিন
আজকে আমরা যাচ্ছি দক্ষিণ উপকূলে। সকাল সকাল অন্ধকার ভেদ করে আবার শুরু হলো আমাদের সফর। বাসটা যেতে যেতে হাজির হলো বিশালাকার এক জলপ্রপাতের কাছাকাছি। নাম তার skogafoss. কী ভীষণ গর্জন করে বরফগলা পানি গড়িয়ে পড়ছে। আইসল্যান্ডের এটা একটা আইকনিক জায়গা। এর সামনে অনেক ছবি তুললাম। পানির ছিটায় আমরা প্রায় ভিজেই যাচ্ছিলাম। গাইডের তাড়াহুড়ায় আমরা বাসে উঠে পরের গন্তব্যে হাজির হলাম। black sand beach, কালো বালু সৈকতে। ছোট মিহি পাথরকুচি এ সৈকতের বৈশিষ্ট্য। আর সৈকতের পাশে থামের মতো সব পাহাড়শ্রেণি। পাথরের থামগুলোকে ঠিক পৃথিবীর মনে হয় না। বাতাসের যে তোড় আর সাগরের যে গর্জন, ঠিক মনে হয় যেন অন্য গ্রহ। আমি তো ছবি তুলতে গিয়ে স্রোতের তোড়ে অর্ধেক ভিজে গেলাম। বুটের মধ্যে পানি ঢুকে গেল আর মাঝখান দিয়ে আমার এক হাতের গ্লাভস হারিয়ে গেল। ভাগ্য ভালো আমি উপুড় হয়ে পড়িনি। তাহলে মোবাইল সমেত আমার হতো সলিলসমাধি।
সেখান থেকেও অনেকটা ধরে বেঁধে আমাদের নিয়ে গেল ভিক নামের ছোট্ট এক গ্রামে। সেখানের লাল রঙের এক গির্জার ছবিটাই আইসল্যান্ডের সিগনেচার ছবি। বৃষ্টিতে ছবি তোলা হলো না। এরপর আমরা গেলাম ভ্যাটনাজ কুল নামের এক হিমবাহ দেখতে। এটা কিন্তু ক্রমহ্রাসমান। এভাবে গলতে থাকলে পৃথিবীর মিষ্টিপানি কমে গিয়ে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। তাতে আমাদের দেশের মতো দেশগুলো বিপদে পড়বে। স্বচক্ষে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ব্যাপারটা দেখে এলাম।
আমরা ফেরার পথে আরেকটা জলপ্রপাত দেখলাম। নাম তার Seljalandsfoss, যেটার পাহাড়চূড়া থেকে পড়ন্ত পানির ধারার পেছনে যাওয়া যায় আর মজার সব ছবি তোলা যায়। নানা ঢঙে ছবি তুলে আমরা সেদিনের মতো রিকজাভিক ফিরলাম। আজকে কোনো রকম করে স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেয়েদেয়ে দিলাম ঘুম।
আগামীকাল আমাদের শেষ দিন। ঠিক করিনি কী করব।
১৭তম দিন
আমরা বেশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠলাম, উঠে নিজেদের বানানো নাশতা খেয়ে রিকজাভিক শহর ঘুরতে বের হলাম। শহরটা ছোট কিন্তু ক্রমাগত বাড়ন্ত। আমরা প্রতি ভোরে প্যাকেজ ট্যুরে যেতাম আর অনেক রাতে ফিরতাম বলে বুঝিনি।
শহরের মাঝের বিশাল গির্জা। নাম খটমটে Hallgrimskirkja.
সেটার ভেতর–বাহির ঘুরে ছবি তুলে হাজির হলাম শহরের একটা মূল সড়কে। সড়ক আবার রঙিলা, অনেকটা আমাদের আল্পনার মতো আঁকিবুঁকি করা। সেখানে থেকে কিছু উপহারসামগ্রী কিনলাম। কী ভয়াবহ দাম। কী আর করা, গলা শুকিয়ে গেল কিনতে গিয়ে। শুকনা গলা ভেজানোর জন্য কফি খেলাম যে দামে, তাতে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। কোনো রকমে নিজেকে ঠিকঠাক রেখে শহরটাকে ভালোভাবে ঘুরেফিরে আবিষ্কার করে আমরা পোতাশ্রয় (Harbour) থেকে তিমি দর্শনের একটা প্যাকেজ নিয়ে নিলাম। আমাদের জাহাজটা অনেকখানি সাগর ঘুরে এল, অপরূপ সব দৃশ্য। নৌবিহারে খোলা সাগরে আমরা শীতের বাতাসের তোড়ে মুমূর্ষু হলাম, তবুও তিমির দেখা পেলাম না।
টিকিটের এতগুলো টাকা সাগরে গেল। ফেরার পথে একটা পথহারা শিশু তিমি আমাদের ঘাটে স্বাগত জানাল।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা খোলা সাগরের স্বাধীন তিমি নয়। এটা এ পোতাশ্রয়ে থাকে, এটাই এর বাসাবাড়ি, এরাই এদের খাওয়াদাওয়া করায়। অনেকটা এতিম বাঘের মতো।
কী আর করা। সুন্দর সন্ধ্যাটা শীতের বাতাসে বিলীন হতে না দিয়ে আমরা দাঁতে দাঁত চেপে শহরের এগলি–সেগলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে অনেক রাতে এয়ারবিএনবিতে ফেরত এলাম।
এসে দেখি মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার বেশ কয়েকটা মেয়ে দলেবলে এসেছে। এরা নাকি গাড়ি ভাড়া করে ঘুরবে। আমি তো এদের সাহসের তারিফ করি। আমরা তো দুনিয়ার ইউরো খরচ করে চার-পাঁচ দিন ঘুরলাম, আর এরা গুগল ম্যাপ আর ট্রিপঅ্যাভাইজারের রিভিউ দেখে প্ল্যান করে ঘুরেটুরে দেখবে দ্বীপটা।
কী আর করা, যা খাবারদাবার বাকি ছিল আমাদের সঙ্গে, সবকিছু দিয়ে রাতের খানা প্রস্তুত হলো অনেকটা পিকনিকের ধরনে। খাওয়াদাওয়া অনেকের সঙ্গে ভাগ করে আর তাদের শুভেচ্ছা আর বিদায় জানিয়ে আমরা ঘুমাতে গেলাম আমাদের চিলেকোঠায়। আগামীকাল আমাদের ফ্লাইট। ইজি জেটে আমরা যাব ইতালির মিলান, সেখান থেকে অনিন্দ্যসুন্দর চিংকুয়ে টেরে। আর আমার ডাচপ্রবাসী বন্ধু এয়ার এভিয়াতে আমস্টারডাম ফিরে যাবে। সেই চিংকুয়ে টেরে অভিযান ছিল আরেক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বলা যায়, প্রচণ্ড শীতল অপার্থিব জগৎ থেকে পার্থিব এক জগতে অনুপ্রবেশ। চলবে...