বিহ্বল সময়: পর্ব–৬
আসলেই যেন প্রতিটা অফিস–দিন বিহ্বল হয়েই পার হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং ভাবলে খুব চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করি, ১৫ বছর হলো কাজ করছি ‘নতুন অভিবাসীদের’ নিয়ে। প্রথম আট বছর সেটেলমেন্ট সেক্টরে, পরের সাত বছর ‘রিফিউজি রি-সেটেলমেন্ট প্রোগ্রামে’, কিন্তু একদিন তো সবকিছু থেকে বিদায় নিতে হবে, অবশ্যই নিতে হবে, হয়তো সহসাই নিতে হতে পারে। আগামীকালের কথা কে বলতে পারি আমরা?
যদি সত্যিই অনেক দিন হায়াত পাই, সেদিন কি আজকের লেখাগুলো পড়লে ভালো লাগবে?
শেষ লেখায় বলছিলাম আয়শার কথা। কী করে লেবানন থেকে কানাডা অবধি এসেছে এবং সেখান থেকে কী করে এই ইমার্জেন্সি শেল্টারের টেবিল অবধি এসেছে।
জীবন এক বিচিত্র জার্নি তো বটেই, কিন্তু জার্নিটা যে করে তার কাছে বুঝি অতটা বিচিত্র লাগে না। কারণ, তাকে তার বাঁচা–মরা–টিকে থাকার সঙ্গে ক্রমাগত লড়ে যেতে হয়। আয়শা আপা যখন টেবিলের ওপারে বসে থেকে তার কথাগুলো বলে যেতে থাকে, যতটা অবাক এপাশ থেকে হই ততটা অবাক কি তিনি হন? হলে কি তিনি এত সাবলীলভাবে বলে যেতে পারতেন নিজের কথা?
বাংলাদেশ থেকে লেবাননে গিয়েছিলেন ‘হাউস মেড’ হিসেবে। সোজা বাংলায় কাজের মেয়ে, সেখানে তিন বছরেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপরে শুরু হয় পুলিশের দৌড়ানি। আয়শার বয়ানে—‘লেবাননে তিনবার জেলে গেছি, না খায়া থাকছি, তবু দেশে ফেরার কথা ভাবি নাই, ভাবতে পারি নাই, কার কাছে যামু, মায়ে–বাপে তো আমার টাকার দিকে পথ চায়া থাকে, ওইখানে আমার মাইয়া বড় হইতাছে, তারে টাকা পাঠানো লাগে না? কি জুলুম এই জীবনের ওপরে। আমার মতো অনেক বাঙালি মহিলা আছে যারা সারা জীবন কাম করতাছে, এইভাবেই জীবন যাইব তাগো। কিন্তু দ্যাহেন আপা, আমারে একজন কইল তুই ওই ইথোপিয়ান মুসলিম ব্যাটারে বিয়া কর, তোর কানাডার কাগজ হইয়া যাইব। বাঁচনের জন্য সেই কাম করলাম আপা।’
এখানে একটু পেছনে ফিরি।
২০১২ সালে আরও একটা ইমার্জেন্সি শেল্টারে ৯ মাসের জন্য কাজ করেছিলাম। সেখানে একজন বাংলাদেশি কুমিল্লার লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, গ্রামের হিন্দু–মুসলিম কোন্দলকে কেন্দ্র করে সেই লোক হংকংয়ে পাঁচ বছর ছিল। সেখানে আইআরসির (ইন্টারন্যাশনাল রিফিউজি সেন্টার) একটা অফিস আছে এবং সেখানে ক্যাম্প করে করে বিশ্বের বহু মানুষ কানাডায় আসার জন্য পাঁচ–ছয় বছর বা তার চেয়েও বেশি দিন অপেক্ষা করে থাকে এবং কুমিল্লার সেই লোক নাকি সেখানে বাদামও বিক্রি করেছে বেঁচে থাকার জন্য।
আয়শা আপা যখন লেবাননে তার ইথিওপিয়ান স্বামীর সঙ্গে পাঁচ বছরের অপেক্ষার গল্প করছিল, তখন আমি ২০১২–তে ফিরেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য।
আয়শা ও তার স্বামী ইসমাইল কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে এসে শেষ অবধি পৌঁছায় ২০২১ সালে, তখন ইতিমধ্যে আয়শা আরও দুই সন্তানের মা। সেখানে ওরা সরাসরি হোটেলে ওঠে। এবং এ ধরনের শরণার্থীর জন্য সব ব্যবস্থা সরকার আগে থেকেই করে রাখে, যেমন এখন এ ধরনের সুবিধার আওতায় প্রচুর ইউক্রেনিয়ান শরাণার্থী কানাডায় ঢুকছে, আরও ঢুকতে থাকবে। দোভাষীর কাজের অভিজ্ঞতায় জানি বিশাল একটা রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে কানাডায় এসেছে।
কিন্তু এই যে মানুষ আসছে, এরা কানাডায় ঢুকেই সরকারি সুবিধা কী করে পাবে? কোথায় উঠবে? কী করে সরকারি সুবিধার সঙ্গে নিজেদের অ্যালাইন করবে? ভাষার সমস্যা থাকলে সেটা কারা দেখে দেবে? এমনকি এই যে জীবনের টালমাটাল অবস্থায় যদি স্বামী–স্ত্রীর ঝগড়া বা মারামারি হয় (যা আসলেই হয়) তাহলে সেই নারী বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় যাবে? এসব শরণার্থী হাতে লিগ্যাল পেপার পেতে পেতে তিন–চার বছর অবধি লাগে, তখন তারা কী করবে? কোথায় খাবে? ভাষার সমস্যার জন্য অনেকে এক লাইনও কথা বলতে পারে না, তারা কী করবে? বাচ্চারা কী করে স্কুলে ভর্তি হবে? কানাডার মূল সিস্টেমের সঙ্গে এদের পরিচয় হতে কত দিন লাগবে? এই সাময়িক সময়ে তাদের জন্য সরকার যা ব্যবস্থা রেখেছে সেটা কারা অ্যাড্রেস করে দেবে?
এমন হাজারো সমস্যার সমাধান কে দেবে?
এমনই এক দিশেহারা অবস্থায় আয়শা পড়েছিল। সেই গল্পে আবার ফিরব বিহ্বল সময়ের কাছে ফেরার জন্য, আরও একটু অপেক্ষা থাকুক, কাল আবার আয়শা আসবে, খুব ভোরে অফিসেও যেতে হবে। চলবে...
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]