বিয়ের চাপ–৫ম পর্ব

বিয়ে
ফাইল ছবি

তিন–তিনবার কল দেওয়ার পরও মলি ফোন রিসিভ করল না। বাধ্য হয়ে আমরা কলেজের অফিসে চলে এলাম। খবর নিয়ে জানলাম মলি ক্লাস নিচ্ছে। অফিস থেকে আমাদের বলা হলো অপেক্ষা করতে। হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো শিক্ষক মলিকে একটু দেখার। কলেজের একজনের সহায়তায় শ্রেণিকক্ষটি খুঁজে বের করলাম। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম মলি ক্লাস নিচ্ছে। মলি শাড়ি পরে আছে। মুখে এক আকাশ হাসি। ওকে পরির মতো লাগছে। মলিকে দেখে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তুই এই মেয়েটিকে বিয়ে না করে কীভাবে পালালি?
হঠাৎ করেই মলির চোখ পড়ল আমাদের দিকে। সে দরজার বাইরে এসে ভুরু কুঁচকে বলল,
—কী ব্যাপার দুলাভাই, আপনারা এখানে? বাবা ভালো আছেন তো?
—না না, বাবা ভালো আছেন। আসলে একটা বিশেষ কারণে রামগড় এসেছি।
—তাই নাকি? কী সেটা?
—ভাবছি রামগড়ে একটা ব্যবসা খুলব। তাই এলাকাটা একটু সার্ভে করতে এলাম। আচ্ছা, এখানে কী ধরনের ব্যবসা করলে ভালো চলবে, তোমার কি কোনো আইডিয়া আছে?
—না দুলাভাই, আমি ব্যবসা ভালো বুঝি না।
—শোনো রাস্তা দিয়ে আসার সময় দেখলাম রামগড়ে প্রচুর কাঁঠালের গাছ। ভাবছি কাঁঠালের ব্যবসা করব। বলো তো কেমন হবে?
—হি হি হি…দুলাভাই আপনার ফান আর গেল না। অবশ্য যাওয়ার দরকারও নেই। আপনি যেমন আছেন তেমনি ভালো। তা আপনার কবিরা কেমন আছেন? তারা এখন কিছু বলে না?
—সেটা তো সব সময় বলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পাবলিকে আমার ওপর বিরক্ত হয়ে গেছে। তাদের ধারণা, আমি নাকি বেশি বেশি করছি। মামি আর খালু তো পারলে আমারে যখন তখন মাইর দেয়। বুঝলা মানুষ সাহিত্যের দাম দিল না। তা তোমার ক্লাস কি শেষ? শেষ হলে বের হয়ে আসো চলো আড্ডা দিই, কথা বলি।
—না দুলাভাই ক্লাস এখনো শেষ হয়নি। তা দুলাভাই আপনারা কোথায় উঠেছেন? আজ কি থাকবেন নাকি চলে যাবেন?
—হোটেলে উঠেছি। শুধু আজ না, বেশ কয়েক দিন থাকব। তবে কতদিন থাকব, সেটা জানি না। ও আরেকটা কথা, ওকে তো তুমি চেনো তাই না? ওর নাম দীপু। হা হা হা…
—দুলাভাই এক কাজ করেন। আপনারা এখন হোটেলে চলে যান। হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম করেন। বিকেলে আমরা মৈত্রী ব্রিজে ঘুরতে যাব। তখন কথা হবে। আমি এদিকে ক্লাসগুলো শেষ করে আসি।
—ওকে ওকে, তুমি আগে তোমার কাজ শেষ করো। কবি বলেছেন, না থাক কবির কথা আর বলব না। পাবলিক মাইর দেবে। হা হা হা…।

আরও পড়ুন

আমরা কলেজ থেকে চলে এলাম। পুরো সময়ে মলি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকাল না, বা আমার সঙ্গে একটি কথাও বলল না। বুঝলাম, সে আমার ওপর এখনো রেগে আছে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।
বিকেলবেলা আমরা ইন্দো-বাংলা মৈত্রী সেতুর কাছে এলাম। সেতুটি ফেনী নদীর ওপর। যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসংযোগ স্থাপন করেছে। জায়গাটি খুবই সুন্দর।
মলি নীল একটা শাড়ি পরে এসেছে। ফেনী নদীর এলোমেলো বাতাসে ওর খোলা চুলগুলো বারবার ওর মুখের ওপর এসে পড়ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো অপ্সরীকে দেখছি। দুলাভাই কৌশলে আমাদের একা রেখে সরে পড়লেন।
আমরা চুপচাপ বসে আছি অনেকক্ষণ। একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিও না, কথাও বলছি না। প্রায় ১০ মিনিট পর আমি প্রথম কথা বললাম,
—আচ্ছা এই নদীটির নাম কী?
—ফেনী নদী।
—কিন্তু এ জায়গার নাম তো রামগড়। সেই হিসেবে এর নদীর নাম রামগড় নদী হলে ভালো হতো, তাই না?
মলি আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
—আচ্ছা আপনি কি এই সেতু থেকে কখনো নদীতে লাফ দিয়েছেন?
মলি এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দিল না। এমনকি আমার দিকে তাকালও না। আমরা আবার চুপ করে বসে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি আবার প্রশ্ন করলাম,
—আপনি কলেজে কোনো বিষয় পড়ান?
—বাংলা।
—তাই নাকি?
—জানেন আমার না বাংলা বানান খুবই ভুল হয়। আপনারও কি বানান ভুল হয়?
—আচ্ছা আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন? বোকার মতো উল্টাপাল্টা প্রশ্ন না করে কী বলবেন সরাসরি বলে ফেলেন।
—আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমাকে কি ক্ষমা করা যায়? অবশ্য আমি যা করেছি, তাতে আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো অধিকার নেই। তারপরও আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
—আমি আসলে ওসব নিয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।
—আমি জানি বিষয়টি আপনার জন্য বিব্রতকর ছিল। আপনাকে এবং আপনার–আমার দুই পরিবারকেই আমি মানুষের কাছে ছোট করেছি।
—কে ছোট হলো, কাকে ছোট করলেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, আপনি নিজ হাতে আপনার বাবাকে পঙ্গু করে দিয়েছেন। উনি মারাও যেতে পারতেন।
—আমি জানি। আমি আসলে বোকার মতো, আমি যে মেরুদণ্ডহীন নই, তা প্রমাণ করতেই এমনটি করেছি।
—বুঝিনি।

আরও পড়ুন
বিয়ে
প্রতীকী ছবি

—আসলে প্রথম থেকেই বিয়ে নিয়ে আমি একটু কনফিউজড ছিলাম। তার ওপর আপনার উল্টাপাল্টা কারবার দেখে আমি খুবই বিরক্ত হয়ে পড়ি। আমার অবস্থা দেখে আমার মামাতো বোন আমাকে একদিন বললেন, তুই তো মেরুদণ্ডহীন? একটা মেয়ে তোকে নিয়ে খেলছে আর তুই তা সহ্য করছিস? মেয়েটিকে ধরে কষে একটা চড় দিতে পারিস না? তুই যে পুরুষ সেটা ওকে বুঝিয়ে দে।
মলি চুপচাপ আমার কথা শুনল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
—উনি তো আপনাকে থাপ্পড় মারতে বলেছিলেন। তা আপনি থাপ্পড় না মেরে পালালেন কেন?
—আসলে মেয়েদের গায়ে হাত তোলাকে আমি কাপুরুষতা মনে করি। যত যা–ই ঘটুক, একজন পুরুষ একটা মেয়ের গায়ে কোনোভাবেই হাত তুলতে পারে না। এটা শিক্ষার সঙ্গে যায় না।
—আচ্ছা আপনি যে আমার আচরণে বিরক্ত হচ্ছিলেন, তা আমাকে বললেই তো পারতেন। আমি তো শুধু ফান করার জন্য মজাগুলো করেছিলাম। মানুষ কি বিয়েশাদিতে ফান করে না? সে জন্য আপনি বিয়ে না করে পালাবেন?
—সরি। বিষয়টি ঠিক হয়নি, সেটা যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি।
—সরি বলার দরকার নেই। যেটা হবার সেটা তো হয়ে গেছে। এখন এই নিয়ে আমরা আর কথা না বলি।
—আপনি আসলেই অসাধারণ একটা মেয়ে।
—কেন এ কথা বলছেন? আমি আপনার বাবার সেবা করেছি বলে এ কথা বলছেন?
এ সময় দুলাভাই চলে এল। এসেই বলল,
—মলি, বোন আমি তো একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছি।
—কী ঘটিয়েছেন দুলাভাই?
—এত সুন্দর পরিবেশ দেখে আমি আমার স্ত্রীকে মনে করে একটা কবিতা লিখে ফেলেছি।
—তাই নাকি? শোনান তো।
দুলাভাই দুবার খুকখুক করে কেশে যাত্রার ঢঙে বলতে শুরু করলেন।
“পপি আমার পপি,
আমি তোমার স্বামী।
নদীর নাম ফেনী,
পপি আমি তোমায় ভালোবাসি।
রামগড়ে আছে পাহাড়,
পাহাড়ে অনেক বান্দর,
পপি আমার পপি
তুমি আমার স্ত্রী।
দুলাভাইয়ের কবিতা পাঠ শেষ হতেই আমি বললাম,
—দুলাভাই সিরিয়াসলি? এটা কোনো কবিতা? কথা, ছন্দ কোনো কিছুর মিলই তো নাই। আর কী যে বলতে চাইলেন সেটাই তো বুঝলাম না।
—শোনো মিয়া, মিলটা বড় বিষয় না। ভাবটাই হলো আসল। আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে অন্য কবির লেখা থেকে আর উদাহরণ দেব না। এখন থেকে নিজের লেখা কবিতা দিয়ে উদাহরণ দেব। আমি যে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, তা মানুষকে বুঝিয়ে দেব। দাঁড়াও এইমাত্র আরও একটা কবিতা মাথায় এসেছে, এখানে ছন্দের মিল পাবা।
“পাহাড়ে পাহাড়ে গাছ
গাছে গাছে কাঁঠাল,
কাঁঠাল অনেক মিষ্টি
পপি আমার স্ত্রী।”

আরও পড়ুন

দুলাভাইয়ের উদ্ভট কবিতা শুনে মলি খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলল,
—দুলাভাই জোস। আপনি আসলেই এক প্রতিভা।
মলি হাসছে আর কথা বলছে। আমি অবাক হয়ে মলির হাসি দেখছি আর ভাবছি, এই মেয়েটি এত সুন্দর করে হাসে কীভাবে?
বিকেলবেলাটা এভাবে বেশ মজা করেই কাটছিল। হঠাৎ করেই মলি বলল,
—দুলাভাই আমাকে এখন উঠতে হবে।
—বলো কী? মাত্রই তো এলাম। আমরা আরও আড্ডা দেব। তোমাকে আমার আরও কিছু কবিতা শোনাব। তারপর গিয়ে কোথাও তিনজনে মিলে ডিনার করব।
—দুলাভাই আপনারা তো আরও কয়েক দিন আছেনই। কাল বা পরশু সেটা করা যাবে। আজ আসলেই আমাকে উঠতে হবে।
—কেন?
—আসলে আজ আমার এক কলিগের মায়ের জন্মদিন। ওনার মা আমাকে অনেক আদর করেন। বলতে পারেন এ শহরে তারাই আমাকে দেখে রেখেছেন, আগলে রেখেছেন।
—তাহলে তো করার কিছু নেই। ঠিক আছে চলো, তুমি গিয়ে পার্টি করো, আর আমরা গিয়ে হোটেলে চুপচাপ বন্দী হয়ে থাকি। হা হা হা…।
—বন্দী থাকবেন কেন? আপনারা শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখেন।
—এই শহরের কিছুই তো চিনি না। কোথায় ঘুরব?
—তাহলে এক কাজ করেন, আপনারাও আমার সঙ্গে পার্টিতে চলেন। যাবেন?
—অবশ্যই। তাহলে তো ভালোই হয়। দীপু তোমার সঙ্গে আরও কিছুটা সময় কাটাতে পারবে। আর আমিও পার্টিতে আসা লোকজনের সঙ্গে ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করতে পারব।
—দুলাভাই, আচ্ছা হঠাৎ করে আপনার রামগড়ে ব্যবসা করার ইচ্ছে হলো কেন?
—এটা আসলে দীপুর প্ল্যান। ও চাইছে এই শহরে বসবাস করতে।
এই কথা শোনামাত্রই মলি আমার দিকে তাকাল। এখানে আসার পর এই প্রথম সে আমার চোখে চোখ রাখল। কী গভীর সেই দৃষ্টি। মনে হলো সে আমার ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে।
অনুষ্ঠানটি একেবারেই ঘরোয়া। আমরাসহ জনা বিশেক মানুষ উপস্থিত হয়েছেন এই অনুষ্ঠানে। আমি ভেবেছিলাম, মলির কলিগটি একজন মহিলা। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, সে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ। তার নাম জয়। তিনি রামগড় কলেজে ইংরেজি পড়ান।

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

জন্মদিনের কেক কাটার পর জয়ের মা, মলিকে প্রথম কেকটি খাওয়ালেন। এরপর নিজের ছেলেকে কেক খাওয়ালেন। কিন্তু এরপরই যা ঘটল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করেই জয় সবার উদ্দেশে বললেন,
—আজ আমার মায়ের জন্মদিন। এই বিশেষ দিনে, আমি আমার মাকে একটি মূল্যবান উপহার দিতে চাই। আমি জানি এটি হবে আমার মায়ের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।
এরপর জয় তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
—মা, গতকাল আমি মলিকে প্রোপোজ করেছি। ও হ্যাঁ বলেছে।
—বলিস কী? তুই তো আমাকে কিছু বলিসনি।
—বলিনি, কারণ তোমার জন্মদিনে তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে।
জয়ের মা মলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম মলির মুখে মলিন হাসি। সে হাসিতে কোনো প্রাণ নেই। জয় তার পকেট থেকে একটি আংটি বের করে মায়ের হাতে দিলেন। ভদ্রমহিলা খুব যত্ন নিয়ে মলির হাতে আংটিটি পরিয়ে দিলেন। খেয়াল করলাম মলির হাত একটু একটু কাঁপছে। কী জানি, এটা আমার চোখের ভুলও হতে পারে। উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে ওদের অভিনন্দন জানাল। আমিও অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে হাততালি দিলাম। দেখলাম, দুলাভাই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার ধারণা তিনি এখন মনে মনে উদ্ভট কোনো বিরহের কবিতা লিখছেন।
ঠিক করলাম কাল সকালেই রামগড় থেকে চলে যাব। কারণ, রামগড়ে পড়ে থাকার আর কোনো মানে নেই। মলির আকাশে এখন আমি নই, এখন অন্য কেউ ঘুড়ি হয়ে উড়ছে।
পরদিন আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। মলি আর জয় দুজনেই বাসস্ট্যান্ডে এসেছেন আমাদের বিদায় দিতে। জয় আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
—কেন?
—আপনি যদি না পালাতেন, তাহলে এই অসাধারণ মেয়েটিকে কি আমি পেতাম? জানেন ওকে যখন আমাদের কলেজে প্রথম দেখি, তখনই আমি ফিদা হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে প্রপোজ করেছিলাম। কিন্তু ও রাজি হয়নি। কারণ ওর ইচ্ছে ছিল পারিবারিক মতেই অচেনা কাউকে বিয়ে করবে। তবে এবার আপনার সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর, ও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। শোনেন, আপনি কিন্তু আমাদের বিয়ের প্রথম অতিথি হবেন। বিয়ের প্রথম কার্ডটা আপনিই পাবেন।
—আপনারা কি বিয়ের দিনও ঠিক করে ফেলেছেন?
—না, তা ঠিক করিনি। তবে বেশি দেরি করব না। আপনি আসবেন তো আমাদের বিয়েতে?
—না, আসব না।
—কেন আসবেন না? মলি শুনেছ দীপু ভাই কী বলছে? উনি নাকি আমাদের বিয়েতে আসবেন না।
মলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
—কেন আসবেন না?
—কারণ সেদিন আমি নিজেও বিয়ে করব।
জয় উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
—সত্যি বলছেন দীপু ভাই?
—জি সত্য বলছি। যেদিন আপনারা বিয়ে করবেন, ঠিক সেদিনই আমি বিয়ে করব। হা হা হা…
মলি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

বাস ছেড়ে দিয়েছে। মলি আর জয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। আমি জানালা দিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাস ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। মলি নামের সুন্দর মেয়েটি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। একসময় ছোট হতে হতে ওরা আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
জানি না, হঠাৎ করেই আমি কেমন জানি অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছি। মলির জন্য আমার একটুও খারাপ লাগছে না, কান্নাও পাচ্ছে না। দুলাভাই আমাকে বলল,
—দীপু, তোমার কি মলির জন্য খুব খারাপ লাগছে?
—সম্ভবত না।
—তোমার কি ডাইল বা রঙিন পানি কিছু খেতে মন চাচ্ছে?
—মানে কী?
—না, অনেকে ভালোবাসা বা প্রেমে ব্যর্থ হলে এসব খায়। সেখানে তোমার তো সম্ভাব্য বউই চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, তোমার কি এখন চন্দ্রমুখীর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে?
—এটা আবার কে?
—শোনো, দেবদাস ছ্যাঁকা খেয়ে চন্দ্রমুখীর কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। তুমি চাইলে আমি তোমাকে একজন চন্দ্রমুখীর ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কী দেব?
—দুলাভাই আপনি তো দেখি আমাকে জোর করে নষ্ট করার ধান্দায় আছেন।
—এটা কী বললা? আমি তোমার কষ্টে সমব্যথী হয়ে তা লাঘবের চেষ্টা করছি। আর তুমি আমাকে খারাপ ভাবছ? শোনো কষ্ট পেয়ো না। কোনো কিছুতেই জীবন থেমে থাকে না।
—দুলাভাই আমি কষ্ট পাচ্ছি না।
—বুঝছি তুমি অধিক শোকে ভোঁতা হয়ে গেছ। আচ্ছা এক কাজ করি মলিকে বরং গুন্ডা দিয়ে তুলে নিয়ে আসি?
—দুলাভাই আপনার সমস্যা কী? আপনি এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা কেন করছেন?
—শোনো, যেই মেয়েরে এতগুলা টাকার হলুদ কিইন্না লাগাইলাম। সেই মেয়ে অন্য পোলারে বিয়া করব এটা কি মানা যায়? তুমি জানো হলুদগুলা নিউমার্কেট থেকে বাইছা বাইছা আমি কিনে আনছি। আমার কষ্টটা তুমি একটু বুঝবা না?

আমি দুলাভাইয়ের কথার কোনো উত্তর দিলাম না। আমি আবার জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। মনে হলো ওই দূরের পাহাড়গুলো আমাকে ডাকছে। একটু পরেই দুলাভাই বললেন,
—তুমি বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখো। আর আমার কবিতা শোনো। আমি এইমাত্র একটা বিরহের কবিতা লিখে ফেলছি। শুনে একটু কাঁদার চেষ্টা করো, এতে তোমার মনটা হালকা হবে।
এ কথা বলেই দুলাভাই কবিতা বলা শুরু করলেন,
বেঁচে আছি যত দিন,
কাঁঠাল খাব তত দিন।
চোখের পানির চেয়ে
ফুচকার টক বেশি দামি।
বুকের মধ্যে কান্না নড়াচড়া করছে,
ঠিক যেমন মুখের ভিতর
ফুচকার টক নড়াচড়া করে।’
দুলাভাইয়ের ফালতু কবিতা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি মাথা এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে, ভুরু কুঁচকে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। দুলাভাই আমার রাগী চেহারা দেখে থতমত খেয়ে বলে উঠলেন,
—দীপু, তুমি হতাশ হয়ো না। প্রয়োজনে আমি ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসব। আমি এত সহজে হাল ছেড়ে দেব না। আমার কেনা হলুদ আমি বৃথা যেতে দেব না। মলি শুধু আমাদের, আর কারও না।
আমি দুলাভাইয়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তারপর দূরপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ করে অনুভব করলাম, আমার চোখ দুটো আস্তে আস্তে ভিজে যাচ্ছে। চলবে...

* ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]

আরও পড়ুন