সাদেকের দিনরাত্রি
সাদেক বিছানায় শুয়ে আছে। আজ গরম কম, বাইরে বৃষ্টি। এই মেসবাড়ি চারতলা দালান। উত্তরা ছাড়িয়ে পেছনে। এখানকার লোকে বলে খালপাড়। চারপাশে অনেক কলোনি। ওর মতো অল্প আয়ের মানুষদের এখানে বসবাস। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিনের সামান্য একটা চাকরি সাদেকের। সেমিস্টার ব্রেক চলছে। দিন কয়েক ছুটি। সকালের নাশতার পরে কিছু করতে ইচ্ছা করছে না। বাড়ি থেকে ওর বাবা দুবার ফোন করেছেন। সাদেক ধরেনি, ইচ্ছা করেই।
খুব আলসেমি ধরা একটা দিন। এই ঘরের জানালাগুলো স্টিলের। বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে শব্দ হয়। টিনের চালে বৃষ্টির একটা ছন্দ থাকে। জানালায় সেই মন্দ্রসপ্তক বাজে না। সাদেক কাঁথা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিল। শব্দ আর কথার মালা মনের ঘরে জমতে দিতে হবে। গল্পের পেছনের গল্প কেউ পড়ে না। সাদেক লিখে চলছে ওর মনের ক্যানভাসে।
অফিসের কম্পিউটারে সাদেকের অনেক গল্প লেখা আছে। সাহস নেই কোথাও পাঠানোর। ছোটবেলা মানুষের ফেলে দেওয়া বোতলের ক্যাপ জমাত। মূল্যহীন কিন্তু সাদেকের শখ। এই লেখাগুলো তেমনি বোধ হয়।
মাছ ভাজা আর কলমি শাক। সঙ্গে ডাল। দুপুরে খেয়ে সাদেক রুমে এসে বসল। ওর ফোন বাজছে। ওদের ডিপার্টমেন্ট হেড। সাদেক ফোন ধরল। সন্ধ্যায় উত্তরা যেতে হবে, ওদের ডিপার্টমেন্টের একজন সহকারী অধ্যাপক কানাডা চলে যাবেন। তাঁর ফেয়ারওয়েল।
সাদেক অনেক স্বপ্ন দেখে।
সারা জীবনের জন্য বিদেশে থাকতে যাবে না ও। বেড়াতে যাবে। ওর মোবাইলে ও দেশ–বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। ইউটিউবে কত্ত দেশ ঘুরেছে। দার্জিলিংয়ের পাশে পাহাড় আর মেঘের রাজ্য সাদেকের খুব মনে ধরেছে। ইন্দোনেশিয়ায় জাভা দ্বীপে আছে একইরকম মেঘ আর পাহাড়ের প্রেম।
বর্ষা সাদেকের খুব প্রিয়। মেঘ ডাকছে। আকাশ কালো। সাদেক ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল ছটার দিকে। শিঙাড়া, সঙ্গে গরম চা। বিকেলের নাশতা শেষ করে সাদেক ঘড়ি দেখল। এখান থেকে ওই রেস্তোরাঁয় যেতে লাগবে ৩০ মিনিটের একটু বেশি। সাদেক রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। দেরি করা ঠিক হবে না।
গায়ের শার্টটা সাদেকের সবচেয়ে দামি কাপড়। গত বছর পাস করে যাওয়া ছেলেমেয়েরা ওকে দিয়েছিল। এই শার্টের দাম শুনে সাদেক অবাক হয়েছিল। তার পুরো জীবনে এত দামি পোশাক সে দেখেনি। ফুটপাথ থেকে সবকিছু কেনে সাদেক। আঙুলে গুনে বলে দেওয়া যায় ওর কয়টা শার্ট আর কয়টা প্যান্ট। উত্তরার নামীদামি রেস্টুরেন্ট। সাদেককে দাওয়াত না করলেও চলত, ডাকার দরকার ছিল না। তবু তাঁরা তাকে ডেকেছেন।
রেস্তোরাঁর নিচে সাদেক দাঁড়িয়ে আছে। এখনো কেউ আসেনি। ডিপার্টমেন্টের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সবাই আপডেট দিচ্ছে—কেউ কাছেই, কারও একটু দেরি হবে। রেস্টুরেন্টের নিচে বাটার বিশাল শোরুম। সাদেক জুতা দেখতে লাগল। এই দাম দিয়ে জুতা কেনার সাহস নেই সাদেকের। কোনো মানে হয় না। ওর পায়ের জুতা প্রায় তিন বছর হলো। দুবার নতুন সোল লাগিয়েছে। সস্তায় কাজ চলে যায়।
সাদেক আবার বাইরে এসে দাঁড়ায়। অপেক্ষা করাও তার চাকরির অলিখিত নিয়ম।
কয়েকজন এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। এ রকম জায়গায় কয়েকবার এসেছে। তাও এই চাকরির সুবাদে।
সাদেক ঘুরে ঘুরে খাবারের নামগুলো দেখে। বাফেট বলে সবাই। যেটা ভালো লাগে সেটা খাও, ইচ্ছেমতো। অনেক পদের নাম জানত না সাদেক। গত বছর ওদের ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা সবাইকে গুলশানের এক রেস্তোরাঁতে খাইয়েছিল। এ রকম অভিজ্ঞতা তার পরিবারের জন্য স্বপ্নের মতো, সাদেক ছাড়া কেউ কোনো দিন পায়নি। ওর ভাইবোন কিংবা মা–বাবা। সাদেক একদিন ওদের এ রকম খেতে নিয়ে যাবে। স্বপ্ন দেখতে কী, টাকা লাগে!
সাদেক চুপ করে বসে থাকে। অন্যদের গল্প শোনে। চারপাশে মানুষ দেখে। সবার হাসিখুশি মুখগুলো। সবার গল্পগুলো জানতে পারলে কেমন হতো? ওই জীবন তার প্রায় অচেনা। তাদের দুঃখ বা কষ্টগুলো কেমন? সাদেকের বা তার মতো সবার জীবনে অভাবটাই সবচেয়ে আপন। নিত্যদিনের। কিছুই বদলায় না। সব কষ্ট বা দুঃখের একটাই কেন্দ্র—টাকা। ওর নিজের জীবন, আর খালপাড়ের কলোনির জীবন একই রকম। ওর জীবনের পুরো গল্পটা না থাকার। অভাবের। ওর আপনজনদের গল্পগুলো একই রকম।
খাওয়া–দাওয়া শেষ। বিদায়পর্ব চলছে। সাদেক বিদায় নিল। বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে যেকোনো সময়।
মেসবাড়ির বাইরে রাস্তা ফাঁকা। বৃষ্টি হলে এমন হয়। এই কাঁচা-পাকা রাস্তায় পানি জমে। মাঝে মাঝে রিকশা, কিংবা ভ্যান, কিংবা ছোট ট্রাক উল্টে এক্সিডেন্ট হয়।
জীবন থামে না। চলতে থাকে।
সাদেক ঘরে না গিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল। মানিক মিয়ার দোকানে গিয়ে বসল। এই দোকানেই মানিকের সংসার। খালপাড়ের এই দোকানে মাঝে মাঝে রাতের বেলা সাদেক এসে বসে। মানিক কিছু বলে না।
খালপাড় থেকে উত্তরার ফ্ল্যাট বাড়িগুলো দেখা যায়। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। পা তুলে বসল সাদেক। বৃষ্টির ধোঁয়া পেরিয়ে পাহাড়ের মতো উঁচু সব অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। অগুনতি গাছের মতো মানুষ। বারান্দায় বসা মানুষ। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। ঘরবন্দী মানুষ। দিনভর কাজ শেষে ঘরে ফেরা ক্লান্ত মানুষ।
কলোনির ঘরগুলো থেকে নাটক সিনেমার ডায়ালগ আর গান টুকরা টুকরা হয়ে ভেসে আসে। ছোট ছেলেমেয়েদের চিৎকার, একটু বকুনি, একটু মার। টুকরা টুকরা কান্না। খিস্তি-খেউর।
সাদেক নিজেকে সরিয়ে নিতে চায় ওই দূরের পাহাড়ের মতো অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে যে মানুষগুলো থাকে, তাদের জীবন থেকে।
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। মানিক মিয়ার দোকানে টিনের চাল। বৃষ্টির মন্দ্রসপ্তক। সাদেক তাকিয়ে আছে দূরের জীবনের দিকে, শুনছে মেঘদের গান। মনের ক্যানভাসে লিখছে সাদেক। এই গল্পগুলো কেউ পড়বে না কোনোদিন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]