একইভাবে পশ্চিমের মিডিয়াগুলো ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পেছনে এককভাবে বারবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দায়ী করে আসছে। তবে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে যুদ্ধের পুরো দায় পুতিন প্রশাসন কিংবা রাশিয়া—কারোর নয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে যখন ইউক্রেন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন সংবিধান অনুযায়ী দেশটিকে একটি জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তবে ২০১৪ সালে পেট্রো পোরশেঙ্কো ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনকে ন্যাটোর জোটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। ক্রিমিয়াকে ঘিরে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের ফাটল ধরতে শুরু করে। ক্রিমিয়া ছিল ইউক্রেনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। ক্রিমিয়া একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল এবং ক্রিমিয়ার বেশির ভাগ মানুষ ছিল জাতিগতভাবে তাতার। তবে সোভিয়েত শাসনামলে ক্রিমিয়ায় রুশভাষী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আজকের দিনে ক্রিমিয়ার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ জাতিগতভাবে রুশ।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ক্রিমিয়ার শাসনভার সরাসরি মস্কোর হাতে চলে আসে। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। ওই সময় রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। এ কারণে তখন বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঠিক এ সময় থেকে ঘটতে শুরু করে। ইউক্রেনের দাবি অনুযায়ী রাশিয়া সামরিক অভিযানের মাধ্যমে জোরপূর্বক ক্রিমিয়াকে তাদের ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার বক্তব্য হচ্ছে ক্রিমিয়া মূলত রাশিয়ার অংশ এবং প্রশাসনিক সুবিধার কারণে ১৯৫৪ সালে নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত করে। যেহেতু এখন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন দুটি পৃথক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, তাই রাশিয়া কেবল তাদের ভূমির ওপর অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ ছাড়া ক্রিমিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রুশভাষী হওয়ায় তারা ইউক্রেনের পরিবর্তে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বলে রাশিয়ার সরকার বারবার উল্লেখ করে আসছে।
ইউক্রেনের রাজনীতিকে সরলভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত নয়। প্রথমত, আজকের দিনে মানচিত্রে আমরা যে ইউক্রেনকে দেখতে পাই, সেটি অনেকাংশে কৃত্রিমভাবে নির্মিত একটি রাষ্ট্র। ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে রুশভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাজধানী কিয়েভ থেকে শুরু করে ইউক্রেনের বিভিন্ন অংশে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। অন্যদিকে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অনেক অঞ্চল একসময় পোল্যান্ডের অধীন ছিল। একইভাবে রোমানিয়া ও মোলদোভার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চল একসময় ঐতিহাসিকভাবে রোমানিয়ার অংশ ছিল। আর হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। এ কারণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একসময় বলেছিলেন, ‘Ukraine is not a true country.’ ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কোনো আসন পায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ইউক্রেনের অবস্থা অনেকটা এ ধরনের। গত নির্বাচনগুলোতে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোর বেশির ভাগ মানুষ রুশপন্থী সরকার এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকাগুলোর বেশির ভাগ মানুষ পশ্চিমা ঘরানার সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ইউক্রেনের রাজনৈতিক সংকটের সূচনা ঠিক এ জায়গা থেকে। ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ছিলেন ইউক্রেনের ইতিহাসের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট। ২০১৪ সালে তাঁকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে অপসারিত করা হয়। এর পর থেকে ইউক্রেনের রাজনীতিতে একচ্ছত্রভাবে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা উচিত, ইউক্রেন কিংবা জর্জিয়া—এই দুই রাষ্ট্রের কোনোটিকে জোরপূর্বক রাশিয়া দখল করেনি। একাধিক কারণে জর্জিয়ানরা রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের মুখাপেক্ষী ছিল। রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী এবং তারা নিজেদের অর্থোডক্স হিসেবে পরিচয় দেয়। একইভাবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন উভয় রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মও অর্থোডক্স খ্রিস্টানিটি। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব থেকে জর্জিয়াকে রক্ষা করতে বেশির ভাগ জর্জিয়ান রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের মুখাপেক্ষী হয়েছিল। জার সাম্রাজ্যের পতন–পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হলে জর্জিয়ানরা নিজেদের ইচ্ছায় সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে। একইভাবে ১৯২২ সালে গণভোটের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়। অথচ ইউক্রেন ও জর্জিয়ার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনেকে এসব ইতিহাস স্বীকার করতে চান না। আজকের দিনে আপনি যদি জর্জিয়া ও ইউক্রেন থেকে শুরু করে লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়ার তরুণ প্রজন্মের কোনো নাগরিকের কাছে আপনি সোভিয়েত শাসনামল সম্পর্কে জানতে চান, বেশির ভাগ একবাক্যে উত্তর দেবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তাদের ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। রাশিয়া তাদের নিকট অত্যাচারী ও দখলদারি শক্তি হিসেবে পরিগণিত।
পেট্রো পরোশেঙ্কোর শাসনামলে ইউক্রেনে কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। অ্যাজোভ ব্যাটালিয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ডানপন্থী গোষ্ঠী এ সময় ইউক্রেনের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেশটিতে বসবাসরত রুশভাষী জনসাধারণের ওপর তাঁরা বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার চালাত। ভ্লাদিমির পুতিন প্রশাসন এসব ডানপন্থী ও কট্টর জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীকে নব্য যুগের নাৎসি হিসেবে অভিহিত করেছেন। পেট্রো পোরশেঙ্কো ইউক্রেনে রুশ ভাষার চর্চাকে প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন। ২০১৯ সালে ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও পেট্রো পোরশেঙ্কোর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, যদিও রুশভাষীদের বিষয়ে তিনি ছিলেন কিছুটা নমনীয়।
রাশিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন—এই তিন রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ জাতিগতভাবে স্লাভিক হিসেবে পরিচিত। রুশ, বেলারুশিয়ান, ইউক্রেনিয়ান—এই তিন ভাষার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। ইউক্রেনের প্রায় সব মানুষ রুশ ভাষায় পারদর্শী, অনেকটা মাতৃভাষার মতো করে তারা রুশ ভাষা চর্চা করে। তাদের আলাদাভাবে স্কুলে গিয়ে এ ভাষা শিখতে হয় না। ইউক্রেনে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা জাতিগতভাবে ইউক্রেনিয়ান কিন্তু বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে তারা সর্বত্র রুশ ভাষায় কথা বলে। ইউক্রেনিয়ান ভাষার সঙ্গে তাদের সে ধরনের সখ্য নেই। ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে রুশ ভাষা ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে। এ ছাড়া এস্তোনিয়া, লাটভিয়া কিংবা লিথুয়ানিয়ার সাধারণ মানুষ যেভাবে দাবি করে থাকে যে সোভিয়েত শাসনামলে রাশিয়া তাদের সঙ্গে উপনিবেশের মতো আচরণ করত, ইউক্রেন কিংবা বেলারুশের নাগরিকদের পক্ষে এ ধরনের দাবি তোলার খুব একটা সুযোগ নেই। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সম্মিলিতভাবে যুক্তরাজ্যের অংশ হলেও সরাসরিভাবে কখনো এই দেশগুলোকে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ বলা যায় না। একইভাবে ইউক্রেন ও বেলারুশকেও লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া কিংবা এস্তোনিয়ার মতো রাশিয়ার উপনিবেশ বলার কোনো সুযোগ ছিল না।
সোভিয়েত শাসনামলে দেশটির ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে ইউক্রেন ও বেলারুশে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের তালিকা করলে মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ ও একাটেরিনবুর্গের পাশাপাশি কারখিভ, কিয়েভ ও মিনস্কের নাম আসত। রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ—এই তিন দেশকে একত্রে ‘থ্রি সিস্টারস’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ ছাড়া সোভিয়েত শাসনামলে ইউক্রেন ছিল অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী দেশগুলোর মধ্যে একটি। ইউক্রেনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, রাস্তাঘাট কিংবা বড় বড় শহরের অবকাঠামোর দিকে নজর দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে ইউক্রেনের যাত্রা খুব একটা সুখকর হয়নি। এ কারণে যে দেশটি একসময় পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই দেশ আজ ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি। তবে ইউক্রেনের অনেক সাধারণ মানুষ, বিশেষত সোভিয়েত শাসনামলকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা মনেপ্রাণে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন ও বেলারুশকে এক করে অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তিকালে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডার না যুক্তরাজ্যের কাছে ছিল, না ফ্রান্স, না চীনের কাছে। এটি ছিল ইউক্রেনের ভূমিতে। সোভিয়েত পতনের পর সদ্য স্বাধীন ইউক্রেন প্রায় পাঁচ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র পায়, যা মস্কো সেখানে জমা রেখেছিল। ওই সময় কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছে এর চেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্র ছিল। বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামের মধ্য দিয়ে মস্কো এসব পারমাণবিক অস্ত্র তাদের কাছে নিয়ে যায়।....চলবে
****আগামীকাল পড়ুন তৃতীয় কিস্তি
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া