বিহ্বল সময়: পর্ব-৭

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কলকাতার প্রিয় বাংলাভাষী নায়িকা রাধিকা আপ্তের মতো দেখতে গাড় শ্যামলাবরন মেয়েটা ৫৫–এর ওপর বয়সী এক বাংলাদেশি ভদ্রেলোককে বারবার করজোড়ে বলে চলছে, ‘আপনি আমাকে কথা দিন, আপনি কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই আপনার মেয়েকে সাপোর্ট করবেন, আপনার মেয়ে যদি আগামীকাল গে, লেসবিয়ান বা সেম সেক্সের একজন মানুষ হয়ে যায়, তবু আপনি আজকে বাসায় গিয়েই আপনার মেয়েকে মন থেকে বলবেন—আমার প্রিয় মেয়ে, তুমি যাই হও না কেন, তুমি যেভাবেই থাকো না কেন, তুমি যা করবে আমি সব পরিবেশেই তোমার পাশে আছি এবং আমার ১০০ ভাগ সাপোর্ট তুমি পাবে। আপনি বলুন, আপনি এই কথাটা আপনার মেয়েকে বাসায় গিয়েই বলবেন এবং আপনি জেনে রাখুন—এটাই আপনার মেয়েকে যেকোনো বিপদ থেকে বাঁচাবার একমাত্র পথ।’

কথা হচ্ছিল টরন্টো শহরের চিলড্রেন এইড সোসাইটির অফিসে বসে। গত ১৩ বছর হলো খণ্ডকালীন দোভাষীর কাজ করছি। কিন্তু আজ প্রথম এমন একটা অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করলাম, যেই চিন্তা থেকে একবারও নিজেকে বের করতে পারছি না।

আরও পড়ুন

বারবার ভাবছি কেমন আছে সেই নাম না জানা ১৩ বছরের বাচ্চা মেয়েটা? কেমন বোধ করছে ওর শরীর ও মনের ভেতরে? একজন বড় মানুষ হোক বা একটা বাচ্চাই হোক—যখন যে নিজেই জানে না তার আইডি কী, সে ছেলে না মেয়ে, তখন তার মনের ও শরীরের অনুভূতি কেমন হয়? যদিও নিজেকে একমুহূর্তের জন্য বিরতি দেওয়ার সুযোগ নেই, টানা ইংলিশ থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে ইংলিশ বলে যেতে হচ্ছে, তবু ক্ষণিকের চিন্তা এড়াই কী করে? প্রতি সেকেন্ডে ভাবনা তাড়া করছিল আচ্ছা—আজকে যদি এই বিষয়টা আমার সন্তানের হতো, আমি কী করে ডিল করতাম?

মেয়েটার বাবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঘটনা শুরু হয়েছে আরও এক বছর আগে থেকে—১২ বছরের মেয়ে আলিশা (ছদ্মনাম) ওর বাবাকে ডেকে এলজিবিটিকিউ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, কিউয়ার এবং ২ স্পিরিট) এবং এদের জীবনযাপন নিয়ে আলোচনা শুরু করে—কিন্তু একজন অতি সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত বাবা যে কি না নিজের ও ছেলেমেয়েদের একটা নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য অন্ধকার ভোরে কাজে যায় এবং সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরে বউয়ের কাছে ছেলেমেয়েদের সারা দিনের খবর নিয়ে আবার বিছানায় যায়, সেই বাবা তার ১২ বছরের মেয়ের কাছ থেকে এই অদ্ভুত এবং আমাদের কাছে যা মৃত্যুর শামিল—এমন ইস্যু নিয়ে আলোচনা কেন শুনবে?

আরও পড়ুন

মেয়ে আলাপ তোলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ধমকে উঠে বলে, ‘তুমি এসব নিয়ে আলোচনা করছো কেন? তোমার পড়াশোনা নাই? তুমি কি স্কুলে গিয়ে পড়া বাদ দিয়ে এসব শিখতেছ, নাকি গোপনে এসব ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশতেছ? ১২ বছরের আলিশা মুহূর্তেই বুঝে যায় বাবা এই অতি অচেনা ইস্যু নিয়ে কথা বলতে চান না বা মেয়ে হয়তো বাবার চোখে এই সম্প্রদায় নিয়ে একটা ঘৃণা দেখতে পায়—মেয়ে সহসাই নিজেকে আড়াল করে ফেলে।

এদিকে বাবা তো আর শঙ্কামুক্ত থাকেন না। তিনি নেট ঘেঁটে কিছু তথ্য পড়ে পড়ে বুঝতে পারেন—এটা কানাডা, এই দেশে সব জাতি–ধর্ম–বর্ণের মানুষের সমান অধিকার। একটা রাষ্ট্র এমনভাবে পরিচালনা করা হয়, যেখানে যে যত বেশি সুবিধাবঞ্চিত, সরকার তার পাশে তত শক্তভাবে দাঁড়ায়। কানাডায় গত ১৫ বছর নিউকামার ও শেল্টারে কাজ করে পরিষ্কার করে বলে দেয়—এই রাষ্ট্রে সবার জন্য সুবিধা এবং আইন সমান।

ওই যে আয়েশার কথা বলছিলাম—মনে পড়ে? নিজের নাম লিখতে না পারা আয়েশা কেবল কানাডা বলেই শেল্টার অফিসে একগাদা মানুষের সামনে বাংলায় চিৎকার দিয়ে বলতে পারে, ‘আপা, আমি এ দেশে নিজে আসি নাই, সরকার সব জাইনা–বুইঝা আমারে আনছে, আপনারা আমারে ঘর–টাকা সব দিতে বাধ্য, নাইলে আমি পুলিশ ডাকুম।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আর সেখানে তো আলিশা এই দেশে জন্ম নেওয়া কানাডিয়ান বাঙালি বাচ্চা, সবচেয়ে সৎ উপায়ে ও নিজের আইডি খুঁজে ফিরছে। কারণ, আলিশা ওর শরীরে নানান পরিবর্তন দেখতে পাবে অচিরেই, আমাদের সামনে বসেই বাবা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে সিএসএস কর্মীর দিকে—বারবার বলতে থাকে, তাহলে আমার মেয়ে আর মেয়ে থাকবে না, ও কি ছেলে হয়ে যাবে, ওকে কি এখান থেকে বের করার কোনো পথ নেই?’ যেন আলিশা কোনো খারাপ সংস্পর্শে গেছে, আর সিএসএস কর্মী বারবার বাবাকে এটাই বলার চেষ্টা করছে—আপনার মেয়ের নিজের ভেতরে চেঞ্জ পাচ্ছে, আপনি এটাকে খারাপভাবে নেবেন না দয়া করে।

সেই কালোবরন মেয়ে, যে সবচেয়ে দামি সোশ্যাল ওয়ার্কার এই শহরের, যার বয়স এখনো ৩০ পেরোয়নি, সেই মেয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলতে থাকে—প্লিজ, বাবা হিসেবে আপনি বুঝতে চেষ্টা করেন আপনার মেয়ে এখনো জানে না ওর আইডি কী? এটা একটা জার্নি। ‘এলজিবিটিকিউ’ গ্রুপের হওয়াটা কারও চয়েজ না বরং এটা হয়েই মানুষ জন্ম নেয় এবং জন্মের পরে এসব মানুষ বুঝতে পারে তারা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো করে ফিল করছে না বরং তাদের অপেক্ষা করতে হবে এই জার্নি শেষ করা অবধি, আমরা আলিশাকে নানান ধরনের প্রোগ্রামে পাঠাব—কিন্তু এই মুহূর্তে আলিশা ভীষণ ইমোশনাল হয়ে থাকবে—ওর সবচেয়ে দরকার মা–বাবার সাপোর্ট।

আমি আলিশার বাবার চোখেমুখে এক বিষণ্ন গাড় কালো ছায়া দেখতে পাই। কাজ শেষ হয়ে যায়। ভদ্রলোক আমার পিছু নিয়ে বলে—‘আপা, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতাম।’ কিন্তু আমি এক ভোঁ দৌড়ে বাস ধরে ফেলি, কারণ আমি জানি এই অফিসের অনেক দূর অবধি ক্যামেরা লাগানো আছে, যদি অফিস দেখে আমি কাজ শেষে ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলছি—আমার ক্ষতি ছাড়া কিছুই হবে না। জীবন এক বিহ্বল পথও বটে, যেখানে সবাইকে জার্নি শেষের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। চলবে...

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]