পশ্চিমা গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা ও ইউরোপের একচোখা মানবতা-১

দূর পরবাস ইউক্রেন–১
সেকশন: দূর পরবাস
ট্যাগ:
ছবি: ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ৩টি ছবি
শোল্ডার:
হেডিং:
,

ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত, এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিবিসি, সিএনএন, ফক্স নিউজসহ পশ্চিমের বিভিন্ন প্রচারযন্ত্র যে ধরনের সংবাদ পরিবেশন করছে, সেগুলো আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত? অন্যদিকে, ইউক্রেন থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে যাঁরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাঁদের এসব দেশ যেভাবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, অন্যান্য দেশ থেকে এসব দেশে পাড়ি জমানো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে সচরাচর একই ধরনের আচরণ করা হয় কি না, সে প্রশ্নও ঘুরেফিরে বারবার আলোচনায় আসছে।

এমনকি পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক কিংবা স্লোভাকিয়ার মতো দেশগুলো সব সময় রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত। অভিবাসী শরণার্থীদের ওপর এসব দেশের সরকার ও প্রশাসনের আচরণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। অথচ এসব দেশও ইউক্রেন থেকে আগত শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ করেছে। বিশেষত ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এমনকি আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে অসংখ্য মানুষ যখন অভিবাসনপ্রত্যাশী হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে পাড়ি জমান, তখন তাঁদের বিভিন্ন ধরনের জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।

পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে একধরনের নাক সিটকানো মনোভাব প্রদর্শন করে। অথচ ইউক্রেন থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসব দেশে পাড়ি জমানো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঘিরে তাঁদের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পাবলিক প্লেস, এমনকি বাসাবাড়ির বারান্দা ও ছাদে ইউক্রেনের পতাকা ঝোলানো হচ্ছে। সব জায়গায় লেখা হচ্ছে, ‘লেটস সাপোর্ট ইউক্রেন’।

সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষও নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী ইউক্রেনে অর্থ সহায়তা পাঠাচ্ছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো যতটা সোচ্চার, ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন কিংবা সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইরাকের মতো দেশগুলোতে পশ্চিমা জোটের সামরিক অভিযান নিয়ে কার্যত সেভাবে আওয়াজ তোলেনি। মার্কিন এক সাংবাদিক একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেছেন, ‘Ukraine is not like Iraq or Afghanistan. In fact, Ukraine is a country that is relatively civilised and relatively European too.’ আরেক সাংবাদিক বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘It’s really emotional for me because I see the European people with blue eyes and blonde hair being healed, children being killed with Putin’s missiles and his helicopters and his rockets’। তাই অনেকে ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, পশ্চিমের দেশগুলো আজও হোয়াইট সুপ্রিমেসিকে লালন করে এবং প্রচ্ছন্নভাবে হলেও এসব দেশের সরকার ও প্রশাসন বর্ণবাদের পৃষ্ঠপোষণ করে। ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার যুদ্ধ বিষয়টিকে কেবল মানুষের সামনে প্রকাশ্য করে তুলেছে বলে তাঁরা দাবি করেন।

অনেকে আবার এমনটি বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া সামরিক অভিযান চালিয়েছে। রাশিয়ার পরিবর্তে পশ্চিমের কোনো দেশ ইউক্রেনে আক্রমণ করলে হয়তোবা পশ্চিমের বেশির ভাগ গণমাধ্যম সে আক্রমণের পক্ষে প্রচার চালাত। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রতিবেদনের জন্য আল–জাজিরা এবারও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
রাশিয়া যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে গ্যাস কিংবা জ্বালানি তেল সরবারহ বন্ধের ঘোষণা দেয়, তখন পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টিতে সেটা ব্ল্যাকমেলিং।

অবশ্যই গ্যাস কিংবা জ্বালানি তেলের অভাবে কেউ কষ্ট পাক, সেটা কোনোভাবে কাম্য নয়। আন্তর্জাতিক বিড়াল প্রদর্শনীতে যখন রাশিয়ার বিড়ালের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, কিংবা অলিম্পিক, ফুটবল বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্পোর্টস ইভেন্টে যখন রাশিয়া ও বেলারুশের তারকাদের নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন পশ্চিমা দেশগুলোর মিডিয়া সেটাকে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও সমর্থন জানায়।

একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর অন্য কোনো দেশের সামরিক হস্তক্ষেপ কোনোভাবে কাম্য নয় এবং এ জন্য ওই দেশের সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে। কিন্তু বিড়াল কিংবা এসব অ্যাথলেট বা খেলোয়াড় কিংবা যাঁরা সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতির সঙ্গে যাঁদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, তাঁরা কেন নিষেধাজ্ঞার শিকার হবেন?

সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলোর তেমন একটা ফারাক নেই। এমনকি দেশটির সাধারণ মানুষের মানসিকতাও পশ্চিমাদের সঙ্গে মিলে যায়। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো রাশিয়াকে পশ্চিমের কোনো দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অসম্মতি জানায়। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক সুদীর্ঘ কালের। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া কিংবা লিথুয়ানিয়ার মানুষ প্রায়ই দাবি করেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা কার্যত রাশিয়ার উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু ইউক্রেনের জনসাধারণের পক্ষে এ ধরনের দাবি তোলার সুযোগ সীমিত। অবশ্য এ যুদ্ধের কারণে এখন ইউক্রেনের জনসাধারণও বলতে শুরু করেছে যে রাশিয়া তাদের সঙ্গে বরাবর উপনিবেশের মতো আচরণ করেছে এবং রাশিয়া সব সময় ইউক্রেনের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে দেশটিকে তাদের পেটে ঢোকানোর চেষ্টা করেছে।

সোভিয়েত শাসনামলকে ইউক্রেনের বর্তমান প্রজন্ম তাঁদের ইতিহাসের অন্ধকারাছন্ন অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করতে চাইছে। ২০০৪ সালে মিখাইল সাকাসভিলি জর্জিয়ার তৃতীয় প্রেসিডন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দুই মেয়াদে দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পেত্রো পরোশেঙ্কো। পাঁচ বছর তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।

মিখাইল সাকাসভিলি, পেত্রো পরোশেঙ্কো, ভলোদিমির জেলেনস্কি—তিনজনই কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত। পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে তাঁরা সব সময় সখ্য বজায় রেখে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। মজার বিষয় হচ্ছে, জর্জিয়ার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট মিখাইল সাকাসভিলির ইউক্রেনের নাগরিকত্ব রয়েছে এবং ২০১৫ সালের মে থেকে শুরু করে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর তিনি ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল ওদেসা ওবলাস্টের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মিখাইল সাকাসভিলি জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশটিকে তিনি পশ্চিমা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। মূলত তাঁর শাসনামল থেকে দেশটির সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যে রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। মিখাইল সাকাসভিলির শাসনামল জর্জিয়ায় কট্টর জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়।

তিনি জর্জিয়াকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান জোসেফ স্তালিন ছিলেন একজন জর্জিয়ান, ১৮৭৮ সালে জর্জিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর গোরিতে তাঁর জন্ম হয়। জোসেফ স্তালিনকে ঘিরে হাজারো বিতর্ক থাকতে পারে, তবে তিনি একটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটা মহা পরাক্রমশালী রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অথচ আজকের দিনে জর্জিয়ার বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ জোসেফ স্তালিনকে আড়াল করে রাখতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

সোভিয়েত শাসনামলে আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেটিয়া ছিল স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। উত্তর ওশেটিয়া আগের থেকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত। পশ্চিমের গণমাধ্যম বারবার দাবি করে যে রাশিয়া জর্জিয়ার কাছ থেকে আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেটিয়ার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে।

জর্জিয়ার সাধারণ মানুষও মনে করেন যে আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেটিয়া তাঁদের দেশের অংশ এবং রাশিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে এ দুই অঞ্চলকে জোর করে দখল করেছে। ২০০৮ সাল থেকে রাশিয়া ও জর্জিয়া—এ দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেকটা তলানির দিকে।

যদিও রাশিয়ার নাগরিকেরা ভিসা ছাড়া জর্জিয়া ভ্রমণ করতে পারেন, তারপরও এ মূহূর্তে জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে রাশিয়ার কোনো দূতাবাস নেই। পশ্চিমের মিডিয়াগুলো আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেটিয়াকে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রচার করেনি। যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক গ্রাহাম ফিলিপস তাঁর এক বক্তব্যে জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার টানাপোড়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তবে পশ্চিমা ঘরানার অন্যান্য সাংবাদিকের চেয়ে তিনি অনেকটা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। প্রথমত, মিখাইল সাকাসভিলি আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেটিয়াকে স্বায়ত্তশাসন দিতে অস্বীকার জানান। তাঁর নির্দেশে জর্জিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক অভিযান চালায়।

কোনো উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া এ দুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে। শুধু তা–ই নয়, পরবর্তী সময় এ দুই অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নে রাশিয়া বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে। গ্রাহাম ফিলিপস তাঁর প্রতিবেদনে এমনটি উল্লেখ করেছেন। চলবে...

*** আগামীকাল পড়ুন: পশ্চিমা গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা ও ইউরোপের একচোখা মানবতা-২

লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া