কানেকটিকাট, দ্য স্টেট অব কনস্টিটিউশন

কনস্টিটিউশনাল প্লাজার সামনে লেখকছবি: লেখকের পাঠানো

১.

পিটার প্যানের বাসটা হার্টফোর্টে এসে থামতে না–থামতেই দেখি সাজু সেখানে দাঁড়িয়ে। পিকআপ জোনে গাড়িতে অপেক্ষায় সাজুর হাজব্যান্ড স্বপন ভাই।—আপনাদের কিছুতেই কন্ট্যাক্ট করতে পারছিলাম না। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কতবার যে ফোন করেছি।

সেলফোনে তাকিয়ে দেখি অসংখ্য মিসকল। মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে। দুজনেই ক্ষণে ক্ষণে ফোন করেছেন, মেসেজ দিয়েছেন। তার মধ্যে শামীম শাহেদের ফোনও আছে। শামীম শাহেদ আমাদের প্রথম আলোর সহকর্মী, অভিনেতা, নায়ক। এখন থাকেন নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাস ছাড়ার খবর দিয়েছিলাম। অপরিচিত শহরে আমাদের কোনো সমস্যা যাতে না হয়—সেই ভাবনা থেকেই সবার বারবার ফোন করা।

আসলে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম। পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই টের পাই ফোনের চার্জ একেবারে তলানিতে। হার্টফোর্টে বাস থেকে নামার পর স্বপন ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কারণ, তাঁরা সেখান থেকে নিয়ে যাবেন। চার্জ শেষ হয়ে গেলে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করব কীভাবে? তাঁরাই–বা আমাদের খুঁজে পাবেন কীভাবে—সেই চিন্তায় ফোন বন্ধ করে রাখা। বাসে যে প্রতিটি সিটের সঙ্গেই ফোন চার্জ করার ব্যবস্থা আছে, সেটা জানা থাকলে ফোনের চার্জারটা হয়তো হাত–ব্যাগেই রেখে দিতাম। এখন আর কিছুই করার নেই। কারণ, চার্জারটা লাগেজে—বাসের নিচে লাগেজ কম্পার্টমেন্টে।

২.

বিদেশ বিভুঁইয়ে যোগাযোগের একটা উপায় থাকা জরুরি, সে ক্ষেত্রে মুঠোফোনটা অপরিহার্য। অনেকেই ফোনের রোমিং সার্ভিস ব্যবহার করেন, তবে সেটি অবশ্যই ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় বেড়াতে আসা অনেককেই দেখেছি এখানে এসেই একটা সিম কিনে নেন। মানে নতুন ফোনের কানেকশন, স্থানীয় নম্বর। তবে এখনকার যোগাযোগ বিশেষ করে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অধিকাংশই মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে। সে ক্ষেত্রে দরকার হয় মোবাইল ডেটার। বিমানবন্দরগুলোয় ফ্রি ওয়াইফাই থাকে, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার পর ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে ফোন থাকাটা দরকারি।

আমার সেলফোনে রোমিং সার্ভিস আগে থেকেই ছিল, প্রতিদিন ১৬ ডলার, কিন্তু সেটাও অতিরিক্ত লাগে। যেই প্রোভাইডারের সার্ভিস ব্যবহার করি, তাদের অবশ্য ‘রোমিং ট্রাভেল পাস’ নামে নতুন আরও একটা সার্ভিস আছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ১৪ দিনের খরচ ৬০ কানাডিয়ান ডলার আর ৩০ দিনের জন্য ৭০ ডলার। দেশভেদে এই খরচটা ভিন্ন ভিন্ন। রোমিংয়ের চেয়ে এটার খরচ কম। সাজু অবশ্য একটা ডেটা সার্ভিসের লিংক পাঠিয়েছিল, খুবই অল্প পয়সায় ডেটা প্ল্যান নেওয়া যায়। এতে সুবিধা হচ্ছে ডেটা থাকায় হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে সংযুক্ত থাকা যায়।

সাজুর প্ল্যানটা সস্তা হলেও আমার বিবেচনায় ছিল অন্য কিছু। বর্ণমালা বাসায় একা থাকছে, কথামালা ইউনিভার্সিটির ডর্মে। মেয়েরা যেন যেকোনো সময় কথা বলতে পারে, ফলে ট্রাভেল পাসটাই ভালো বিবেচনা করলাম। আর সেরীন যেহেতু তার অফিসের ফোনই ব্যবহার করে ফোনের সিকিউরিটি রিজনে বাইরের কিছু সেটিতে ব্যবহার করা যায় না। কাজেই একমাত্র সবেধন নীলমণি মোবাইলের চার্জ বাঁচানোটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বাসে যে ফ্রি ওয়াইফাই আছে, সেটি আমরা জেনেছি অনেক পরে, ততক্ষণে আর সেরীনের মুঠোফোন ব্যবহার করার মুড ছিল না। পথে একটা সময় অবশ্য সেরীন টেক্সট করে সাজুকে সম্ভাব্য সময়টা জানিয়ে দিয়েছিল। সে অনুযায়ী সাজু আর স্বপন ভাই বাসস্টপে এসে হাজির।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেরই একটা করে ডাক নাম আছে। কানেকটিকাটের যেমন কনস্টিটিউশন স্টেট, নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট, ফ্লোরিডার দ্য সানশাইন স্টেট, টেক্সাসের দ্য লোন স্টার স্টেট। প্রতিটি গাড়ির নম্বর প্লেটে নম্বরের পাশাপাশি স্টেটের ডাক নাম লেখা থাকে।

৩.

বাসটা থামল কানেকটিকাটের রাজধানী শহর, একেবারে ডাউনটাউনে, হার্টফোর্টে। পৃথিবীখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের বাড়ি এই হার্টফোর্টে, মিউজিয়াম বানানো হয়েছে বাড়িটাকে। আমাদের দেশে কোনো লেখকের বাড়ি কি মিউজিয়াম হয়েছে! হুমায়ূন আহমেদের নূহাশপল্লীর কথা মনে এলো। কিন্তু সেটি কি লেখকের বাড়ি! মার্ক টোয়েন এই বাড়িতে বসেই রচনা করেছেন অমর কতগুলো উপন্যাস। কানেকটিকাটে এলে মার্ক টোয়েনের বাড়ি না দেখে যাওয়া যায় না। আমরা অবশ্যই যাব এবং তখন এ নিয়ে বিস্তারিত লিখব।

তবে এই হার্টফোর্টের আরও একটি পরিচিতি আছে—ইনস্যুরেন্স ক্যাপিটেল অব দ্য ওয়ার্ল্ড, বিশ্বের ইনস্যুরেন্স রাজধানী। হার্টফোর্ট নামে ফরচুন-৫০০ এ তালিকাভুক্ত একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিও আছে এই শহরে। ১৯ শতকে বেশ কয়েকটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানি হাটফোর্টে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে এই ইনস্যুরেন্সখাত স্থানীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে ওঠে। সেই সময়ই হার্টফোর্ট ‘ইনস্যুরেন্স ক্যাপিটেল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে বিশ্বের দেড় শতাধিক বড় ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অবস্থান এই শহরে, ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যবসা তাদের।

আরও পড়ুন

৪.

‘তাহলে আমরা ডাউনটাউনটা একটু চক্কর দিয়ে যাই? রাতের ডাউনটাউনটাও দেখা হয়ে যাবে।’—স্বপন ভাইয়ের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা পরিব্রাজক, ঘুরে বেড়ানোই আমাদের কাজ। সেই কাজটা কানেকটিকাটে পা দিয়েই যদি শুরু হয় ক্ষতি কী! স্বপন ভাইয়ের পাশে বসে বসে আমি রাতের হার্টফোর্ট শহরটা দেখতে থাকি।

স্বপন ভাই মানে সুয়েলুর রহমান স্বপন আর সাজেদা চৌধুরী দুজনেই সিলেটের বাসিন্দা। স্বপন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। আর সাজু জাহাঙ্গীরনগরের সেরীনের বন্ধু। কানেকটিকাটে আছেন অনেক বছর, বাড়িঘর করে পরিবার–পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে স্বপন ভাইয়ের আরও কয়েক ভাই, বোন, মা–ও এইখানে থাকেন। বলা যায় পুরো সিলেট নিয়েই তারা কানেকটিকাটে বসবাস করছেন।

হার্টফোর্ট যেহেতু রাজ্যের রাজধানী—ডাউনটাউন মানেই হচ্ছে বড় বড় অট্টালিকা, করপোরেট হাউসের সদর দপ্তর কিংবা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সদর দপ্তর তো আকাশচুম্বী অট্টালিকা না হয়ে যায় না। গুডউইন স্কয়ার, হার্টফোর্ট বিল্ডিং, ট্রাভেলার্স টাওয়ার, ফনিক্স লাইফ ইনস্যুরেন্স বিল্ডিং, স্টেট হাউস স্কয়ারের আকাশমুখো ভবনগুলো রাতের শহরটায়ও যেন ভিন্ন রকমের একটা আবহ তৈরি করে রেখেছে। স্বপন ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন আর নানা ভবনের সামনে গাড়ির গতি খানিকটা কমিয়ে সেই ভবনের ইতিবৃত্ত বলে যাচ্ছেন।

সাজু-স্বপন ভাইয়ের বাড়িতে আমরা
ছবি: লেখকের পাঠানো

সামনের একটা বিল্ডিং দেখিয়ে স্বপন ভাই জানান—এটা কনস্টিটিউশন বিল্ডিং। পাশেই দেখি বড় একটি ভবনের গায়ে লেখা কনস্টিটিউশন প্লাজা। এই শহরের মানে কানেকটিকাটের একটা ডাকনাম আছে—‘কনস্টিটিউশন স্টেট’। স্বপন ভাইয়ের কথা শুনে নড়েচড়ে বসি। কানেকটিকাট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টেট বা রাজ্য। মানুষের ডাক নাম থাকে, রাজ্যেরও ডাক নাম আছে—তথ্য হিসেবে এটা খুবই চমকপ্রদ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেরই একটা করে ডাক নাম আছে। কানেকটিকাটের যেমন কনস্টিটিউশন স্টেট, নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট, ফ্লোরিডার দ্য সানশাইন স্টেট, টেক্সাসের দ্য লোন স্টার স্টেট। প্রতিটি গাড়ির নম্বর প্লেটে নম্বরের পাশাপাশি স্টেটের ডাক নাম লেখা থাকে। তাঁর কথা শুনতে শুনতে সামনের গাড়িগুলোরি নম্বর প্লেটের দিকে তাকাই। সামনের গাড়িটার নম্বর প্লেটে স্পষ্ট দ্য কনস্টিটিউশন স্টেট। দ্রুত পাশ কেটে যাওয়া একটা গাড়ির প্লেটে ‘দ্য স্পিরিট অব আমেরিকা’। স্বপন ভাই জানালেন—এটি ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের গাড়ি।

কানেকটিকাট কেন ‘দ্য কনস্টিটিউশনাল স্টেট’ জানার আগ্রহটা প্রবল হয়ে ওঠে। স্বপন ভাই জানান—এইখানে, মানে এই রাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান রচিত হয়েছিল, সেই কারণে এই রাজ্যের নাম দ্য কনস্টিটিউশন স্টেট। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পশ্চিমের প্রথম লিখিত সংবিধান এই কানেকটিকাটে হয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান যে সংবিধান অনুসৃত হয়, সেটিতেও এই কানেকটিকাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

১৯৩৯ সালের কথা। কানেকটিকাট তখনো ব্রিটিশ কলোনির নিয়ন্ত্রণে। সেটেলারদের মধ্যে যাঁরা নেতৃস্থানীয় তাঁরা বেঁকে বসলেন—ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে নয়, তাঁরা কীভাবে চলবেন, সেটি তাঁরা নিজেরাই ঠিক করবেন। সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা ‘ফান্ডামেন্টাল অর্ডার অব কানেকটিকাট’ নামে একটি গাইড লাইন তৈরি করে। এটি অনেকটা শাসনপদ্ধতির লিখিত রূপ। এই দলিল অনুসরণ করেই কানেকটিকাটের শাসনব্যবস্থার বিকাশ ঘটে যেটি পরবর্তী সময়ে সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয়। আর ১৯৫৯ সালের দিকে কানেকটিকাটের রাজ্য সংসদে রাজ্যের ডাক নাম হিসেবে ‘দ্য কনস্টিটিউশন স্টেট’ অনুমোদন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচনায়ও এই দলিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন কনস্টিটিউশন কনভেনশন ডাকে—সেখানে কানেকটিকাটের প্রতিনিধি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন রজার শারমেন এবং অলিভার এলসওর্থ। তারা সেই সময় দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করেন। যেটি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে গ্রহণ করা হয় এবং এখনো বলবৎ আছে।

ডাউনটাউনে চক্কর খেতে খেতে কানেকটিকাটের ইতিহাসে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা স্বপন ভাই-সাজুদের ম্যানচেস্টারের বাড়িতে পৌঁছে যাই। কাল থেকে শুরু হবে আমাদের ‘অপারেশন কানেকটিকাট’। চলবে...

আরও পড়ুন