বিহ্বল সময়: পর্ব-৮
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে বড়পার বাসা মানে ফ্লোরিডা থেকে ফেরার সময় একটা ডাউস সাইজের সুগন্ধি সাবান এনেছিলাম। মানে বড়পা বা কনা কেউ একজন বিল দিয়েছিল সেদিন, সব সময় এটা হয়। ডালাস বা ফ্লোরিডাতে গেলে ওরা আমাকে নিয়ে যাবে দোকানে এবং ক্রমাগত বলতে থাকবে, ‘তোর কী কী লাগবে, কার্টে তোল, দাম দেখবি না বললাম।’ কিন্তু আমার স্বভাব আব্বার মতো, খুব দামি জিনিস কিনতে পারি না, ব্যবহার তো দূরের কথা।
যা–ই হোক, বলছিলাম সুগন্ধি সাবানের কথা। আসলে কি কেবলই সাবানের কথা বলছিলাম? ছোট এক টুকরা সাবানের সঙ্গে কি একটা জীবন জড়িয়ে নেই? একটা গোটা শিশুকাল বা একটা গোটা যৌবন বা বাংলাদেশের একটা সমগ্র মধ্যবিত্ত সমাজ? সেই বেড়ে ওঠা একটা জীবনের সঙ্গে তো একটা দেশ মিলেমিশে আছে। পাশেই ফোন সাইলেন্ট করে লিখতে বসেছি, টরন্টো শহরে এখন বেলা পৌনে তিনটা বাজে, ঢাকায় রাত দেড়টা। আমাদের মেজ মামির টেক্টস ভেসে এল, ‘ঈদ মুবারক লুনা।’
দুই চোখ ছাপিয়ে নোনা জল আসে, কেন আসে?
১৮ বছরের প্রবাস জীবনের সব ভালোবাসা কি আমরা দেশে ফেলে আসি? এই বিদেশে যাঁরা থাকেন, যাঁরা ৩০–এর পরে দেশ ছেড়ে আসেন, তাঁরা কি সবাই ঈদের দিন পার করেন বাংলাদেশে বিরামহীন ফোনে কথা বলে?
বা একটা সাবান সেই দুপুর ১২টায় দেরাজ থেকে বের করে গোসল সেরেছিলাম। তখন থেকেই মনের অন্দরে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে ফেলে আসা সবগুলো ঈদের স্মৃতি? আহ্হা, আসলেই কি সেসব দিন ছিল, এই জীবনেই? আসলেই কি এই আমিই ছিলাম ছোটবেলার সেই লুনা? ঈদ ঈদ ঈদ করে উন্মাদের মতো হয়ে থাকতাম! আর সেই কারণেই কি এখন এক নিঃসঙ্গ একাকী ঈদ এসে হাজির গত ১৮ বছর?
কবীর সুমনের একটা জনপ্রিয় গান আছে ‘চালশে’ মানে চল্লিশে এসে মানুষ কেমন বদলে যায়। এত ভীষণ সত্য সেই গান! সবচেয়ে বাহিরমুখী মানুষটাই একদিন ঘরকুনো হয়ে যায়, সবচেয়ে বেশি বক্তৃতা দেওয়া মানুষ একদিন নীরব হয়ে যায়, সবচেয়ে অগোছালো আর রাস্তা গরম করা মেয়েটা সবচেয়ে বেশি সংসারী হয়ে যায় বা সবচেয়ে মারমুখী মেয়েটা একদিন জীবনের কাছে নুয়ে থাকা শিখে যায়, জীবন তো আসলেই এমন অদ্ভুদ, তা–ই না?
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সারা বছরের দুই ঈদে আম্মা ব্যাবহার করতেন সুগন্ধি সাবান। ইম্পেরিয়াল লেদার বা আরও ছোটবেলায় যখন রংপুরে নানাবাসায় থাকতাম, আম্মা সামান্য বাড়তি টাকা দিয়ে কিনতেন ‘পিয়ারস’ নামের একটা স্বচ্ছ সাবান। উজ্জ্বল মাটিরঙা সেই সাবান বা ‘ইমপেরিয়াল লেদার’–এর এক টুকরা ঘিয়া রঙের সাবান ঈদে ব্যাবহার করা হবে, সেটা যেন একটা উৎসব।
কোনো কোনো বছর এমনও গেছে যে ঈদের তিন দিন পরে আম্মা সেই আধা ব্যবহার করা সাবান আবার তুলে নিজের ঘরে রেখে দিতেন, আবার কোনো পরব বা পার্বণে ব্যবহার করার জন্য। আমাদের নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারে একটু একটু করে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল মাত্র ২৭–২৮ বছর আগে। বড়পা যখন আমেরিকায় এল, এর পরে। বড়পা যে রক্ত বেচে সেই সময় আমাদের সাধ পূর্ণ করত, সেটা বুঝতে আমার আর কণার সময় লাগল আরও ১৫–১৬ বছর। বড়পা আমেরিকায় যাওয়ার পর থেকে ঈদে সুগন্ধি সাবানের সঙ্গে যোগ হলো কয়েক ফোঁটা পারফিউমের গন্ধ, কী অবাক শোনায়, তা–ই না?
কিন্তু যাঁরা আমাদের চেনেন, তাঁরা জানেন, এখানে একটা শব্দের উচ্চারণও মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত নয়, একদম নয়। এই তো মাত্র তিন সপ্তাহ আগে আম্মা গল্পটা করলেন। সেটা ১৯৭৫ সাল হবে মনে হয়, ভীষণ ভীষণ টানাটানির সংসার তখন আমাদের। কলেজে আব্বা যা বেতন পান, সেখান থেকে মাস শেষে সব খরচের পরে হাতে থাকে এক শ বা দেড় শ টাকা। সেই সময়েই একদিন আব্বার হাতে এল হায়দরাবাদে পড়তে যাওয়ার অফার, সরকারি অফার তো বটেই, কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে আব্বাকে বাসে করে টোটাল ৬০ টাকা খরচ করে ঢাকায় গিয়ে দরখাস্ত জমা ও অন্য কাজ সেরে আসতে হবে। কিন্তু সেই বাড়তি ৬০ টাকা কোথা থেকে আসবে?
আব্বা নাকি দুই দিন পরে হতাশ হয়ে আম্মাকে বলেছিল, ‘থাক, বাদ দাও, এই সব আর হবে না, ঢাকায় যাওয়ার টাকা কোথায় পাব?’
আমাদের কাছেই এক আত্মীয় থাকত, জহুর খালু। সেই খালুর তখন অনেক পয়সা, আম্মা দুবার গিয়ে সেই বাসায় ঘুরে এসেছে, কিন্তু লজ্জায় টাকা ধার চাইতে পারেনি। এরপর তিনবারের বার নাকি খালু নিজেই বলেছে, কী রে বুলবুলি, তুই কী বলতে চাস, বলিস না কেন? এবার আম্মা মুখ খুলে টাকাটা চাইল? সেদিনের সেই ধারের ৬০ টাকা দিয়ে আব্বা জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন করে এলেন, নিন্মবিত্ত কলেজ শিক্ষক থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সেটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট।
রেগুলার চাকরি কষ্টি থেকে আজকে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ছুটি পেয়েছি। সপ্তাহে সাত দিন কাজ করার কারণেই, কোনো দিন একটা সকালও আসে না, যেদিন আমার কাজ থাকে না। ঈদের সঙ্গে একদম কাজবিহীন এই দিনটা তাই সেরা দামি দিন।
কিন্তু কী করব এই দিনে?
বাসা শূন্য, একমাত্র ছেলে নাইয়া আসতে পারবে না, ওর ক্লাস আছে। ছোট বোন শাহিনও ক্লাসে। অতীতে ফেলে আসা ঈদের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আজকের দিন, একটা সুগন্ধি সাবানের বর্ণনা দিতে গিয়ে চলে আসে একটা জীবনের আখ্যান, কী করে ভুলে থাকি সেই সব দিন, যা ভুলিয়ে দেয় আজকের দিনের সব কষ্ট, না পাওয়া? চলবে...