বীথি: পর্ব ২৬
বীথি,
মাঝে কয়েক দিন হাড় কাঁপুনি শীতের বাতাস ছিল এই শহরে। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে দেখি দুধকুচি বরফ দিয়ে ছেয়ে আছে পথ। ভীষণ আস্তে আস্তে চলছে পাবলিক বাসগুলো। আমার মনে হয়, এসব দেশে যখন জনসাধারণের জন্য কোনো চালক ভাড়া করা হয়, তখন কার কত পেশেন্স আছে তা টেস্ট করা হয়; না হলে বাসচালকেরা এত পেশেন্স পান কোথায়?
এই দেশে মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কোনো সম্পদ নেই। যত বড় বিপদ হোক, যত বড় ঘটনাই ঘটুক—ওদের প্রথম প্রশ্ন, আর ইউ ওকে? আর ইউ সেভ?
লম্বা পথে বাস জার্নি করি প্রতিদিন। সারা পথ নানান ভাবনা জড়িয়ে থাকে, যার ৯৯ ভাগ অতীত নিয়ে, ফেলে আসা দেশ নিয়ে, মানুষকে নিয়ে। ইদানীং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। বারবার দোয়া করার সময় আল্লাহকে বলি, আল্লাহ তুমি সাহস দাও, যেন পিছপা না হই, যেন মাথা উঁচু রাখতে পারি। জানিস কেন বলি এসব কথা? বিদেশে না এলে গোটা জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। মানুষ কী করে সত্যিকার জীবনকে জয় করে বাঁচতে পারে, সেটা দেশে থাকলে কোনোদিন জানা হতো না। যদিও দেশেও আয়–রোজগার করতাম। কিন্তু সত্যিকার একা বাঁচার অর্থ মানুষ কেবল বিদেশে এলেই জানতে পারে।
সেই ভোর সাড়ে পাঁচটায় বের হয়েছিলাম। ঘোর অন্ধকার থাকতে যখন নিজের বাসায় বাইরে থেকে তালা লাগাই, তখন ১৫ বছরের একমাত্র ছেলে ঘুমে। তালা লাগানোর সময় আবার বিড়বিড় করে সুরা পড়ি।
আসলে কি জানিস—নামাজ পড়া তো অনেকটাই সোজা, কঠিন কাজ হচ্ছে সৎ থাকা। সেখানে যুদ্ধ করতে হয় নিজের রিপুর সঙ্গে। যা হোক, আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হলো বেশ, পথে অনেক ভোগান্তি হয়েছে। বাসায় ফিরে দেখি নাইয়াও দেরি করে বাসায় এসেছে। ছেলে খুব ক্লান্ত। আমাকে বলছে—মা, আজ তোমার কাছে শোব। কিন্তু আমি আজ প্ল্যান করে এসেছি—কাল যেহেতু একটু দেরি করে অফিসে যাব, তাই আজ তোকে লিখব, লিখবই। সেই প্ল্যান আনুযায়ী প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার জার্নি শেষ করে বাড়ি ফিরে, গোসল–নামাজ শেষে টেবিলে বসলাম। এক হাত দূরেই নাইয়া কাদা হয়ে ঘুমিয়ে আছে—ছেলের মুখের দিকে তাকাই, তাকাই নিজের এই প্রিয় ঘরের দিকে, নিজের জীবনের দিকে। ভাবি—আমি কি কোনোদিন জানতাম, জীবন আমাকে এখানে এনে ঠেকাবে? কেউ কি আমরা সত্যই জানি, নিজেদের জীবনের কথা?
জানিস বীথি, ইচ্ছা করছে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষকে বলি—শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ বইটা পড়তে। কী অসম্ভব ভালো একটা বই লিখেছেন মুন্না ভাই। বইটার প্রতিটা লাইন পড়লে মনে হয়—এই আমার জন্ম? এই আমার ইতিহাস? এই আমার দেশ? আর এই আমাদের জন্মের কথা? কোথায় বসে গর্ব করি আমরা বাঙালি জাতি? কী ভীষণ অকৃতজ্ঞ আমাদের জাতির ইতিহাস?
বইটা পড়তে পড়তে ভাবি—লুৎফা তাহের কি কোনোদিন মন থেকে এই জাতিকে ক্ষমা করবে? অবিশ্বাস আর অবিচারের ছায়া লেগে আছে তাহেরের গোটা পরিবারের মনে? এই কি চেয়েছিল তাহের? গোটা বইটা মুন্নাভাই ছোট ছোট শিরোনামে লিখছেন—আজকে এবং গতকাল সারাক্ষণ বইটার ভেতরে মুখ গুঁজে আছি আর ভাবছি নিজের ইতিহাসের কথা। কী ভীষণ এক সাহসী যুদ্ধ হয়েছিল আমাদের দেশে, কী অস্বাভাবিক শক্তি আর সাহস নিয়ে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নিজের নাম লিখিয়েছিল। অথচ আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা অসৎ মানুষ আর দুর্নীতি।
এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই যেহেতু রাজনীতি শেষ হয় না, তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইতিহাস জানবে কবে? কে বলে ইতিহাস ভুলে যেতে হবে? আমি আমার অতীত ভুলে গেলে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব কোন শক্তি দিয়ে? বাংলাদশে কি একজন বাবা, একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন সন্তান নেই—যারা তাদের পরিবারের অসৎ মানুষকে ধিক্কার দিয়ে বলতে পারে, তোমার অন্যায়কে আমি সহ্য করব না। আমি নিজে মেয়ে বলেই ভাবি, কোনো স্ত্রী কি কোনো স্বামীকে বলতে পারে না—তোমার চুরির টাকা সংসারে প্রবেশ করার আগে আমি তোমাকে পুলিশে দিতে চাই। কেন পারে না আমার দেশের মানুষ?
বীথি, টরন্টো শহর যখন তুষারে ঢাকা, বাস চলছে কি চলছে না, আশপাশে জবুথবু মানুষেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে— আমার হাতে তখন ‘ক্রাচের কর্নেল’ বই। আমি তখন মুক্তিযুদ্ধের মাঠে। কখনো নিজেকে ভাবি লুতফা তাহের, ভাবি—নিজেই যেন দেখছি কর্নেল তাহেরকে, ভাবতে অবাক লাগে। কর্নেল তাহেরের ছেলে মিশুকে দেখেছি অল্প কয়েক মাস। আমি তখন ব্র্যাকে কাজ করি। মিশুর সঙ্গে কাজ করত বিদেশি দুটি মেয়ে। আমার বিভাগেরই জুনিয়র ছেলে মিশু, একদিন গিয়েছিল আমাদের ধানমন্ডির বাসায়। সেদিন খুব সাদামাটাভাবে জানতাম মিশু কর্নেল তাহেরের ছেলে। কিন্তু তাহের যে বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় ভূমিকা রেখেছে সেটা জানতেই পারতাম না ‘ক্রাচের কর্নেল’ না পড়লে। দেশে একসময় গ্রামে গ্রামে কাজ করতাম। আজ অনেকটা পথ পেছনে ফেলে এসেছি—হয়তো ফিরে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু জানিস তো বীথি, জীবনে যা পেয়ে হারায় মানুষ, সেই বেদনাই বয়ে বেড়ায় সে বাকি জীবন। বিশেষ করে যারা প্রবাসে থাকে। এই যে প্রতিটা লেখায় দেশ নিয়ে এত এত ক্ষোভ করি, কেন জানিস? মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকেই বেশি করে আক্রমণ করে, যার জন্য বেশি প্রাণ পোড়ে তাকেই বেশি গালিগালাজ করে। তাকেই বুকের ভেতরে ধারণ করে সবচেয়ে বেশি, যে দেশে থাকতে পারিনি বলে বিদেশ এসেছি, ডলার উপার্জন করি, ভালো থাকার জন্য প্রাণপাত করি। সেই বিদেশে বসে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই নিজের দেশের জন্য, সময় সময় নিজেকে নিমকহারাম মনে হয়। ভাবি আমার দেশের মানুষ অন্যায়–অবিচারের সঙ্গে লড়ছে, আর আমি স্বার্থপরের মতো দূরে থেকে শুধু নিজের সুখকে নিশ্চিত করছি। এই ভালো থাকার মতো দোজখের দরকার নেই, আমার মতো লোভী আর কে আছে বল?
ওপরের লেখায় বলছিলাম, নাইয়া আমার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে—লেখা শেষ করে দেখি নাইয়া কেমন গোঁ গোঁ শব্দ করছে ঘুমের ভেতরে। ওর পাশে গিয়ে শুতেই দেখি জ্বর গায়ে। কাল রাতে নেটে প্রবলেমের কারণে লেখা আপলোড করতে পারিনি। এখন ভোর ৬টা। বাবুর এখনো জ্বর, কিন্তু অফিসে আমার যেতেই হবে। কী করি বীথি? সারা শহরে একজন মানুষ নেই যাকে বলতে পারি নাইয়ার কাছে এসে বসবে। কেন যে কেউ নিজের কাজ ফেলে আসবে আমার বাসায়? আমি কি যেতাম হুট করে কারও কাজে আমার নিজের কাজ ফেলে? সেই এক ভাবনা, প্রবাস জীবন কী যে মধুর, শুধু যাঁরা থাকেন, তাঁরাই জানেন—তবু জীবন চলবে এবং সব সামলে আবার ঝকঝকে রোদ উঠবে এই শহরেই। বরফের এই ঘোরলাগা অন্ধকার দিন সরে যাবে সহসাই।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]