সিডনি থেকে হ্যালিফ্যাক্স: ষষ্ঠ পর্ব

আপাতত কেপ ব্রেটনের সিডনি শহর ছেড়ে আমরা প্রাণকেন্দ্রের দিকে এগোচ্ছি। আলাপনে নোভাস্কোশিয়ার রাজধানী হ্যালিফ্যাক্স শহর নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রাম মাস্টার অব সায়েন্স বিজনেস (Master of Science in Business)-এর ছাত্র প্রান্ত কুমার কুরি।

আমাদের কথোপকথনের অংশ তুলে ধরছি:

অতনু: হ্যালিফ্যাক্সে শুরুর দিনগুলোতে যদি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।

প্রান্ত: শুরুর কথা বলতে গেলে আমরা হ্যালিফ্যাক্স স্ট্যানফিল্ড বিমানবন্দরের কথা দিয়েই শুরু করি। আমি যখন বিমানবন্দরে নামি, তখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। নামার পর আমি ওখানেই দুই ঘণ্টা বসে কাটিয়েছি। কারণ, শহর সম্পর্কে বা কোথায় যাব, এটা নিয়ে কোনো স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। আমি আসার আগে অনেকের সঙ্গে বাসার ব্যাপারে যোগাযোগ করি। দুর্ভাগ্যবশত ওনারা কেউই তেমন একটা সাহায্য করতে পারেননি। এসব ক্ষেত্রে এয়ার বিএনবি করা ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না। দিন সাতেকের জন্য একটা ঘর ভাড়া করি। আমার পরিচিতজনেরা অধিকাংশই টরন্টো আর ভ্যাঙ্কুভারে থাকেন।

এয়ারপোর্টে এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে সময় কাটছিল। এখানকার রাত সাড়ে ১০টা মানে অনেক রাত। কীভাবে ট্যাক্সি ডাকব, কোথায় ট্যাক্সি স্ট্যান্ড কিছুই তো চিনি না। কাজেই ওভাবেই ঘুরতে লাগলাম।

আমার টরন্টোর বন্ধুকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করি। ও উবারে ভাড়া করে দিত কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাদ সাধল আমার লাগেজের সংখ্যা! আড়াই ঘণ্টা পরে একজনকে পাই যিনি আমাকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড দেখিয়ে দেন। ওভাবেই বাড়ি ফেরা হলো।

এরপর আসি বাসাভাড়া করার বিড়ম্বনার কথায়। আমার সঙ্গে এক বন্ধুও ছিল। আমরা একসঙ্গেই বাসা দেখছিলাম। এয়ার বিএনবির সাত দিনের মেয়াদ ফুরানোর আগেই বাসা খুঁজে বের করতে হবে। আমরা অনলাইনে এবং সশরীর গিয়ে খোঁজ করে মোটামুটি নিরাশ হয়েই ফিরেছি। যখন আমাদের ঘরের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে, তখন এক বাসার সন্ধান পাই। খটকা লাগল যখন ওই বাসার সংযোগকারী ব্যক্তি জানান যে বাসা দেখা যাবে না কিন্তু ভাড়া পাওয়া যাবে ৫০০ ডলার অগ্রিম করলে, এই শর্তে! এটা আবার কেমন কথা? সময়টা হচ্ছে ২০২৩–এর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। হাতে আমাদের সময় বেশি নেই। আমরা বিষয়টা নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হলেও নিরুপায় হয়ে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখলাম। শেষমেশ যেদিন বাসায় ওঠার কথা, ওই দিন বারোটা নাগাদ সময় দেওয়া থাকলেও সন্ধ্যা হয়ে গেল। তারপর আগের বাসা থেকে ওরা নামিয়ে দিয়ে যায় নতুন ঠিকানায়। আমরা তো গৃহ প্রবেশের আগেই মহাখুশি! ভেতরে গিয়েই আমাদের চক্ষু ছানাবড়া! কানাডায় এসে আপনি যদি পান বিদ্যুৎবিহীন একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। তখন আপনার মনের অবস্থা কী হবে, ভেবে দেখুন! তার ওপর দেখি ঘর বেজমেন্টে। বিদ্যুৎ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে জানতে পারলাম কারেন্ট আসতে সময় লাগবে আরও দুই দিন। এটাই কানাডায় আসার পর আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।

অতনু: আসলেই কিছুটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!

এরপর আমাদের বলো, বাসার খোঁজার প্রক্রিয়াটা কেমন? কীভাবে বাসা পাওয়া যায়? অভিবাসী ছাত্রছাত্রীদের কানাডার আসার পর বাসস্থানের নিশ্চয়তার পাশাপাশি যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি দেয়, তা হলো কর্মসংস্থান। সেটার যাত্রাপথ কেমন ছিল?

প্রান্ত: বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কিছুটা ধারণা হয়তো সবাই আমার এতক্ষণের কথাবার্তায় বুঝতে পারবে। তবে আরও বিস্তারিত বলতে গেলে, আমরা খোঁজা শুরু করেছিলাম ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে। অনেক ভিডিও ইন্টারভিউও দিয়েছি। কিন্তু হয়নি। বাসস্থানের সংকট পুরোনো আর এই সংকট ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। বাসাভাড়াও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমে আমরা যখন নতুন এসেছিলাম, তখন আমাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছিল ফেসবুকে। আমরা ঠিক করি সবাই মিলে একসঙ্গে বাসা নিয়ে থাকব। কিন্তু পরে সেটা আর সম্ভব হয়নি। মূলত বাসা নেওয়ার সময় ওরা ব্যাংক হিসাবে ক্রেডিট স্কোর চেক করে। সেটা আমাদের কারও ভালো ছিল না। ক্রেডিট স্কোর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। নবাগতদের ক্ষেত্রে এটা কঠিন। তাই যে যার মতো বাসা ম্যানেজ করেছি। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, অনেক ভিডিও ইন্টারভিউ দেওয়ার পর হয়তো এক বা দুটো পজিটিভ হতো। তবে পরবর্তীকালে যে বাসায় আমরা উঠি (কারেন্ট নেই) সেটাতে তিনজন ভারতীয় ছাত্র থাকত। ওরা আসলেই ভালো ছিল। সবাই হরিয়ানা থেকে আসা। তখন অবশেষে মনে হয়েছিল, কানাডায় একটা ঠিকানা পাওয়া গেল আর কিছু ভরসার মানুষও।

আরও পড়ুন

এদিকে আমার ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে আশপাশের জানাশোনা মানুষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেল। আমার যে প্রোগ্রাম ছিল সেটাতে হাতে গোনা কিছু ছাত্রছাত্রীকে নেওয়া হতো। ওই ব্যাচে নেওয়া হয়েছিল ১৫ জনকে। ওখানে গিয়ে দেখি আমরা দুজন মাত্র বাংলাদেশি। আবার ওই ১৫ জনকে ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী আরও গ্রুপে ভাগ করা হয়। একেক গ্রুপে সদস্যসংখ্যা ৩ থেকে ৪। তবে একটা বিষয় খুবই ভালো লেগেছে, এখানকার প্রফেসরদের ব্যবহার। ওরা মাস্টার্স করতে আসা ছাত্রছাত্রীদের নিজের সহকর্মী হিসেবে দেখেন। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে গেলে ব্যাচেলর করতে আসা শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে বিদায় নেয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা ছিল না। আমাদের প্রফেসর সব সময় আমাদের পাশে এমনভাবে ব্যবহার করতেন যেন আমি ওনার কলিগ এবং পড়াশোনা শেষে ওনার সঙ্গে একই অফিসে কাজ করব। পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ, বিভিন্ন বিষয়ের আদান-প্রদান অনেক পরিপক্ব এবং গোছানো বলতে হবে। ক্লাস তিন-চারজনের হওয়ায় উনি খুব ভালোভাবেই আমাদের জানেন এবং এটাও জানেন আমরা কে কী পারব বা পারি না। মূলত এই প্রোগ্রামের স্কলারশিপের কারণেই জবের জন্য আমাকে অতটা ভুগতে হয়নি। রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করেছি। তবে এরও আগে যখন এটা শুরু হয়নি তখন আমি আর রুমমেট দুজনে মিলে প্রায় ৫০-৬০টি রেজিউমে বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে স্প্রিং গার্ডেন এলাকায় দেওয়ার পর আশা ছিল অন্তত কল তো পাব। সপ্তাহখানেক অপেক্ষার পরও কোনো কল পাইনি! অনলাইনেও অ্যাপ্লাই করেছিলাম। আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনায় বলতে হবে কানেকশন না থাকলে চাকরি হয় না। এখানেও শুরুতে সেটাই দেখেছি। এক মাসের অনেক চেষ্টার পরও ফলাফল ছিল শূন্য। এ ক্ষেত্রে আমি সৌভাগ্যবান কারণ এর পরেই টিচার্স অ্যাসিস্টেন্টশিপ শুরু হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

তাই জবের জন্য আমাকে অন্যদের মতো আর হন্যে হয়ে দৌড়াতে হয়নি। অন ক্যাম্পাস জবের আরও সুবিধা এই যে ওদের বেতন ভালো। চার মাস ওখানে কাজ করার পর ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে ডেটা ফেচের (ডাউনলোড, ক্লিন, এরপর রিসার্চ অ্যানালাইসিসের জন্য ডেটা তৈরি করা) কাজ দেওয়া হয়। ওরা তত দিনে জানে আমি কোন কোন কাজে দক্ষতা অর্জন করেছি। সেই হিসেবেই কাজ অফার করা হয়েছিল। প্রথম সেমিস্টারে এটাই কাজ ছিল। দ্বিতীয় সেমিস্টারে যাওয়ার দুটি টিয়ারশিপ পাই, দুটি মার্কারশিপ পাই। কাজেই তখন আমার কাজের কোনো অভাব হয়নি। চার–পাঁচটা কাজ করছি, সবই ইউনিভার্সিটির ভেতরে অন ক্যাম্পাস জব। দুটি টিয়ারশিপ, দুটি মার্কারশিপ আর একটা টিচার্স অ্যাসিস্টেটশিপ আর ভলেন্টিয়ার (ফিড নোভাস্কোশিয়া) হিসেবেও কাজ করেছি ওই সময়। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করেছি। দেশে থাকার সময়েও আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলান্টিয়ার কাজে যুক্ত ছিলাম। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকাটা জরুরি। এতে রেজিউমে প্রোফাইল উন্নত হয়। তখন এত পড়াশোনার চাপ থাকা সত্ত্বেও আমি ফিড নোভাস্কোশিয়ায় যেতাম এবং নিজ সময়ানুযায়ী তিন থেকে চার ঘণ্টা কাজ করতাম।

অতনু: বাহ! বেশ কিছু চমৎকার অভিজ্ঞতা। এখন আমাদের বলো, পড়াশোনার বিষয়ে। কীভাবে অধ্যাপকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে? অবশ্যই এটা একদিনের বিষয় নয়। পুরো ব্যাপারটা কেমন ছিল?

প্রান্ত: হ্যাঁ। আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে এখানকার অধ্যাপকেরা কিছুটা অন্য রকম আচরণ করতেন। যেহেতু আমাদের সঙ্গে ওনাদের সম্পর্কটাই ছিল সহকর্মীসুলভ। অতএব এটাই ভাবতেন আমরা সবকিছুই জানি। কিন্তু মূল ঘটনা অনেকের ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীত ছিল। ক্রমশ....

* দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]

আরও পড়ুন