বিয়ের চাপ-২য় পর্ব

বিয়ে
ফাইল ছবি

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মলি বলল,
-আপনি আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে আছেন কেন? নাকি উত্তর দিতে ভয় পাচ্ছেন?
-না, মানে….
-আচ্ছা এখন উত্তর দিতে হবে না। খুব খিদে পেয়েছে। আগে খাবারের অর্ডার দিন, তারপর আপনার উত্তর শুনব। তবে সাবধান, উল্টাপাল্টা উত্তর দিলে কিন্তু খবর আছে।
মলি আসার পর থেকেই তার কথাবার্তার স্টাইল দেখে আর তার ভাবভঙ্গি দেখে আমি অবাকের পর অবাক হচ্ছি। ওর কথা বলার ধরন দেখে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই মেয়ে এ জীবনে বহু পোলাপাইন পিটাইছে।

-কী ব্যাপার। বোকার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? আপনাকে না বললাম, খিদে লেগেছে। ওয়েটারকে ডাকুন।
আমি আপার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
-আপা, তুমি না বলছিলা মেয়ে শান্ত, মেয়ে ঝগড়া করে না। কিন্তু এ মেয়ে তো দেখি পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে।

আপাও আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
-ঝগড়া করলে তো তোর জন্যই ভালো। কারণ, তুই না সেদিন বললি, তোর ঝগড়াটে বউ লাগবে। শান্ত বউ হলে নাকি জীবন ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে।

আপাকে আর কিছু বলার আমার রুচি হলো না। শুধু মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ! এমন ফালতু বোন আর কাউকে দিয়ো না।

ইশারা দিয়ে ওয়েটারকে ডাকলাম। মলি নিজেই একগাদা খাবারের অর্ডার দিল। আপা বলেছিল, মলি খুবই স্বাস্থ্যসচেতন। ডায়েটিং করে, জাংক ফুড খায় না। এখন দেখছি সবই উল্টা। মলি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল,
-ওকে, খাবার আসতে আসতে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি আমাকে বিবাহ করতে চাচ্ছেন না কেন?

আমি মলির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
-না, আসলে হয়েছে কি?
-আসলে কি হয়েছে তা আমি জানি। আপনারা ছেলেরা খুবই কনফিউজড। আপনারা নিজেরা কেমন, নিজের যোগ্যতা কেমন, তা না বিচার করে মেয়ের যোগ্যতা নিয়ে পড়ে থাকেন। মেয়েকে এমন হতে হবে, মেয়েকে তেমন হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা যে একধরনের ক্রাইম, সেটা বোঝেন? অ্যানি ওয়ে, আমার যে যে বিষয় নিয়ে আপনি অবজেকশন দিয়েছিলেন, তার সবই আমি গত কয়েক দিনে পরিবর্তন করেছি। নিশ্চয় আপনি আমাকে দেখে তা বুঝতে পারছেন? এখনও কি আমাকে বিয়ে করতে আপনার সমস্যা আছে?

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

-আসলে আমি বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে। আমার কেবলই মনে হয়, বিয়ের পর আমি পরাধীন হয়ে যাব। আমার কোনো স্বাধীনতা থাকবে না।
-অবশ্যই থাকবে না। এত স্বাধীন থেকে কি করবেন? এত বছর তো স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। কি উল্টায় ফেলছেন?

মাইগড এই মেয়ের মুখের ভাষা তো খুবই অপমানজনক। অথচ আপা বলেছিল মার্জিত। আমি আপার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আপা স্মিত হেসে বললেন,
-এক কাজ কর, তোরা বরং দুজনে নিরিবিলি একটু কথা বল। আমরা অন্য একটা টেবিলে গিয়ে বসি।

-আসলে আপনি ভুল তথ্য পেয়ে আমাকে ভুল বুঝেছেন। শুধু আপনি না, এ দুনিয়ার কোনো মেয়ের ব্যাপারেই আমার কোনো সমস্যা নেই। পৃথিবীর সব মেয়েই সুন্দর। আমি না দেখেই যেকোনো মেয়েকেই বিয়ে করতে পারব। সমস্যা আসলে অন্যখানে। আমি আসলে বিয়ে করতেই চাচ্ছি না।

-কেন চাচ্ছেন না? আপনি কি অক্ষম? শোনেন, আমার এক বন্ধু এ বিষয়ের ডাক্তার। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। হাতেনাতে ফল পাবেন। বিফলে মূল্য ফেরত।

বলেই মলি দুই ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল। আমি ওই টিটকারি মার্কা হাসি দেখে একটুও বিচলিত হলাম না। আমি দৃঢ়ভাবে বললাম,
-নারে ভাই, না। আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি বুঝলাম না, ছেলেরা বিয়ে করতে না চাইলে, সবার মনে প্রথম এই প্রশ্নটাই কেন আসে? মানুষের তো অন্য কোনো সমস্যাও থাকতে পারে, পারে না?
-অবশ্যই পারে। সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। আপনার সমস্যা কোথায়?

আরও পড়ুন

এই কথা বলে আপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এরপর দুলাভাইকে উঠতে ইশারা করলেন। দুলাভাই আপাকে বললেন,
-তোমরা যাও। আমি এখানে ওদের সঙ্গে থাকি।
-কেন? কেন তুমি ওদের মাঝে থাকবে?

-পপি শোনো, ওরা এখন যুদ্ধের মুডে আছে। জাতিসংঘের প্রেসিডেন্টের মতো একজন কাউকে এখানে থাকা দরকার। না হলে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমি শিওর, সমস্যা শুরু হলে দিপুই মাইর খাবে। তুমিই বলো, হবু স্ত্রীর হাতে মাইর খাওয়াটা কি ঠিক হবে? হবে না। তাই তো কবি বলেছেন, ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু আমার….

উদাহরণ শুনে আমরা সবাই দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম আপাও ভুরু কুঁচকে দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। দুলাভাই মিনমিন করে আপাকে বললেন,
-এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

আপা দাঁতমুখ খিঁচে বললেন,
-শোন, তোরে আমি আসলেই এবার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব। ব্যাটা পাগলের গোষ্ঠী পাগল।

বলেই আপা দুলাভাইয়ের হাত ধরে টেনে তুললেন। তারপর তিনজনেই অন্য একটি টেবিলে গিয়ে বসলেন। তারা চলে যেতেই মলি আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করল,
-আচ্ছা আপনি নাকি দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুমান?
-এটাও আপনি জেনে গেছেন? নিশ্চয় আপা আপনাকে বলেছেন, তাই না? জানেন, এখন আমি এক শ ভাগ শিওর, এ মহিলা আমার বোন না। আমি এই মাত্র সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এই মহিলার ডিএনএ টেস্ট করাব।

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

-খবরদার, বড় বোন সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন না। উল্টাপাল্টা কথা না বলে আমি যে প্রশ্ন করছি, তার উত্তর দেন। সারা রাত কি করেন যে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুমাতে হয়?
-কমেডি শো দেখি। আর হাসি।
-কেন, আপনি কি কমেডিয়ান? এত বড় বুইড়া একটা ব্যাটা কমেডি শো দেখে আর হি হি করে হাসে, এটা কোনো কথা! শোনেন, কোনো সুস্থ মানুষ দুপুর পর্যন্ত ঘুমায় না। আমার ধারণা, আপনি গুড ফর নাথিং টাইপের মানুষ।

-আপনি টিটকারি করে বললেও কথা কিন্তু সত্য। আমি আসলেই গুড ফর নাথিং। সে জন্যই তো বলছি। আমাকে বিবাহ করা আপনার উচিত হবে না। আপনি বরং একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে বিবাহ করেন।

-শোনেন, আপনার কি ধারণা আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি পাগল হয়ে আছি? জি না, আপনাকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি শুধু আপনার বোনের জন্য রাজি হয়েছিলাম। তিনি শুধু আমার বোনের বান্ধবী না, আমার বোনও। তিনি যখন খুব করে ধরলেন, তখন আর না বলতে পারলাম না। তবে আপনি আমার খুঁত বের করে আমাকে রিজেক্ট করার পর, আমার জেদ চেপে গেছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়ে আমি আপনাকেই করব। প্রয়োজনে জোর করে হলেও করব। আর একটা কথা, আমাকে রিজেক্ট করার ফলাফল আপনি কড়ায়-গন্ডায় পাবেন। অপেক্ষা করুন।

আমি বুঝতে পারছি, আমার জীবন শেষ। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এ মেয়ে নির্ঘাত আমারে বিয়ের পর মারবে। বলা যায় না, বাসররাত থেকেই মাইর শুরু করতে পারে।
-শোনেন, জেদ করে আমাকে বিয়ে করাটা আপনার ঠিক হবে না। আপনি পদে পদে ঠকবেন। একটা বড় ঠকার উদাহরণ দিই, তাহলেই বুঝবেন। আমি প্লেনে উঠতে খুবই ভয় পাই। তাই আমি প্লেনে উঠি না। আপনি আমাকে বিয়ে করলে সুইজারল্যান্ড বা দুবাই, কোথাও হানিমুনে যেতে পারবেন না। কেন আপনি আমাকে বিয়ে করে খামাখা আপনার হানিমুন নষ্ট করবেন।

-শোনেন, আমার ওই সব দেশে হানিমুনে যাওয়ার কোনো শখ নেই।
-বলেন কি! আপনি হানিমুনে যাবেন না?
-অবশ্যই যাব। তবে ওই সব জায়গায় না। আমি আসলে অনেক আগে থেকেই হানিমুনের জন্য চারটি জায়গা নির্বাচন করে রেখেছি। এর মধ্যে থেকে কোনো এক জায়গায় যাব।

-সেই চারটি জায়গার নাম কি জানতে পারি?
-অবশ্যই। সেই চারটি জায়গা হলো—হাতীবান্ধা, গাইবান্ধা, ভেড়ামারা আর ঘোড়াশাল।
-দুনিয়ার এত এত সুন্দর জায়গা থাকতে এসব জায়গা কেন?
-এর কারণ, এই জায়গাগুলোর নাম খুব কিউট। দেখেন কি কিউট কিউট প্রাণীর নামে জায়গাগুলোর নাম রাখা হয়েছে।

-আপনার মাথায় আসলেই সমস্যা আছে।
-শোনেন, আমার মাথা নিয়ে আপনার চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। আচ্ছা আপনি চাকরি-বাকরি করছেন না কেন?
-কারণ চাকরি আমার পছন্দ না। এখানে মেধার বিকাশ ঘটানো যায় না।
-তাই নাকি! তা মেধার বিকাশ ঘটাতে হলে কী করতে হবে?

-ব্যবসা করতে হবে। আমি ঠিক করেছি, ব্যবসা করে আমার ক্রিয়েটিভিটি দেখাব।
-তাই নাকি? তা কী ব্যবসা করবেন?
-আমি ঠিক করেছি আমাদের পৈতৃক ব্যবসাটাই আমি দেখব। এবং তার মাধ্যমে আমার মেধার বিকাশ ঘটাব।

-আপনি কি ফাজলামি করেন? আমি তো জানি, আপনাদের কোনো ব্যবসাই নেই। আপনার বাবার ঢাকা শহরে অনেকগুলো বাড়ি আছে। সেই সব বাড়ির ভাড়া তুলেই আপনাদের সংসার চলে।
-জি, কথা সত্য। আমি ঠিক করেছি, এ ব্যবসা করেই জীবন কাটিয়ে দেব।
-বাসাভাড়া তুলে জীবন চালানোর মধ্যে ক্রিয়েটিভিটিটা কোথায়?
-বলেন কি! ভাড়াটিয়া ম্যানেজ করা কিন্তু অনেক জটিল কাজ। আপনাকে ক্রিয়েটিভ হতে হবে। না হলে ভাড়াটিয়া ম্যানেজ করতে পারবেন না।

-শোনেন, এসব নিয়ে আপনার আর চিন্তা করতে হবে না। বিয়ের পর আমি একজন কর্মী নিয়োগ করব। সে সব কটি বাড়ি দেখাশোনা করবে। আর টাইম টু টাইম আমার কাছে রিপোর্ট করবে।
-আর বাড়ি ভাড়ার টাকা?
-সেগুলো ওই কর্মী তুলে এনে আমার কাছে জমা দেবে। আপনার যখন যা লাগবে, আমার কাছ থেকে চেয়ে নেবেন। আপনি বরং এখন থেকে চাকরি খুঁজুন।

আমি অবাক হয়ে মলির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সারা জীবন শুনেছি মানুষ নাকি বাসররাতে বিড়াল মারে। এ মেয়ে তো বিয়ের আগেই একটার পর একটা বিড়াল মেরে ফাটিয়ে ফেলছে।

মনে মনে শপথ নিলাম, যত যা-ই ঘটুক। এ মেয়েকে আমি বিবাহ করব না। না মানে না। ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে এন ও নো।

বাসায় ফিরে আমি সবাইকে জানিয়ে দিলাম, আমি দুনিয়ার যেকোনো মেয়েকে চোখ বন্ধ করে বিয়ে করতে রাজি আছি। কিন্তু এ মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে করব না।

দুদিন পর বাবা আমাকে তলব করলেন। আমি ড্রইংরুমে গিয়ে দেখলাম, মা, আপা, দুলাভাই সবাই উপস্থিত। বাবা আমাকে ইশারা দিয়ে বসতে বললেন। আমি বসতেই বাবা সবার উদ্দেশে বললেন,
-তোমাদের বলা হয়নি। গতকাল সারা বিকেল আমি আর মলি হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়িয়েছি।
আমি অবাক হয়ে বাবাকে বললাম,
-তুমি মলিকে কোথায় পেলে?
-পপিই সব ব্যবস্থা করেছে। ওর মাথা থেকেই এই বুদ্ধি বের হয়েছে।

আমি ভুরু কুঁচকে চোখ দুটোকে ছোট করে আপার দিকে তাকালাম। আপা চোখ সরিয়ে নিলেন। বাবা আবার বলা শুরু করলেন,
-এ মেয়ে তো সাক্ষাৎ আমার মা। এত ভালো মেয়ে এ দুনিয়ায় আছে, আমার ধারণা ছিল না।
-বাবা তুমি তো মানুষের সঙ্গে কম মিশ। তাই তোমার এমন মনে হয়েছে। এ মেয়ের চেয়ে হাজার গুণ ভালো মেয়ে বাংলার ঘরে ঘরে আছে। তুমি চাইলে আমি তোমাকে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারি। তাদের দেখলে তুমি বুঝবে, মলি মেয়েটি তাদের তুলনায় কিছুই না।

বাবা আমার দিকে ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর দৃঢ়স্বরে বললেন,
-দিপু, তুমি কি বুঝতে পেরেছ, আমি কি বলেছি? আমি বলেছি মলির ব্যবহার, চেহারা সব আমার মায়ের মতো। আমার মা অবিকল এমন ছিলেন। আল্লাহ আমার মাকে আবার আমার ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। আমি কখনো তোমার ওপর কিছু চাপিয়ে দিইনি। তবে এ ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার মা আমার বাসায় আসবে। এটা আমার ফাইনাল সিদ্ধান্ত।
-কিন্তু বাবা...
-তুমি এখন যেতে পার। তোমার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আমি আর কথা বলতে চাচ্ছি না।

আমি আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজের রুমে এসে মনে মনে বোনের উদ্দেশে বললাম, ‘ঘসেটি বেগম, আমি ডিএনএ টেস্ট করে প্রমাণ করে দেব, তুই আমার বোন না। আর তুই দেখিস, এ বিয়ে যে করেই হোক আমি ভাঙব। তোর বান্ধবীর অতি চালাক এই বোনকে আমি কিছুতেই বিবাহ করব না।’ চলবে...