কথোপকথন: প্রসঙ্গ ১৯৭১
ই-মেইল দেখে আমি ভাবছি কী করব। যাব কি যাব না। লীনাকে ই-মেইলটা দেখালাম।
ও বলল, ‘যাও, গিয়েই দেখ।’
শিকাগো যেতে হবে প্রথমে, তারপর আরও ঘণ্টা দেড়েকের ড্রাইভ। আমি গুগল ম্যাপে সব দেখে নিলাম। ক্রিসমাসের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। পুরো শহর জনশূন্য। যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ টাউনগুলো এমনই। ইউনিভার্সিটি বন্ধ হলে পুরা শহর খালি হয়ে যায়। মেয়েদের নিয়ে লীনা স্নো ম্যান বানানোর প্ল্যান করছে। আগামী দুই দিন স্নোর ফোরকাস্ট দেখাচ্ছে।
দুটো কফি বানালাম। লীনার হাতে কফি দিয়ে বললাম, ‘চলো সবাই মিলে যাই। একটু ঘুরাও হবে। কী বোলো?’ লীনা তাকিয়ে বলল, ‘দেখা করতে তুমি যাবে। আমাদের সঙ্গে টানবে না। তুমি কাজ নিয়ে থাকবে। যা ঠান্ডা, আমাকে হোটেলে বসে থাকতে হবে। তুমি একাই যাও।’
আমি মাথা নাড়লাম।
ফ্লাইটে শিকাগো যেতে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। কয়েক বছর আগে আমি একটা একাডেমিক প্রেজেন্টেশন দিতে গিয়েছিলাম আরেকটা ইউনিভার্সিটিতে। ডিসেম্বর ছিল তখন। আমি পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়াই—পলিটিক্যাল ইকোনমি আমার প্রিয় জায়গা। ওই ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে ধরল একটা প্রেজেন্টেশন দিতে, ওদের হয়ে। ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস। তাই আমি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম। অর্থনৈতিক আর সামাজিক বৈষম্য কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বুনেছিল, তার বিশ্লেষণ। ভাষাগত, সামাজিক, ভৌগোলিক আর রাজনৈতিক বিভাজন সহজে বোঝা যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে যে পলিটিক্যাল ইকোনমি ছিল, আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম।
অবাক করার বিষয় হলো, বেশ কিছু পাকিস্তানি ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক সেখানে ছিলেন। তাঁদের জানার ইচ্ছা ও সৎ সাহস দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমি এটা আশা করিনি। পাকিস্তানের এই লিবারেল নতুন প্রজন্ম সংখ্যায় নগণ্য, অনেকটা নিজ দেশে পরবাসী।
প্রেজেন্টেশন শেষে তাদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এল। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘স্যার আমি আপনাকে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আপনি কথা বললে ভালো হবে।’
সাদাফ নাম ছেলেটার। আমার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেল। ও হিস্ট্রিতে পিএইচডি করছে।
আমাকে যার কথা বলল তাঁর নাম কর্নেল ইস্ফান্দিয়ার খান। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। সাবেক পাকিস্তানি সেনা অফিসার। সাদাফ যোগাযোগ করিয়ে দিল। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। ই-মেইলে সাদাফ তাই জানাল।
আমি দেখা করছি শুধুই কিউরিসিটি থেকে। আমার গবেষণার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই এই মিটিংয়ের। সাদাফ বলেছিল এই কর্নেল ১৯৭১–এ বাংলাদেশে ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা বলবেন অকপটে। আমি এই সুযোগ ছাড়তে চাইনি। কিন্তু এই লোক কতটুকু কী বলবেন, বা আমিও কীভাবে কথা বলব, খুব ভালো প্রস্তুতি আমি নিইনি।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বাড়ির ড্রাইভওয়েতে গাড়ি রাখলাম। একটা ছোট শহর। শিকাগো আর ইন্ডিয়ানা বর্ডারে। দরজায় নক করলাম। ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। এক বৃদ্ধা দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জানতে চাইলেন আমি চা বা কফি খেতে চাই কি না। চারপাশে অনেক ছবি। সবই পারিবারিক।
ইস্ফান্দিয়ার খান আমার সামনে এসে বসলেন। আশির ওপর বয়স। বেশ অমায়িক। নিজেদের টুকটাক কথা হচ্ছে, আমি সুযোগ খুঁজছিলাম। তিনি নিজেই সুযোগ এনে দিলেন। বাংলাদেশের কথা তুললেন। আমি জানতে চাইলাম ১৯৭১–এ তিনি কোথায় ছিলেন।
ইস্ফান্দিয়ার খান আমার দিকে চাইলেন—দৃষ্টি বদলে গেল। অমায়িক ভাবটাও একটু সরে গেল। আমাকে বললেন, ‘আমরা পাকিস্তান ডিফেন্ড করছিলাম, তোমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করছিলে।’
আমি হাসলাম। জানতে চাইলাম, ‘পাকিস্তানকে ডিফেন্ড মানে? কার কাছ থেকে। আমরা তো আপনাদের আক্রমণ করিনি। আর টেকনিক্যালি আমরাও তখন পাকিস্তান। আপনি কী বলছেন?’
ইস্ফান্দিয়ার খান একটু হাসলেন। একটু খেদ নিয়ে বললেন, ‘সত্যি কি ওটা পাকিস্তান ছিল? আমার মনে হয় না। পাকিস্তান কী? আমরা পাকিস্তানিরাও জানি না। তোমাদের বাংলাদেশের জন্মের পেছনে তোমাদের অনেক ভাবনা ছিল, স্বপ্ন ছিল। পাকিস্তান টু নেশন থিওরির আউটপুট একটা রাষ্ট্র। দেশ হতে পারেনি। আমাদের কোনো স্বপ্ন ছিল না। আমরা স্বপ্নদ্রষ্টা পাইনি।’
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আমার মা আর বড় খালার কাছে শুনেছি, তাঁরা তখন কিশোরী। গ্রাম থেকে গ্রামে, এক আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে আরেক বাড়ি করেছেন। নিরাপদ ছিলেন না মোটেও। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে। আপনিও কি এই দলের?’
ইস্ফান্দিয়ার খান আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘না বাবা। আমি করিনি। আমার সামনে সব হয়েছে। আমি প্রতিবাদ করিনি। সাহস ছিল না। আমি ভীরু ছিলাম। ১৯৮২–তে জিয়াউল হক প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমি হতাশ হয়ে পড়ি। ওখানে থাকলে আমার কোর্ট মার্শালে বিচার হতো। আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে যেত। আমি চাকরি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। সাদাফ আমার বোনের নাতি। এরাও পারবে না। আমরা পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি। তোমরা পেরেছো।’
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘পাকিস্তান কি ক্ষমা চাইবে? কেন চাইবে না?’
ইস্ফান্দিয়ার খান চুপ করে আছেন। আমার কেন জানি মনে হলো তিনি আর কিছু বলবেন না। একাত্তরে তিনি যাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং যাদের ওপর অত্যাচার করেছেন, সেই সত্য তিনি চেপে রাখবেন।
একটু পর বললেন, ‘১৯৭১–এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। একই সঙ্গে পাকিস্তানের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তচিন্তা, উদারপন্থা, সহনশীলতা এসব চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার সূচনা হয়ে গেল। আমি এই নর্থ আমেরিকাতে যত বাংলাদেশি প্রফেসর কিংবা বিজ্ঞানী কিংবা ইঞ্জিনিয়ার দেখেছি, তার অর্ধেকের কম আছেন পাকিস্তানি। সাদাফ কদিন আগে বলছিল যে আজকাল নাকি বাংলাদেশ থেকে অনেক ছেলেমেয়ে এখানে পড়তে আসছে। তোমরাও অনেক ধর্মপ্রাণ, কিন্তু গোঁড়ামি নেই তোমাদের। এই জায়গাতেই পাকিস্তান ১৯৭১–এ পিছিয়ে গেল। আমাদের ইতিহাস বইগুলো ১৯৭১–এর বয়ান মিথ্যাচারপূর্ণ। তোমাদের স্বাধীনতার সময় আমাদের অপরাধের শাস্তি বোধ হয় এটাই।’
আমি বেরিয়ে এলাম। তিনি গাড়ির দরজা পর্যন্ত এলেন এগিয়ে দিতে।
আমি হোটেলে ফিরে যাচ্ছি, ওই সময়ের প্রতক্ষদর্শীর বয়ান আমি পেলাম না।
লেখক: হায়দরী আকবর আহমেদ, কাইল, টেক্সাস