কোনো জাতি যখন তার অতীতকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে এবং তাদের ইতিহাসকে ইচ্ছেমতো পরিবর্তনের পথে পা বাড়ায়, তখন সেখান থেকে ফ্যাসিবাদের জন্ম নেয়। জর্জিয়া ও ইউক্রেনে এখন বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ দুই দেশের ওপর রাশিয়ানদের যে অবদান, সেটিকে এ দুই দেশের মানুষ আজকের দিনে বেমালুম ভুলে গেছে। শুধু জর্জিয়া কিংবা ইউক্রেন নয়, ইউরোপ থেকে শুরু করে সোভিয়েতপরবর্তী বিভিন্ন রাষ্ট্র, এমনকি রাশিয়া ও বেলারুশের তরুণ প্রজন্মের অনেকেও কমিউনিজমকে খারাপ চোখে দেখে। তাদের চোখে কমিউনিজম মানে ডিক্টেটরশিপ, যেখানে মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা কিংবা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত সীমিত।
পশ্চিমের গণমাধ্যম এদিক থেকে স্বার্থক। রাশিয়াকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ধারণার প্রচলন রয়েছে, যেগুলো অনেকাংশে সঠিক নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে, রাশিয়ানরা জাতি হিসেবে খুবই স্মার্ট। এটা ঠিক যে তাঁরা কিছুটা শীতল প্রকৃতির, তবে রাশিয়ানরা ভীষণ অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবাৎসল।
তুরস্ক, গ্রেট ব্রিটেন ও জার্মানি থেকে শুরু করে অনেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রাশিয়া দখলের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সবাইকে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার ছাপ নিয়ে রাশিয়া ত্যাগ করতে হয়েছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পতন শুরু হয়েছে স্তালিনগ্রাডের যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। রোনাল্ড রিগানের চতুরতার কাছে গর্বাচেভ পরাজিত হয়েছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। কিন্তু এত অল্প সময়ে রাশিয়ানরা আবার অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে ফিরে আসবে, সেটা হয়তো বা কারও কল্পনায় ছিল না।
পুতিন ও সি চিন পিং উভয়ই একনায়কতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে তাঁদের দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তাই বলে পুতিনকে দিয়ে রাশিয়া এবং সি চিন পিংকে দিয়ে চীনকে কোনোভাবে মূল্যায়ন করা উচিত নয়।
যদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির জেলেনস্কি ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন, তবে কী রাশিয়া ইউক্রেনে কোনো ধরনের সামরিক অভিযান চালাত? ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে, যদিও প্রকাশ্যে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তারা সেনাবাহিনী পাঠায়নি। এটা ঠিক যে গোপনে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর অনেক সেনাসদস্য ইউক্রেনের পক্ষে লড়াই করছেন। তবে রাশিয়ার মতো পরাক্রমশালী দেশকে পরাস্ত করতে এ প্রচেষ্টা কী যথেষ্ট? ইউক্রেনীয়রা এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কাছে যে পরিমাণ ভূমি হারিয়েছে, সেটার পূর্ণনিয়ন্ত্রণ তাদের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। এ যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নারী ও শিশু থেকে শুরু করে দেশটির অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেছেন, কেউ আবার পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। দেশটির অবকাঠামোও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমানে ইউক্রেন ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ দেশগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিনিয়ত এ যুদ্ধ পরিচালনা করতে যে বিশাল অঙ্কের খরচ প্রয়োজন, সে পরিমাণ অর্থের জোগান দেওয়া দেশটির জন্য বাড়তি চাপ।
রাশিয়া চেয়েছিল ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে জেলেনস্কিকে অপসারণ করে দেশটিতে রুশপন্থী কাউকে ক্ষমতায় বসাতে। রাশিয়া তার এ উদ্দেশ্য পূরণে এখনো সফল হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে সব সময় অবজ্ঞার চোখে দেখেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়াকে এ মুহূর্তে পরাজিত করার মতো সামরিক শক্তি ইউরোপের কোনো দেশের কাছে নেই। এমনকি ইউরোপের পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সও রাশিয়ার চেয়ে শক্তিমত্তার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। রাশিয়ার চেয়ে বেশি সামরিক শক্তিধর একমাত্র দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ মুহূর্তে যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে এবং রাশিয়ার ওপর পারমাণবিক আক্রমণ চালায়, তাহলেই কেবল রাশিয়াকে পরাজিত করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রেও একটা কথা আছে, রাশিয়ার সঙ্গে এ মুহূর্তে চীনের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে পশ্চিমা জোটের মোকাবিলায় তাঁর দেশ সব সময় রাশিয়ার পাশে থাকবে। কাজেই রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করলে চীন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। চীন তখন পুরোদমে রাশিয়াকে প্রকাশ্যে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা কাজ করছে। কাজেই এ যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় কখনো সম্ভব নয়।
আগেই বলেছি, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক ও জার্মানি ইতিমধ্যে ন্যাটোর সদস্য। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হতে চলেছে, যদিও এ দুই দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদের একটি বড় অংশ আজও মনে করেন সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের উচিত ন্যাটো জোটে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার পরিবর্তে নিরপেক্ষ বাফার রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করা। এসব প্রতিটি দেশ বাল্টিক সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। কালিনিনগ্রাদ নামে রাশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল রয়েছে। কালিনিনগ্রাদ উত্তর ও পূর্ব দিক বরাবর লিথুয়ানিয়া, দক্ষিণে পোল্যান্ড ও পশ্চিমে বাল্টিক সাগরের সঙ্গে মিশেছে। এ কারণে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে কালিনিনগ্রাদ পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন। রাশিয়া ট্রেনের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য লিথুয়ানিয়ার মধ্য দিয়ে কালিনিনগ্রাদে পাঠায়। কিন্তু লিথুয়ানিয়া তার ভেতর দিয়ে রেলপথে কিছু পণ্য কালিনিনগ্রাদে পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার বাল্টিক নৌবহরের প্রধান সদর দপ্তর এ কালিনিনগ্রাদে। কালিনিনগ্রাদকে বেষ্টন করে রাখা অন্য সব দেশ বলতে গেলে ন্যাটোর সদস্য। অর্থাৎ বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার প্রবেশাধিকারকে অনেকটা সংকুচিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাই কালিনিনগ্রাদের নিরাপত্তায় এ মুহূর্তে রাশিয়া যদি সর্বশক্তি নিয়োগ করে, সেটা ইউরোপে বাড়তি উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। প্রয়োজনবোধে পুতিনের নির্দেশে রাশিয়ার সেনাবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড এমনকি সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ের ওপর হামলা করতে পারে। ফিনল্যান্ডের সঙ্গেও রাশিয়ার দীর্ঘ সীমানা রয়েছে। পুতিন নিজ দেশের নিরাপত্তার অজুহাতে যেকোনো মুহূর্তে ফিনল্যান্ডে আক্রমণ চালালে, সেটা নিয়েও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। শুধু বাল্টিক সাগরের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হতে পারে। স্যাংশন দিয়ে রাশিয়াকে গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি, বরং ইউরোপের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে।
ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার যুদ্ধ একদিকে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যেভাবে অন্য এক স্তরে নিয়ে গেছে, ঠিক একইভাবে ইউরোপকে অধিকমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর করে তুলেছে। সামনের দিনগুলোতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুদ্ধাস্ত্র আমদানি বাড়িয়ে দেবে। এমনকি নিজেদের আত্মরক্ষায়ও এসব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকবে। পশ্চিমা দেশগুলোর মানবতা যে অনেক ক্ষেত্রে সিলেকটিভ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সে বিষয়টি বড় পরিসরে স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ সামরিক খাতে বাজেট কমিয়ে জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন সেক্টরে অর্থ ব্যয় করেছে। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, ডেনমার্ক অর্থাৎ ইউরোপের যে দেশগুলো এত দিন নিজেদের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেট হিসেবে দাবি করত, সামরিক খাতে তারা বাজেট বাড়িয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও যদি তারা সামরিক খাতের উন্নয়নে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করে, তখন এসব দেশের স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে চিকিৎসা খাতসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো হোঁচট খাবে, যার প্রভাব এসব দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কখনো কল্যাণকর হবে না।
যেকোনো ধরনের যুদ্ধ মানবতার জন্য বড় বিপর্যয়। তা ছাড়া একবিংশ শতাব্দীর এ যুগে প্রতিটি রাষ্ট্র একে অপরের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সংযুক্ত। যুদ্ধের ফলে একদিকে যেমন বিশ্বশান্তির ওপর আঘাত আসে, ঠিক তেমনভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির জন্যও যুদ্ধ হুমকিস্বরূপ। কাজেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ অচিরে বন্ধ হোক, সে কামনা করি। শেষ...।
*লেখক; রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া