নোটবুক
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
১.
কালো মলাটের একটা নোটবুক। সস্তা কাগজের। কিছু জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। লেখাগুলো মোটামুটি পড়া যাচ্ছে। কিছু লেখা বেশ কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে। বেশির ভাগ কয়েক লাইন মাত্র। আজ দুপুরে ল্যাকেশিয়া আমাকে দিয়ে গেছে। এই কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান আমেরিকান মেয়েটা খুবই মেধাবী। এই নোটবুক ওর ছোট খালার। আন্ট জেনিস বলেছিল নামটা।
আমি জানতে চাইলাম ‘আমি কী করব এটা দিয়ে! আমাক দিচ্ছ কেন?’
ল্যাকেশিয়া মৃদু হাসল। বলল, ‘প্রফেসর তুমি আমার আন্টকে নিয়ে কিছু লিখলে আমি খুশি হব। ওর আত্মা শান্তি পাবে।’
আমি একটা প্রশ্নবোধক নিয়ে তাকিয়ে আছি। বললাম, ‘আমি তো বাংলায় লিখি। তুমি কিংবা তোমরা তো কোনো দিন পড়বে বলে মনে হয় না। আমি জানি না এই নোটবুকে কী আছে। তোমাদের পরিবারের কারও যদি সেটা খারাপ লাগে তাহলে? তুমি কি ভেবে বলছ?’
ল্যাকেশিয়া একটু সময় চুপ করে থাকল। আমি জানি এই মেয়েটা যেমন মেধাবী তেমনি আত্মসচেতন নিজের কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর বলল, ‘আন্ট জেনিস আমার মায়ের ছোট বোন। ওর স্বামী আঙ্কেল ভিনসেন্ট রুয়ান্ডান রেফিউজি। ওর পরিবারের সবাই রুয়ান্ডান জেনোসাইডে মারা যান। কেউ বেঁচে নেই। আন্ট জেনিস আর ওদের মেয়ে নিয়েনিয়েরি ছিল ভিনসেন্টের সবকিছু—সারা পৃথিবী। নিয়েনিয়েরির যখন পাঁচ বছর বয়স তখন ও আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেল। ক্যানসার। আঙ্কেল ভিনসেন্ট তার কিছুদিন পর সুইসাইড করেন। প্রায় বছর তিনেক আগে আন্ট জেনিস হারিয়ে যান। কিছুদিন আগে আমার কাছে একটা টেলিফোন আসে। সেন্ট লুইস থেকে। ওখানে হোমলেস আন্ট জেনিস মারা যান। এই নোটবুকের প্রথম পাতায় আমার নাম আর ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। আর লেখা আছে আমাকে জানানোর জন্য। আমার অধিকার আছে। আন্ট জেনিসকে আমি খুবই ভালোবাসি। প্রফেসর তুমি যা লিখবে, আমি আপত্তি করব না। তোমাকে স্বাধীনতা দিলাম।’ আমি ওর কথাগুলো শুনছিলাম। বললাম, ‘নিয়েনিয়েরি মানে কী?’
‘নিয়েনিয়েরি হলো মধ্যরাতের তারা, ওটা আফ্রিকান ভাষা শব্দ’, ল্যাকেশিয়া বলল।
২.
বাইরে স্নো পড়ছে। এখন বিকেল চারটা। এখনই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। গ্রেট লেকের পাশে আমেরিকার এই অংশে খুব ঠান্ডা পড়ে, সঙ্গে অনেক স্নো। আমার ইউনিভার্সিটি যে শহরে, সেখান থেকে শিকাগো বেশি দূরে না। ফাইনাল শেষ, এখন ছুটি। আমি গ্রেডিং শেষ করলাম। বাইরের অন্ধকার, স্নো পড়ছে। আমার অফিস চারতলায়। অনেক দূর দেখা যায়। অপার্থিব সুন্দর একটা সন্ধ্যা।
আমার অ্যাপার্টমেন্ট মাত্র ২০ মিনিটের পথ। যেতে ইচ্ছা করছে না। আমি একা মানুষ। কাছের একটা রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করে দিলাম। ওদের ডেলিভারি ড্রাইভার নিচে এসে কল দেবে। গিয়ে নিয়ে এলেই হবে। আমি নোটবুকে মনোযোগ দিলাম।
পাতার পর পাতা ভিনসেন্ট আর নিয়েনিয়েরির গল্প। ভিনসেন্ট গভীর রাতে মেয়েকে ওর বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমাত। আমি বিয়ে করিনি। সন্তানবাৎসল্য আমার নেই। এক জায়গায় জেনিস লিখেছে মাঝেমধ্যে নিয়েনিয়েরিকে বুকে নিয়ে ভিনসেন্ট খুব কাঁদত। রুয়ান্ডান জেনোসাইডে সবাইকে হারানো ভিনসেন্টের কাছে এই ছোট্ট শিশুই একমাত্র আপনজন। এই দুজনে চলে যাওয়ার পর জেনিস বুজতে পারছে ভিনসেন্টের আবেগটুকু। জেনিস না লিখলে আমি কি বুঝতে পারতাম?
কিনওয়ার ওয়াল্ডা ভাষায় ঘুমপাড়ানি গান গাইত ভিনসেন্ট। ওর পূর্বপুরুষ, মাটি, আর জঙ্গলের গল্প বলত মেয়েকে। ডিনারের সময় মেয়ের মুখে নিজ হাতে খাওয়া তুলে দিত ভিনসেন্ট। জেনিসে মাঝেমধ্যে আপত্তি করত। বলত ‘ওকে নিজে করতে দাও।’ এটা আমেরিকান রীতি। ভিনসেন্ট কোনো দিন শোনেনি এই কথা।
‘তোমার ডার্ক চকলেট তুলতুলে গালের নরম উষ্ণতা আমার ঠোঁটে আর গালে লেগে আছে। তুমি কত দূরে! আমি কবে যাব। ‘লেখার নিচে পরিষ্কার অশ্রু চিহ্ন। দিন তারিখ কিছুই লেখা নেই।
আমি একটু অস্থির বোধ করতে লাগলাম। বাইরে স্নো পড়ছে। আমার দরজায় কেউ নক করল। দরজা খুলে দেখলাম ক্যাম্পাস সিকিউরিটি। ‘তুমি ঠিক আছ তো প্রফেসর।’
আসলে জেনিসের লেখা আমাকে তখন স্পর্শ করছে। আমি ওর কষ্ট একটু একটু অনুভব করছি। আমি বললাম, ‘আমি ঠিক আছি। একটু পর বের হব।’
অফিসার চলে গেল। আমি বসলাম। বাইরে স্নো পড়ছে। আমি দূরে তাকিয়ে আছি। জেনিস, ভিনসেন্ট, আর নিয়েনিয়েরি কী করত এমন সন্ধ্যায়? শিকাগোতেই থাকত পুরো পরিবার। আর কদিন পর ক্রিসমাস। কেমন ছিল ওদের জীবনটা?
৩.
বিছানায় শুয়ে নোটবুক আবার হাতে নিলাম। ভিনসেন্ট আমেরিকা আসার পর গির্জা ছেড়ে দিয়েছিল। জেনিস যেত নিয়েনিয়েরিকে নিয়ে। ওদের মৃত্যুর পর জেনিস গির্জা যাওয়া বন্ধ করেনি।
এক জায়গায় লিখেছে ‘তুমি একবার ভিনসেন্টকে নিঃস্ব করেছিলে। আবার কেন? আমার নিয়েনিয়েরি তোমাকে অ্যামেজিং গ্রেস গেয়ে শোনাত। আমি তো তোমাকে ভালোবেশে ছিলাম। আমরাই কেন শাস্তি পেলাম। কেন? তোমাকে বলতে হব। তোমার কিংডমে আসব আমি। যত দিন বেঁচে আছি। তোমার সামনে বসে তোমাকে মনে করিয়ে দেব তোমার হৃদয়হীনতা। তোমার নির্দয় আচরণের শিকার আমরা তিনজন। তোমাকে দেখতে হবে। ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ আওয়ার লাভ।
আরেক জায়গায় লেখা ‘পরম পিতা, তুমি! আমার বিশ্বাস হয় না। আমার ভিনসেন্ট তো নিয়েনিয়েরির বাবা। একজন বাবা কখনো আরেক বাবাকে কষ্ট দেন না। তুমি পরমপিতা হতে পারো না।’
ধর্ম কিংবা ঈশ্বর। জেনিস কি অভিমানী? নাকি সত্যিও বিশ্বাস হারিয়েছিল।
কিছু কি বদলে গেল তাতে। জেনিস, ভিনসেন্ট আর নিয়েনিয়েরি কেউ বেঁচে নেই। ধর্ম কিংবা ঈশ্বর বেঁচে আছে। আমি বেঁচে আছি। পড়ছি জেনিসের অনুভূতিগুলো। একদিন আমরা সবাই অস্তিত্বহীন হয়ে যাব। কেউ কি পড়বে এই লেখাগুলো? আমি কি লিখব ওদের নিয়ে। কয়েক পাতা পড়লেই কি একটা জীবন বোঝা যায়?
8.
জেনিসের লেখাগুলো সব পড়তে পারিনি। বল পয়েন্ট ও পেনসিলে লেখা। অনেক জায়গায় অস্পষ্ট। দিন, তারিখ, সাল কিংবা কোথায় লেখা হয়েছে, জানার উপায় নেই।
‘স্কুলবাসে বসা বাচ্চাগুলো দেখি। তোমাকে ভাবি নিয়েনিয়েরি। তোমার কেমন স্কুলব্যাগ চাই? স্নাক্স কি নেবে? তোমার স্কুল ইয়ার বুক কেমন হতো? তোমার মা জানতে পারবে না কোনো দিন।’
‘নিয়ে—মা আমার। তুমি কি ভিনসেন্টের ওপর বা আমার ওপর কখনো রাগ করতে! আমি অনেক মেয়েকে দেখেছি রাগ করে বাড়ি ছাড়তে। ওরাও আমার মতো হোমলেস।’
‘মৃত্যুর সময় তুমি যে জামা পরেছিলে, আমি এখন আর ওই জামাতে তোমার গন্ধ খুঁজে পাই না। তোমার আর ভিনসেন্টের স্মৃতি জড়ানো সবকিছু আমি ফেলে এসেছি। কেন? জানি না। আমি কী খুঁজছি, জানি না। নিজের অস্তিত্বকে বোঝা মনে হয়। পালিয়ে বেড়াচ্ছি নাকি অপেক্ষা করছি—শেষ হয়ে যাওয়ার।’
ঠিক কোন লেখা মৃত্যুর আগে, আমি জানি না। ঠিক কোথায়, কীভাবে, কখন জেনিসের মৃত্যু হয়েছিল, আমি তা–ও জানি না। ল্যাকেশিয়া জানতে পারে। আমার জানতে ইচ্ছা করছে না।
আমেরিকাতে হোমলেস মানুষগুলোকে দেখেছি। এখানকার মানুষজন ওদের দেখলে বলে ট্র্যাম্প কিংবা বাম কিংবা হোবো। আমরা সবাই হোমলেস দেখলে একটু এড়িয়ে চলি। আমাদের কনভেনিয়েন্ট লাইফে এদের এড়িয়ে যাওয়া সহজ এবং হয়তো শ্রেয়তর।
আমি শুয়ে পড়লাম। রাত দুইটা বাজে। গুড নাইট, জেনিস।
লেখক: হায়দরী আকবর আহমেদ, কাইল, টেক্সাস