পশ্চিমা গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা ও ইউরোপের একচোখা মানবতা-৩

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ
ফাইল ছবি: এএফপি

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ককে অনেকাংশে বিনষ্ট করে দিয়েছে। এ সম্পর্ক নিকট ভবিষ্যতে সহজে ঠিক হওয়ার মতো নয়।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ যুদ্ধের ইন্ধনদাতা হিসেবে বারবার যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে দায়ী করা হচ্ছে। রাশিয়ার এ দাবিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছে। ১৯৬২ সালে ফিদেল কাস্ত্রো সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রুশেভের সাহায্য প্রার্থনা করে বার্তা পাঠান। নিকিতা ক্রুশ্চেভ ফিদেল কাস্ত্রোকে সহায়তা করার আশ্বাস দেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাতে কোনোভাবে ফিদেল কাস্ত্রোর ওপর মিসাইল আক্রমণ চালাতে না পারে, সে জন্য কিউবাতে মিলিটারি বেজ স্থাপনের ঘোষণা দেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডন্ট জন এফ কেনেডি নিকিতা ক্রুশ্চেভের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে তুরস্ক থেকে দেশটির দিকে মিসাইল উৎক্ষেপণের ঘোষণা দেন। ফলে যুদ্ধের পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়, যদিও শেষ পর্যন্ত নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও জন এফ কেনেডি একে অন্যের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছান। ফ্লোরিডার সীমানা থেকে কিউবার অবস্থান খুবই কাছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র কিউবার মতো একটি দেশ, যে দেশের অবস্থান তার ভৌগোলিক সীমানা থেকে খুব একটা দূরে নয়, সে দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক উপস্থিতি মেনে নেবে না, এটা স্বাভাবিক। একইভাবে ন্যাটোর সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার বৈরিতা রয়েছে। ইউক্রেনের মতো একটি দেশ যে দেশের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘ সীমানা রয়েছে এবং ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে যে দেশটি রাশিয়ার কাছাকাছি, সে দেশটি ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হোক, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে রাশিয়া সে বিষয়টি কখনো মেনে নেবে না। তা ছাড়া ন্যাটোর পরিসীমা এখন কেবল আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ওয়ারশো প্যাক্টের কথা আমরা জানি।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
ছবি: রয়টার্স

সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশপাশি পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, চেক রিপাবলিক, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, আলবেনিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিজমভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ছিল। পূর্ব ইউরোপের এসব দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ওয়ারশো প্যাক্ট গঠন করে। যদিও পরে আলবেনিয়া ও রোমানিয়া ওয়ারশো প্যাক্ট থেকে বের হয়ে যায়। যদি কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্র কোনো শক্তি এসব দেশের কোনোটিতে সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের অংশ হিসেবে ওয়ারশো প্যাক্ট গঠন করা হয়েছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের এসব দেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ন্যাটো নামে এক বিশেষ সামরিক জোট গঠন করেছিল। যদিও পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্র নয়, তারপরও তুরস্ক ১৯৫২ সাল থেকে ন্যাটোর সদস্য। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এক হয়, বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়। পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশে কমিউনিজমভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ছিল, ওই সব দেশও গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে পা বাড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওয়ারশো প্যাক্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও ন্যাটো তখন সম্প্রসারণে মনোনিবেশ করেছে। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, চেক রিপাবলিক, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও আলবেনিয়া আজ ন্যাটোর সদস্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন থাকা লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়াও ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। রাশিয়ার কাছে ওই সময় পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি ছিল ছিল না, যার মাধ্যমে জার্মানি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, চেক রিপাবলিক কিংবা স্লোভাকিয়ার মতো দেশগুলোতে ন্যাটোতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রাখা যায়। পুতিনের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে, বিশেষত এ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া বিশ্বরাজনীতিতে আবারও প্রাসঙ্গিক হতে আরম্ভ করে।

ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো দেশ, যারা চিরকাল জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, তারাও ন্যাটোর সঙ্গে সংযুক্ত হতে চলেছে। মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া একসময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন—উভয় রাষ্ট্রের বলয় থেকে প্রভাবমুক্ত থাকার পাশাপাশি সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা রাষ্ট্রগুলো যাতে নিরপেক্ষভাবে বাফার স্টেটের ভূমিকা পালন করতে পারে, সে জন্য তিনি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। একসময় যুগোস্লাভিয়ার অধীন যেসব দেশ ছিল, এর মধ্যে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া ও মন্টিনিগ্রোর সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করেছে। কসোভো ও বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ন্যাটোর সদস্য হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
রয়টার্স ফাইল ছবি

সার্বিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুচিচ রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন। কসোভো যুদ্ধের সময় ন্যাটো সরাসরি সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর ওপর বোমা হামলা চালিয়েছে। এ কারণে সার্বিয়ার সাধারণ মানুষ ন্যাটোকে সমর্থন করেন না। মন্টিনিগ্রো ও মেসিডোনিয়ার বেশির ভাগ মানুষও ন্যাটোকে সমর্থন করে না, তবে এ দুই দেশের সরকার সাধারণ মানুষের মতামতের তোয়াক্কা না করে মন্টিনিগ্রো ও মেসিডোনিয়াকে জোর করে ন্যাটোর সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। বেলারুশের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক চোখে পড়ার মতো। অন্যদিকে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পরও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তাঁকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা চালানোর বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আনা প্রস্তাবে তুরস্ক ভোট দেয়নি এবং এভাবে তুরস্ক রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছে। ১৯৯১ সালে দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার পর গণভোটের মধ্য দিয়ে জার্মানি ন্যাটোর সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও ওই সময় জার্মানির অনেক মানুষ দেশটিকে ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত করার বিপক্ষে ছিলেন। হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া যদিও বর্তমানে ন্যাটো জোটের সদস্য, তবে এ দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।

আরও পড়ুন
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
ফাইল ছবি : রয়টার্স

সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস, মাল্টা, অস্ট্রিয়া ছাড়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রায় সব দেশ বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য। এ মুহূর্তে সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস, মাল্টা ও অস্ট্রিয়ার মধ্য থেকে যেকোনো একটি দেশ নিরপেক্ষভাবে বাফার স্টেটের ভূমিকা পালন করতে পারত, তাহলে সে দেশের পক্ষে এ মুহূর্তে এ যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া সবচেয়ে সহজ হতো।

২০১৪ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ কারণে এ চুক্তির নাম মিনস্ক অ্যাগ্রিমেন্ট। মিনস্ক অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী, ইউক্রেনে বসবাসরত রুশভাষী জনসাধারণকে দেশটির সরকার তাঁদের যাবতীয় মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে এবং একই সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় লুহানস্ক ও দোনেৎস্কে ইউক্রেনের সরকার পূর্ণাঙ্গভাবে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করবে। দুর্ভাগ্যবশত, পেত্রো পোরোশেঙ্কো কিংবা ভ্লদিমির জেলেনস্কির কেউই মিনস্ক অ্যাগ্রিমেন্ট বাস্তবায়ন করেননি। যদি পেত্রো পোরোশেঙ্কো ও ভ্লদিমির জেলেনস্কি মিনস্ক অ্যাগ্রিমেন্ট বাস্তবায়ন করতেন, তাহলে হয়তো বা রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালাত না। মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়া বারবার কিয়েভের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সেই পেত্রো পোরোশেঙ্কোর শাসনামল থেকে পুতিন প্রশাসন এ দাবি জানিয়ে এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পশ্চিমের কোনো মিডিয়া মিনস্ক অ্যাগ্রিমেন্টকে নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা তুলে ধরছে না। অথচ এ যুদ্ধের কারণ হিসেবে মিনস্ক অ্যাগ্রিমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। কাজেই, পশ্চিমের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে রাশিয়াকে একচ্ছত্রভাবে দোষারপ করছে, সেটা কোনোভাবে কাম্য নয়।

আরও পড়ুন

ইউক্রেনের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কট্টর জাতীয়তাবাদী ও অতি ডানপন্থীদের ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠেছে। দেশটির শেষ দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণে তাঁরা প্রধান প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। মিনস্ক অ্যাগ্রিমেন্টের বাস্তবায়ন হোক, সেটি কি তাঁরা চাইবেন? কিংবা জেলেনস্কি যদি মনে করেন, তিনি যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন, তাঁকে কি কট্টর জাতীয়তাবাদী ও অতি বামপন্থীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবেন? এ প্রশ্নগুলো আলোচনায় আসা উচিত। চলবে...

লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া