বীথি: পর্ব ২৩
বীথি,
হাঁড়িতে দুধ বলগ তুলছিলাম, তখুনি মাথায় কথাগুলো ঘুরপাক করছিল। ভাবলাম, লিখতে বসে যাই। বল তো বীথি, দুধ ঠিকভাবে জ্বাল হওয়ার আগেই যদি দুধ চুলা থেকে নামিয়ে ফেলিস, তাহলে কি সেই দুধ আর বলগ ওঠা দুধ দেখতে এক রকম লাগে?
আমার কাছে মেয়েদের জীবনটা বেশ অদ্ভুত লাগে জানিস! নিজে মেয়ে বলেই কিনা জানি না, মনে হয় একটা মেয়েকে ভালোভাবে জানলে পুরো একটা দেশ দেখতে পাওয়া যায়। বলেছি তোকে। গতকাল আমার একটা দোভাষীর কাজ ছিল। এই শহরে কয়েকটা কাজ করলে মানুষ বা সমাজ নিয়ে আর কোনো কনফিউশন থাকবে না। তার ভেতর অন্যতম কাজ হচ্ছে দোভাষীর কাজ। গল্পটা তোকে বলি তাহলে, শোন।
নাসিমা বাংলাদেশ থেকে এসেছে মাত্র ৩ বছর আগে, কিন্তু বিয়ে হয়েছে ১১ বছর আগে। এত দিনে স্বামী স্পনসর করে এনেছে নাসিমাকে কানাডায়। কিন্তু বাংলাদেশে থাকতেই নাসিমার দুই সন্তান হয়। বড়জন ১০ বছরের, ছোটজন ৮ বছর।
নাসিমা যখন বিয়ে করে, তখন ওর বয়স ১৭ বছর। মাত্র এক বছরের মাথায় নাসিমার প্রথম সন্তান হয়, তখন নাকি ও সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পেছনে কোমরে ব্যথা পায়। এরপর নাসিমার ২য় সন্তান হয় আর মাত্র ৩ বছর আগে নাসিমা কানাডায় আসে। এখানে আসার পর কোমরের ব্যথা আরও বাড়ে এবং এটা এখন এমন পর্যায়ে আছে যে নাসিমা এ দেশে ডিজঅ্যাবল প্রোগ্রামে আবেদন করেছে। কানাডায় এই প্রোগ্রামের নাম ‘অন্টারিও ডিজঅ্যাবল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম’।
ব্যাপারগুলো হড়হড় করে যেভাবে বলে যাচ্ছি, বাস্তবে কিন্তু ঠিক তার উল্টো। কারণ, এ ধরনের প্রোগ্রামে এলিজিবল বা যোগ্য হওয়ার জন্য যা যা করতে হবে, যেসব কাগজপত্র আর প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে এবং তোর যত কাগজপত্র ওরা যাচাই করবে, তখন তোর হয়তো মনে হবে, ভিক্ষা চাই না, মা, কুত্তা তাড়া।
কানাডায় কেবল বাংলাদেশিরা নয়, পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই এসব প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কারণ, তিন–চার বছর চেষ্টা করে যদি বাকি জীবন বসে খাওয়া যায়, মন্দ কী বল?
জীবনের নিরাপত্তা এবং মাস গেলে দুটো বাঁধাধরা ডলারের কাছে তো বাকি অনেক হিসাব তুচ্ছ, তা–ই না? নাসিমাকে নিয়ে এসেছিল স্বামী রুবেল। গতকাল আইনজীবীর সামনে এই সেশনের দোভাষী ছিলাম আমি। নাসিমার কথা ইংরেজিতে আইনজীবীকে বলেছি আর তাঁর কথা নাসিমাকে বাংলায় বলেছি।
এই কাজ করার জন্য ২০০৯ সালে মাত্র ২০০০ ডলার খরচ করে নাইয়াকে বেবিসিটারের বাসায় রেখে কোর্স করেছিলাম, ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তোকে বলছি, কারণ, তুই যদি ভাবিস যে কথা বললাম আর ডলার পেলাম, ঘটনা সেটাও নয়।
যাহোক, নাসিমা আর রুবেলের সামনে বসেই আইনজীবী একই প্রশ্ন বারকয়েক করে জানাল যে নাসিমার কেসটা অনেক দুর্বল। নাসিমা যা বলছে আর যেসব কাগজ জমা দিয়েছে, তার ভেতর বড় বড় ফাঁক আছে। আর সে কারণেই একবার ওদের আবেদন বাতিল হয়েছে কিন্তু ওরা আবার কোর্টে আবেদন করেছে।
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। নাসিমাকে চারটা বড় অসুখ দেখাতে হয়েছে এই প্রোগ্রামে আবেদন করার জন্য। মাত্র তিন বছর আগে কানাডায় এসেই নাসিমা মানসিকভাবে ভারসম্যহীন হয়ে পড়েছে, কারণ, নাসিমা যে জীবনের স্বপ্ন বাংলাদেশে বসে দেখেছিল, স্বামী কানাডায় থেকে অনেক বিশাল কিছু করছে, সেখানেই নাসিমা অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে। নাসিমা এ দেশে আসার পর প্রথম কয়েক মাসেই বুঝতে পেরেছে যে কত বড় অপদার্থকে ওর জীবনের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে ওর মা–বাবা। কেবল কানাডায় থাকে, এই বিশ্বাসকে সম্বল করে।
আবার বলছি, বীথি, আমার লেখা পড়ে ভুল বুঝবি না। কানাডা বা আমেরিকায় শুধু নাসিমা বা রুবেলরা থাকে না, এখানে এমন বাঙালিও থাকে, যারা যেকোনো বিদেশিকে তুড়ি মেরে নিজেরা শীর্ষ স্থান দখল করেছে বারবার।
এমন বাঙালি মেয়েকেও চিনি যে এ শহরে মাত্র একটা প্রফেশনাল চাকরিতে আবেদন করেছে এবং সেটা একবারেই পেয়েছে। সেই একই মেয়েকে এই দেশের কলেজশিক্ষকেরা ডেকে বলেছে, ‘তুমি ক্লাস নাও না কেন?’ সুতরাং সমাজে সবই আছে, ভালো–মন্দ সব।
কিন্তু ওই যে, যার যার কাজের ক্ষেত্র যেটা। একবার এক দাঁতের চিকিৎসক বলেছিলেন, ‘দেখুন লুনা, আমি যেহেতু সারা দিন মানুষের দাঁতের সমস্যা নিয়ে কাজ করি, তাই আমার মনে হয়, সবার দাঁতে সমস্যা।
তেমনি, লুনা, আপনার মনে হয়, সবার জীবনেই কেবলই সমস্যা। কারণ, আপনি কাজ করেন এখানেই, এসব বিষয় নিয়েই।’ হয়তো তা–ই বীথি।
গতকাল নাসিমাকে দেখে ভাবলাম, কী চেয়েছিল নাসিমা? স্বামী/বাচ্চা নিয়ে কানাডার মতো দেশে এসে সুখে সংসার করবে? মনে করেছিল, স্বামী কানাডা জয় করে ফেলেছে ১৫ বছরে, তারপর রাজরানি করে নাসিমাকে নিয়ে এসেছে?
নাসিমা কি নিজেকে বিন্দুমাত্র প্রস্তুত করেছিল এই সুখের জীবন পাওয়ার জন্য? নাকি মনে করেছিল যে বিয়েই তো হয়েছে নাসিমার, মেয়ে হিসেবে এর চেয়ে বড় যোগ্যতা আর কী আছে?
অবাক লাগে, বীথি। এখনো আজকের যুগেও যেসব মেয়ে ভাবে, আমার স্বামী, ভাত–কাপড় দেবে, সন্তানের লালনপালনের জন্য টাকা দেবে, এসবই তো স্বামীর কাজ, তা–ই না, তাহলে সেই স্বামী নাসিমাকে দুটো লাথি মারবে, সেটাও তো তাকে সইতে হবে, তাই না?
প্রত্যেক মেয়ে নিজেকে পুরোপুরি অর্থনৈতিক ও যোগ্যতার দিক থেকে তৈরি করেই বিয়ে করবে। যাতে ভাত–কাপড়ের দায়ে আর সন্তানকে টানার দায়ে সংসারে থেকে যেতে না হয়। যে মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়, তাকে এটাও শিখতে হবে নিজ দায়িত্বে কি করে সন্তান বড় করতে হবে।
দুর্ভাগ্য, আজ নাসিমা দেখতে পাচ্ছে, মাত্র তিন বছরের মাথায় নাসিমাকেই রোগী করে রুবেল এই দেশে আরও দুটো ডলার পাওয়ার আশায় গল্প সাজিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। জীবনের কী এক বিচিত্র খেলা, বীথি! মানুষ কী ভাবে আর কিসের সাথে যে যুদ্ধ করে! কোনটা চেয়েছিল নাসিমা, উত্তর কি মানুষ নিজেই জানে? চলবে...
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com