ইউরো সফরের গল্প: পর্ব–২

৬ষ্ঠ দিন

রেনেসাঁর বাতাবরণে আবৃত মায়াবী ইতালির ফ্লোরেন্স ছেড়ে আমরা বেশ রাতের দূরপাল্লার বাসে পরদিন সকালে স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবিয়ানায় পৌঁছলাম। একসময় ভেনিস আর স্লোভেনিয়া সবই ছিল অস্ট্রো হাঙ্গেরীয় হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অধীন। পরে ইতালি রিপাবলিক হলে ভেনিস আর ডলোমাইট অঞ্চল অস্ট্রিয়ার হাতছাড়া হয়। আর পাশের স্লোভেনিয়ালাগোয়া বসনিয়ার রাজধানীতে সার্ব স্বাধীনতাকামীদের হাতে মৃত্যু হয় অস্ট্রিয়ার সম্রাটের। এরপর শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যার সমাপ্তিতে স্লোভেনিয়া আর সব স্লাভ অঞ্চলকে নিয়ে যুগোস্লাভিয়া, ক্রোয়াশিয়া, মন্টিনেগ্রো, বসনিয়া আর সার্বিয়া তৈরি হয়। এদের মধ্যে চেহারাসুরত আর ভাষার মিল থাকলেও ধার্মিক অমিলটা অনেক বড়। ক্যাথলিক, অর্থোডক্স আর ইসলাম মিলেমিশে ডালে–চালে খিচুড়ি। সেই লেটকা খিচুড়ি থেকে ডাল–চাল আলাদা হতে গিয়ে কী বিভৎস যুদ্ধ হয়েছিল বসনিয়ায়।

আমরা তো সিএনএন আর বিবিসিতে বসনিয়ার যুদ্ধ দেখে বড় হয়েছি।

এই যুগোস্লাভিয়ার পশ্চিমের একটি প্রদেশ হলো স্লোভেনিয়া। এখানকার সুন্দর একটি জায়গা হলো ব্লেড হ্রদ। হ্রদের টলটলে পানিতে আপনার মন হারিয়ে যাবে। হ্রদের মাঝখানে একটুকরা পাথুরে চর, থুক্কু দ্বীপ। সেখানে খ্রিষ্টান সাধুরা একটা মনেস্ট্রি বানিয়েছিলেন অনেক আগে। সেখানে আবার যেতে হয় নৌকা করে।

হ্রদটাকে ঘিরে রেখেছে উঁচু সব পাহাড়ের সারি, আর সেগুলোর চূড়ায় জমা বরফের গলে যাওয়া পানিতে এই হ্রদ হয় টইটম্বুর।

এই সুন্দর হ্রদ, এই গির্জা আর পাহাড়শ্রেণি দেখতে লাখো লোক আসে ইউরোপের দেশগুলো থেকে। ইনস্টাগ্রামে ছবি ভাইরাল হওয়ায় এটাও ওভার ট্যুরিজমে আক্রান্ত হয়েছে।

রাজধানী লুবিয়ানার বাসস্ট্যান্ড থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাস ছাড়ে সেখানে যেতে। তাই যাওয়া–আসা খুবই সহজ।

আমরা থাকার জন্য এয়ারবিএনবি নিয়েছিলাম লুবিয়ানার নতুন এলাকায়। তাড়াহুড়ায় শহরের পুরোনো অংশে যাওয়া হয়নি।

আমরা এক রাত ছিলাম এখানে।

৭ম দিন

খুব ভোরে এখান থেকে ভিয়েনায় যাওয়ার ট্রেন ছাড়ে। আমরা সকাল সকাল ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে সূর্য ওঠার অপরূপ দৃশ্য আর প্রকৃতি দেখতে দেখতে অস্ট্রিয়ার ভিলাচ জংশনে চলে এলাম। এরপর অস্ট্রিয়ার কিউবিবি ট্রেনে উঠে সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে দ্রুত ট্রেনে ভিয়েনায় এসে পৌঁছলাম মধ্য সকালে। ভিয়েনা রেলস্টেশনটা সুন্দর, এটা থেকে বের হলেই পুরোনো ভিয়েনা, আহ, seeing is believing, আমরা কিন্তু এ শহরে থাকব না, থাকব সালজবুর্গে। আমাদের তখনো নাশতা হয়নি, ক্ষুধায় আমরা কাতর। তাই ভিয়েনা দেখার অভিযান শুরুর আগে মালপত্র স্টেনের মালগুদামে (লকার) রেখে স্টেশনের বাহারি খাবারের দোকানে খাবার খুঁজতে খুঁজতে এক নরওয়েজিয়ান দোকানে বাঙালি ভাই পেয়ে গেলাম। তার দয়ায় একটা খাবারের দাম দিয়ে দুজনের খাবার পেলাম। আগেই বলে রাখি, অস্ট্রিয়া ভীষণ খরচের জায়গা। তাই এটা ছিল মেঘ না চাইতে জল। নরওয়ের এই খাবারের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। ১৮ থেকে ২০ ইউরো।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ নানা সমস্যা, জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

দেশি ভাই আমাদের দেখে মায়ায় মায়ায় খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কী যে মজার খাবার! মাছ আর সবজি দিয়ে সকালের নাশতা শেষে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম ভিয়েনা ব্যবচ্ছেদে। এটাও আমার দ্বিতীয় সফর। আগেভাগে ৮ ইউরো দিয়ে কিনে রাখা ভিয়েনা পাসে ভর করে সঙ্গীকে নিয়ে আমরা প্রধান বেলেভার্দ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একে একে ভিয়েনা সেইন্ট স্টিফেন্স ক্যাথেড্রাল দেখে হাবসবুর্গ আমলের আরও সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ দেখে ফেললাম। হফবুর্গ, বেলেভার্দে এসব প্রাসাদ এখন লাইব্রেরি আর জাদুঘর করা হয়েছে। এসব দেখে ঘুরে আমরা গিয়ে হাজির হলাম মিউজিয়াম পাড়ায়। ভিয়েনার পটুয়া গুস্টাভ ক্লিমট আর প্রাক্‌–আধুনিক চিত্রকর্মে ভর্তি এসব চিত্রশালা (আর্ট গ্যালারি)। সময়ের অভাব, তাই আমরা পুরোনো ভিয়েনা ছেড়ে শহরের প্রান্তের সনব্রুন শিকারবাড়িতে হাজির হলাম। এটা বিশাল বাগানবাড়ি আর অপরূপভাবে সাজানো। আমরা ঢালু বাগান বেয়ে বেয়ে বেশ উঁচুতে থাকা রাজকীয় টি –হাউসে হাজির হলাম। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই যে ভিয়েনা তার কফি আর পেস্ট্রি বিশেষত ক্রয়সোর জন্য বিখ্যাত। ক্রয়সোটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির। এটার জন্ম তুরস্কের বিরুদ্ধে কোনোরকমে টিকে থাকার স্মৃতি স্মরণে। আর ভিয়েনায় কফি কালচার শুরু হয়েছে যুদ্ধের মাঠে তুর্কিদের ফেলে যাওয়া কফি বিনের বস্তার কল্যাণে।

আমরা সেই শিকার বাড়ির টি–হাউসে ভিয়েনা কফির সঙ্গে একধরনের দই দেওয়া পায়েস খেলাম একগাদা ইউরো খরচ করে।

এরপর ধীরে ধীরে নেমে এলাম সেখান থেকে। এরপর আমরা আবার ফিরে এলাম ভিয়েনার সেই বেলেভার্দে। বিকেলটা ছিল মনোরম। কত্ত লোক, কত্ত মজার খাবারের গন্ধে ম ম করছিল চারদিক। ভিয়েনা ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছিল না, কী আর করা, আগে থেকে কাটা সালজবুর্গে যাওয়ার ট্রেনে উঠে বসলাম। কী ভীষণ অবস্থা! এখানেও বন্যার থাবা। ট্রেন অন্য পথ ঘুরে সালজবুর্গে যখন পৌঁছাল, তখন শহরটায় সন্ধ্যা নেমে গেছে আর টিপ টিপ বৃষ্টি মাথায় করে আমরা স্টেশনের পাশের এয়ারবিএনবিতে হাজির হলাম। এটা হবে আগামী তিন রাতের আবাস।

বাসায় ঢুকে আমাদের আমন্ত্রকের (হোস্ট) সঙ্গে গালগল্প করে দিলাম ঘুম। কারণ, কাল যেতে হবে পাশের জার্মানির বিশাল শহর মিউনিখে। সেখানে শুরু হয়েছে বাৎসরিক মদ উৎসব ‘অক্টোবর ফেস্ট’।

আমরা অবশ্য মদ খেতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি মদ, মদারু আর মাতালদের দেখতে। আর সেই সঙ্গে মিউনিখ শহর দেখার খায়েসে।

৮ম দিন

সকালে উঠে দেখি, সালজবুর্গ ঘোলাটে।

তাই বৃষ্টি আসার আগেই ট্রেনে করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মিউনিখে।

বাপরে, গিয়ে দেখি চারদিকে উৎসব। ছেলে–বুড়ো সবাই ব্যাভারিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক ড্রিন্ডল পরে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

একদম আমাদের পয়লা বৈশাখের মতো।

তাই আমরা ট্রেন থেকে নেমে পুরোনো মিউনিখের মেরিয়েন প্লাটজের প্রধান হাঁটা রাস্তা ধরে হাজির হলাম নতুম সিটি হলে। এখানে টাওয়ারে এক বিখ্যাত যান্ত্রিক ঘড়ি। তার মাঝখানে লাগানো পুতুল চরিত্রগুলো ঘণ্টায় ঘণ্টায় নেচে–কেঁদে একাকার হয়। পর্যটকেরা অবাক হয়ে তা উপভোগ করেন। আমরা বেশ তাড়াহুড়া করে একদম ঘণ্টার কাঁটা পড়ার ঠিক মুহূর্তে হাজির হলাম। আর দেখে ফেললাম এই অনবদ্য যান্ত্রিক ঘড়ির পুতুলনাচ। এত্ত সকালে ট্রেন ধরায় সকালের নাশতা হয়নি।

তাই ঘড়ি টাওয়ারের পাশের এক ঐতিহ্যবাহী দোকান থেকে নানা বেকারি পণ্য কিনে খেলাম বেশ মজা করে। এরপর এ গলি–সে গলি ঘুরে মিউনিখ পাস কিনে সুন্দর ট্রামে করে হাজির হলাম অক্টোবর ফেস্টের মেলার কাছাকাছি। ট্রাম থেকে নেমে মেলায় যেতে বেশ অনেকটা পথ হাঁটতে হলো। পথনির্দেশক আর হাজারো পর্যটককে অনুসরণ করে হাজির হলাম মেলায়। এটা তো বিশাল ব্যাপার।

৬টা বিখ্যাত ব্রুয়ার বা শুড়ি বা সুরাওয়ালাদের বড় বড় তাঁবু টাঙানো হয়েছে মদারুদের জন্য।

আমরা হবু মদারু আর শুড়িদের আয়োজিত অনুষ্ঠান দেখে কিছু সাধারণ খাবার খেয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। আসার সময় ট্রামে করে একটা লম্বা সফর দিলাম, শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। আসার সময় ইংলিসার গার্ডেনে নেমে একধরনের কাঠাবাদাম কুড়িয়ে আনলাম। এরপর বিকেলের ফিরতি ট্রেনে সালজবুর্গে ফিরে এলাম। আপনাদের বলে রাখি, উন্টার্সবার্গ পাহাড়শ্রেণি–সালজবুর্গ মিউনিখ পথের দুধারের দৃশ্য খুবই সুন্দর ছিল তখন। সন্ধ্যার কিছু পরে এসে পড়লাম সালজবুর্গে। বাসায় এলাম হেঁটে হেঁটে। আবহাওয়া খারাপ। সালজবুর্গ ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছাটা দমন করতে হলো। শহরটা সুন্দর। পাহাড়ের খাঁজ কেটে একটা দুর্গ করা হয়েছে, এ ছাড়া শহরে সুন্দর কয়েকটা প্রাসাদ আছে। মিরাবেল প্রাসাদের মিরাবেল ফুলবাগান। এ ছাড়া শহর থেকে একটু বাইরে হেলব্রুন প্রাসাদ। সেখানে বিখ্যাত Sound of Music ছবিটার দৃশ্যায়ন হয়েছিল। এত্ত বিশাল এলাকা, ঘুরতে ভালো লাগে। গতবার যখন এসেছিলাম এ শহরে, তখন বাসে করে এসে ঘুরেছিলাম। আর গেছিলাম উন্টার্সবার্গ স্কি স্লোপে।

সেখানে কেব্‌ল কারে যাওয়া যায় আর তখন শীত ছিল না তাই no skiing.

তাই অগত্যা সালজবুর্গ স্টেশনে থাকা বিখ্যাত প্যাটিসারি থেকে কেনা মজার মজার খাবার ভক্ষণ করে দিলাম ঘুম। কারণ, আগামীকাল ভোরের ট্রেনে যেতে হবে দুনিয়ার অন্যতম সুন্দর গ্রামে। গ্রামের নাম হালস্টাট ( Hallstatt)।

আরও পড়ুন

৯ম দিন

আমরা বেশ সকালে সুন্দর ঝলমলে সূর্য মাথায় নিয়ে সালজবুর্গ ছেড়ে দুটো ট্রেন পালটে সুন্দর একটা ট্রেনে করে সকাল সকাল এসে পৌঁছলাম এক হ্রদের ধারে। স্টেশনটা গ্রামের আরেক পাশে, গ্রামে যেতে হবে ছোট্ট একটা ইঞ্জিন নৌকা করে, সেটা আমাদের দেশি ভটভটির মতো শব্দ না করে চুপচাপ সকালের মোলায়েম রোদে ধোঁয়া ওঠা হ্রদের স্থির জল কেটে হাজির হলো হালস্টাটের খেয়াঘাটে। আমাদের ভাড়া হিসাবে বেশ কিছু ইউরো দিতে হলো নৌকার মাঝি ভদ্রমহিলাকে।

নামার আগেই আমরা মুগ্ধ গ্রামটাকে নৌকা থেকে দেখে। আমরা নেমে ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম শ খানেক। ইনস্টাগ্রামের জায়গাগুলোয় ঘুরে ঘুরে অপরূপ দৃশ্যগুলো রেখে ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে এক দোকানে কফি খেয়ে চাঙা হয়ে নিলাম।

এরপর আমাদের গন্তব্য গ্রামের লাগোয়া পর্বতশৃঙ্গ।

সেখানে আপনি কেব্‌ল কারেও উঠতে পারেন বা খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়েও, আমরা আমাদের পুরুষত্ব দেখানোর জন্য বেয়ে বেয়ে উঠতে গিয়ে জানপ্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমরা শহুরে ছেলেপেলের দল, শারীরিক কসরতে একদম কম পারদর্শী। পাহাড় বাওয়া কঠিন, এক পা উঠি আর নিশ্বাস নিই, আমাদের প্রচণ্ড তৃষ্ণা পাচ্ছিল আর জিহ্বা অর্ধেক বের হয়ে গেছিল। পাশ দিয়ে মেয়ে–বুড়া সব অনায়াসে পাড় হয়ে যাচ্ছিল। কী নিদারুণ অবস্থা! অনেক কষ্টে পাহাড়ের ওপরে উঠে সব কষ্ট দূর হয়ে গেল। কী অসাধারণ দৃশ্য, পাহাড়শ্রেণির মাঝখানে একটা হ্রদ আর তার পাশে রূপকথার মতো একটা গ্রাম। তার মাঝখানে একটা গির্জার মিনার বা বেল টাওয়ার।

সেখানে এরা আবার তৈরি করেছে একটা দৃশ্য দেখার কংক্রিটের প্ল্যাটফর্ম। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে প্ল্যাটফর্মটা অনেকটা শূন্যে ঝুলন্ত।

আহ, আমাদের কষ্ট সার্থক। সেই প্ল্যাটফর্মে ছবি তোলার লম্বা সারি শেষে আমাদের পালা পেয়ে গাদা গাদা ছবি তুলে পাশের লবণের খনির ভেন্ডিং মেশিন থেকে কফি জুস খেয়ে আমরা ভাবছিলাম পাহাড়ের খাঁজে থাকা ট্যুরিস্টি রেস্তোরাঁয় কিছু খাব। কিন্তু পর্যটকদের ভিড়ের কল্যাণে আমাদের পালা আসত বিকেলে। তাই অপেক্ষা না করে ধীরে ধীরে আবারও খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলাম।

সেখানে বিকেলটা কাটিয়ে এটা–সেটা খেয়ে সন্ধ্যার আগের খেয়ানৌকা ধরে রেলস্টেশনে এসে পৌঁছলাম। এত্ত ভিড় যে ট্রেনে উঠতে পারলাম না, তাই পরের শেষ ট্রেনে এসে পৌঁছলাম সালজবুর্গে। সেদিন বৃষ্টি না হলেও বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই সালজবুর্গ ঘুরে দেখা হলো না। বিফল মনোরথে আমরা সিরিয়ার একটি দোকানে রাতের খাবার খেলাম পেট পুরে।

আজও সালজবুর্গ দেখা হলো না, কারণ সে রাতেই আমাদের প্যারিসে যাওয়ার ট্রেন।

মধ্যরাতের ট্রেনের এ সফর বেশ লম্বা। প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার। মাঝখানে আবার ট্রেন পালটাতে হবে স্টুটগার্টে। সেটা সৌভাগ্যক্রমে সকালে। সারা রাত সালজবুর্গে থেকে সেই মিউনিখ আর জার্মানির অচেনা সব শহর–নগর পাড়ি দিয়ে ট্রেনটা যখন ভীষণ গতি নিয়ে ছুটছিল, তখন আমি ঢুলুঢুলু চোখে ঘুমানোর আয়োজনে ব্যস্ত। কারণ, কাল সকালে গিয়ে পৌঁছাব সুন্দরী প্যারিসে।

ট্রেন সফরটা ছিল নানান ঘটনায় ভরপুর। অস্ট্রিয়ার ট্রেন কিন্তু সময় মেনে চলে, কিন্তু বন্যার জন্য ট্রেন ছাড়ল দেরিতে, এরপর মিউনিখে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ট্রেনে হুড়মুড় করে উঠে পড়ল এক দংগল অক্টোবর ফেস্টের মদারু মাতাল। এদের হইহুল্লোড়ে আমার ঘুমের দফারফা। এরা নেমে গেল কোনো অচেনা স্টেশনে। এরপর ঘুম আসে না, তাই ট্রেনে থাকা ভেন্ডিং মেশিনে চা, কফি, আইসক্রিম খেলাম। তাও ঘুম আসে না, যেই না ঘুম এল, ঠিক তখনই ঘোষণা এল যে আমরা স্টুটগার্টে পৌঁছে গেছি।

কী মজার ব্যাপার যে ট্রেন সময়ের আগেই পৌঁছে গেছে। এত্ত দেরিতে রওনা দিয়েও কী দ্রুত টেনে এসে পৌঁছে গেল?

আমাদের পরের কানেক্টিং ট্রেন দুই-আড়াই ঘণ্টা পর। সেটার নাম উই ট্রেন, টিজিভি জাতীয় দোতলা দ্রুতি ট্রেন। যখন স্টেশনে নামলাম, তখন যেন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। তাই স্টেশনলাগোয়া স্টুটগার্টের পুরোনো অংশ দেখা হলো না।

তাই বিফল মনোরথে আমরা আশ্রয় নিলাম যাত্রীদের জন্য অপেক্ষাকক্ষে।

অপেক্ষা প্যারিসে যাওয়ার লৌহ শকটের। চলবে...

(সংশোধনী: এ ভ্রমণ গল্পে লুডউইগ ভ্যান বিঠোফেনের জন্মস্থানের তথ্যটি সঠিক লেখা ছিলো না। পরে সেটি সংশোধন করা হয়েছে।)

h )

**পরের পর্ব: প্যারিস অভিযান