প্রেইরীর সাদা বাড়ি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ম্যানহাটান, ক্যানসাস। আমেরিকাতে এসব ছোট শহরগুলোকে বলে কলেজ টাউন। এই ধরুন ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ থাকেন, এই জনসংখার মোটামুটি অর্ধেকের বেশি ছাত্র আর ছাত্রী। এই ম্যানহাটান নামের কলেজ টাউনে আমি ছিলাম ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত। এই ছোট শহরটা আমাকে তার সব স্নেহ, ভালোবাসা, আর মমতা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল। অনেক বন্ধু, অনেক স্মৃতি। আমার বড় মেয়েটার জন্ম এই শহরে। দুজন অচেনা মানুষকে নির্মলেন্দু গুনের ভাষায় দুই থেকে এক করে দিয়েছিল এই শহর—ম্যানহাটান।

২০১৩ সালের উইন্টার ছিল বেশ কঠিন। আমি আমার পিএইচডি কোয়ালিফায়ার পরীক্ষা দিয়েছিলাম। চার ঘণ্টার এক একটা পরীক্ষা। অর্থনীতি তত্ত্বের ওপর প্রশ্ন। সর্বমোট ১০ জন পরীক্ষা দিয়েছিলাম। দুজন পরীক্ষা দিতেই আসেনি। ২০১৪ সালের শুরুটা ছিল একটু অনিশ্চয়তাপূর্ণ—পাস করব তো? ফেল করলে কী করব? যাক, পাস করেছিলাম।

শীতের একটা রুক্ষ আর শুষ্ক দিক আছে আমেরিকার মিড-ওয়েস্টজুড়ে। এপ্রিল থেকে আবার সবকিছুতে প্রাণ ফিরে আসে। গাছগুলোয় নতুন পাতা, নতুন ফুল। চারদিক বড্ডো বেশি সুন্দর। ওই বছরের এপ্রিলের শুরুতে কোনো এক মঙ্গলবার দুপরে আমি হুট করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। এমনি—গাড়ি নিয়ে ঘুরতে। আমার মেরুন রঙের ফোর্ড ফোকাস আর আমি। বেশি দূর যাইনি। এই ধরুন মাইল চল্লিশেক। জনমানুষশূন্য প্রেইরি ল্যান্ডে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম—লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি। ছোট্ট রোমান্টিক স্মৃতি। না কোনো স্বর্ণকেশীর প্রেমে আমি পড়িনি। আমি প্রেমে পড়েছিলাম একটা বাড়ির।

মিনিট ৩০–এর মতো গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে চলে এলাম। আমার প্লেলিস্টে গান চলছে। ফিডব্যাকের গীতিকবিতা ১। চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়।

ক্যানসাসের ওই অংশের ভূপ্রকৃতিকে অনেকে বলেন রোলিং কান্ট্রি। ছোট ছোট টিলার মতো, তার ওপর রাস্তাগুলো ঢেউয়ের মতো। ঢাল বেয়ে টিলার ওপরে উঠবেন, তারপর আবার নেমে যাবেন ঢাল বেয়ে। মাঝেমধ্যে এই রাস্তাগুলো ডানে কিংবা বাঁয়ে বাঁক নেয়।

এই টিলাগুলো ছেঁয়ে থাকে একধরনের ঘাস। এদের ভাষায় টল গ্রাস। এ রকম একটা বাঁকে এসে আমার চোখে পড়ল, একটু দূরে সাদা রঙের একটা বাড়ি। একলা একা—একটা টিলার ওপর। আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই।

আমি রোলিং কান্ট্রি রোড ধরে একটু একটু করে ওই বাড়ির কাছে চলে গেলাম। সেদিন আমি ওই বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় আমার গাড়ি থামিয়ে ছিলাম। কেন? আমি জানি না। প্রথম দেখায় প্রেম বলা যেতে পারে।

বাড়িতে কেউ থাকে না। গেটের পাশে মেইল বক্সটা ভাঙা। গেটের দশাও একই। উঠোনের ঘাসগুলো বড় হয়ে গেছে। চারপাশে একটু যত্নহীনতার ছবি। ইংরেজি অক্ষর এল শেইপের বাড়ি। একটা জানালার নিচে গোলাপের ঝাড়। লাল টকটকে গোলাপ, পেছনে সাদা কাঠের দেয়াল। বাড়ির তিন দিকে বিশাল বিশাল পাইনগাছের সারি। খোলা বারান্দার একপাশে একটা দোলনা। এই দোলনার সামনে কোনো গাছ নেই।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বাড়িটা খালি। বহুদিন কেউ থাকে না। আমি হেঁটে বারান্দায় উঠলাম। চারপাশে ধুলো আর ঝরাপাতা। আমি দোলনার কাছে গিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। সত্যি বলতে কি আমি একটু ধাক্কা খেলাম, বড় সুন্দর ছবি। রোলিং কান্ট্রি রোড আর দিগন্তবিস্তৃত আকাশ। টিলাগুলোজুড়ে ছেয়ে আছে টল গ্রাস। সেই ঘাসের ওপর বাতাস বয়ে গেল, সাগরের ঢেউয়ের মতো ঘাসগুলো দুলছে। আকাশের মেঘগুলো মাঝেমধ্যে সেই ঢেউয়ের ওপর ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। অপার্থিব একটা অনুভূতি। বলে বোঝানো অসম্ভব।

এই বাড়ি যিনি বানিয়েছিলেন তার মনের চোখ অসম্ভব সুন্দর ছিল। আমি মন্ত্রমুগদ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের কোলে একটা সুন্দর দিন ঢলে পড়ছে। আশেপাশে কোনো ঘর বাড়ি নেই। আমি বারান্দা থেকে নেমে চারপাশ ঘুরে দেখলাম। এরকম জায়গায় কেউ কেউ ভয় পেতে পারেন। আমি কেন যেন একদমই ভয় পাইনি। একটা শান্ত আর স্নিগ্ধ মৌনতা। চারপাশের জঙ্গলের পাখি আর পোকামাকড়ের নানা শব্দ। গাছের পাতার গায়ে বাতাসে একটু মৃদু শোঁ শোঁ আওয়াজ। আমার মনে হচ্ছিল, যদি এখানে থেকে যেতে পারতাম!

সেদিন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে মনের মধ্যে একটা প্রেমে পড়ার অনুভূতি হয়েছিল। বারবার ওই বাড়িটার কথা ভাবছিলাম। কেউ থাকে না ওখানে। আমিও একা থাকি। আমার পুরো অ্যাপার্টমেন্টজুড়ে মৌনতা আর নীরবতা। দুটোই আমার প্রিয়।

এরপর অনেকবার আমি ওখানে গিয়েছি। এই দেশে লোকজন ওয়েদার দেখে রোজ সকাল–বিকেল নিয়ম করে। বৃষ্টি হবে কি না, ঠান্ডা কেমন হবে। এই সব আরকি। একদিন বৃষ্টির সময় ওখানে গিয়েছিলাম। ওই দোলনার সামনে দাঁড়িয়ে প্রেইরিতে বৃষ্টির নাচ দেখেছি। মেঘ-বাদলের সময় বাতাসে টল গ্রাসের ঢেউ আরও বেশি সুন্দর। আমার পক্ষে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

চাঁদনী রাতে গা ছমছমে জোছনায় পরীদের দেখার আশায় ওখানে গিয়েছিলাম। পাইনি। আকাশ ভরা তারাদের ঝিকিমিকি দেখছি একবার। বিশাল আকাশ। কেউ নেই আশপাশে। আমার ফোনের প্লেলিস্টে আয়ুব বাচ্চু গাইছেন ‘তারা ভরা রাতে...’

শীতের সময় যখন স্নো পড়ছিল আমি ওই বাড়িতে গিয়েছি। স্নোতে তুষারের শুভ্র প্রলেপমাখা প্রেইরি আর রোলিং কাউন্টি। কুয়াশার চাদরে ঢাকা দিন।

এক কাপ গরম চা ঢেলে আমি দোলনায় বসে তাকিয়ে ছিলাম প্রেইরির দিকে। শ্বেতশুভ্র হিল কান্ট্রি। স্নো যখন পড়ছিল—সুন্দর, স্নিগ্ধ, নিঃশব্দ। প্রেমে পড়া সহজ, প্রেমে মজে থাকা অনেক কষ্ট। এই শীতের মতো।

বিয়ের পর আমার স্ত্রী যখন ক্যানসাস এল, আমি ওকেও নিয়ে গিয়েছিলাম। স্বামীর এক্স গার্লফ্রেন্ড ওর ভালো লাগেনি।

আমার লিটল হাউস ওন দ্য প্রেইরি-

‍আমার প্রেইরির সাদা বাড়ি।

*লেখক: হায়দরী আকবর আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক, সেন্ট অ্যাডওয়ার্ড ইউনির্ভাসিটি

আরও পড়ুন