মোহিনী: পর্ব ৪
গোসল সেরে নাশতার পর আয়েশ করে চা হাতে বারান্দায় বসল। দেখল বেশ কয়েকটি কল এসেছে অপরিচিত নম্বর থেকে। অপরিচিত নম্বরে ফোন করবে কি না, বুঝতে পারছে না। তা ছাড়া এখন কোনো ফোন করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। হঠাৎ মনে হলো মোহিনী নয় তো? সে সঙ্গে সঙ্গেই সেই নম্বরে ফোন করল, ওপার থেকে ভেসে এল মায়াবিনী কণ্ঠ, হ্যালো! তারপর বললো, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, লেখার চেয়ে কথা বলাই সহজ।
মাসুদ অবাক হয়ে বলল, তোমার এ ফোন নম্বর তো আমার কাছে নেই। হ্যাঁ, এটাই আমার ফোন নম্বর। আগেরটি মুছে ফেলুন, আবার যদি আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তাহলে বুঝবেন আমি আপনার জীবনে আসার জন্যই এসেছি। মাসুদ বলল, ঠিক বুঝলাম না। মোহিনী বললো, আমি আপনাকে আমার অন্তর দিয়ে ভালোবাসি, তার মানে এই নয় যে আমি নিজেকে আপনার জীবনের সঙ্গে জড়াব। মাসুদ অবাক হয়ে বলল, মানে কি? বাধা কোথায় ? মোহিনী বলল, আমি আমার সম্পর্কে যে কথাগুলো আপনাকে বলব, তা আমার অনেক আগেই বলা উচিত ছিল, তাহলে হয়তো আপনি আমার দিকে এমন ভাবে আগাতেন না। তারপর বলল, আমি আমার জীবনের গল্প বলব, আমার গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুধুই শুনে যাবেন কোনো কথা বললে, আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলব। আপনি, প্রস্তুত? মাসুদ বললো, অবশ্যই, বলো আমি প্রস্তুত। মোহিনী আমার ছদ্মনাম। সব নায়িকারা চিত্রজগতে এসে যেমন নাম বদলায়, তেমনই আমাকেও বদলাতে হয়েছিল। আমার আসল নাম নিপা রহমান নূপুর। আমি এখন যে কথাগুলো বলব, তারপরেও যদি আমার সঙ্গে আপনি যোগাযোগ রাখেন, তাহলে আপনি আমাকে নিপা বা নূপুর—যেকোন নাম ডাকুন না কেন আমাকে, কখনোই মোহিনী বলে ডাকবেন না।
তারপর সে তার জীবনের গল্প শুরু করল, ছোটবেলায় আমার বাবা, মাকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়। তার শোকে মা পাগলপ্রায়। আমার মামা, বাবার খোঁজে পাগলের মতো ছুটে বেড়ালেন কিন্তু অনেক দিন তার কোনো হদিস মিলল না। প্রায় তিন বছর পর খবর পেলেন সে মফস্সল শহরে কোনো এক প্রতাপশালীর মেয়েকে বিয়ে করে সেখানে শ্বশুরের ব্যবসা দেখাশোনা করছে। তার শ্বশুরের ভয়ে সবাই সেখানে এক ঘাটে জল খায়। সে কারণে নিরীহ মামা তাকে আর ঘাঁটানোর/// সাহস করেন নি। মায়ের কানে সে কথা পোঁছাতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। ফলে তার মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে অজ্ঞান অবস্থায় দুই সপ্তাহ পরে হাসপাতালে মারা যান। আমার বয়স তখন ৯ বছর। মামার বাড়িতে আশ্রিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আমার মামি আমার উপস্থিতি মোটেও পছন্দ করেননি। বাড়ির কাজের মেয়ের মতো আমি সেখানে আশ্রিতা ছিলাম।
নিরীহ মামা সব দেখেও মুখ বুজে সহ্য করতেন। আড়ালে আমাকে কাছে টেনে আদর-স্নেহ করতেন, সান্ত্বনা দিতেন, আর নীরবে অশ্রু মুছতেন। অসহায় মামাকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো। গভীর রাত পর্যন্ত মার জন্য, মামার জন্য কাঁদতাম। এ কান্না ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আক্কাস আলী নামে মামির দূরসম্পর্কের আত্মীয়, সৌদি আরবে চাকরি করতেন। প্রতিবছরে বাংলাদেশে এলে মামার বাসায় উঠতেন। কত রকম জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন। আমার দেহে যখন নারীত্বের ছাপ সুস্পষ্ট, আদরের নামে আমার সঙ্গে অশ্লীলতা করতে ছাড়েনি। আমার বয়স যখন ১৬, তখন তিনি আমার মামিকে প্রস্তাব দিলেন আমাকে বিয়ে করার জন্য। মামা রাজি ছিলেন না। কিন্তু মামীকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করলেন। একদিন সকালে ঘুম থেকে ডেকে মামি বললেন, আজ তোমার বিয়ে। এ যেন ‘উঠ ছেমরি তর বিয়া।’ আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি বললেন আক্কাস আলীর মতো এমন স্বামী তোর কপালে জুটেছে এ তোর বাপের জন্মের পুণ্যি। আক্কাস আলীর নাম শুনেই আমি ভীত হয়ে পড়লাম। আমার মানসপটে ভেসে উঠলো তার কামাতুর দুই চোখ। আমি কেঁদে ফেললাম। মামা অসহায়। সেদিন জোর করে আমাকে আক্কাস আলীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হলো। সেই বিভীষিকাময় বাসর রাতের কথা মনে পড়লে আমার গা এখনো শিউরে উঠে। বাসররাতে স্বামীত্ব ফলানোর নামে আমাকে উপর্যপুরি ধর্ষণ করা হলো। ব্যথায় আমার গা গুলিয়ে গেল, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বমি হয়ে গেল। এভাবে কেটে গেল এক সপ্তাহ। তারপর সে তার কর্মস্থল সৌদি চলে গেল। তারপর কোনো যোগাযোগ নেই। শুনেছিলাম মাস কয়েক পর নাকি আমাকে তালাক দিয়েছে। তখন তালাক কী, তা বুঝতাম না। এ অবস্থায় মামি আমাকে আরো সহ্য করতে পারেন না। সারাক্ষণ গালিগালাজ করেন। তার সমস্যা ছিল আমি তার মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। আর আমার এ সৌন্দর্য আমার কাল হয়ে দাঁড়াল। পাড়ার উঠতি বয়সী ছেলেরা আমাকে একা পেলেই নানা রকম কুপ্রস্তাব দিতো।
আমি জীবন নিয়ে অতিষ্ট হয়ে উঠলাম। এখানে আর থাকা সম্ভব না। ভাবলাম যা হওয়ার হবে, আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, তাই একদিন সকাল বেলায় সবার অগোচরে বাসা থেকে পালালাম। নানা লোকের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা চলে এলাম। এখানে কাউকে চিনি না। এতো বড় শহর কোথায় যাব, কি করব, বুঝতে পারছিলাম না। কমলাপুর স্টেশনে বসে কাঁদছিলাম। লক্ষ্য করলাম একটি বখাটে ছেলে আমাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে, সঙ্গে তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ। এমন সময় যেন দেবদূতের মত হাজির হলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। ঠিক স্নেহময়ী পিতার মতো, আমার হাত ধরে টেনে উঠালেন, তারপর বললেন, এই যে মা তুই কোথায় হারিয়ে গেলি? তোকে কখন থেকে খুঁজছি। আমাকে ভিড়ের বাহিরে নিয়ে এসে বললেন, তোমাকে ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে এই অভিনয়টুকু করতে হলো। তারপর বললেন, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো। আমি তাকে আমার সব কথা খুলে বললাম। বললেন, তুমি যদি চাও আমার বাসায় যেতে পার, সেখানে তোমার একজন মা পাবে আর বাবা হিসেবে তো আমি আছিই। আমি তাকে নির্ভরশীল মনে করে, জীবন বাজি রেখে তার সঙ্গে গেলাম। তিনি আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে, স্ত্রীকে ডেকে বললেন, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি। আজ থেকে এ হচ্ছে তোমার মেয়ে। ওকে স্কুলে ভর্তি করে লেখা পড়া শেখাও। এমন সুন্দর মেয়ের জীবনের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দাও। তারপর শুরু হলো আমার শিক্ষাজীবন। আমার তখন কি যে আনন্দ। আমার শিক্ষাজীবন আমার কাছে স্বর্গ মনে হলো। বাসায় ইংরেজি শিক্ষক রেখে দেয়া হলো। আচার আচরণ ও মার্জিত চলাফেরা ইত্যাদি শেখানোর জন্যও গৃহশিক্ষক রেখে দেওয়া হলো।
স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন করে পুরো মাত্রায় আমি শিক্ষিত আধুনিক তরুণী হয়ে গেলাম। ওই বাড়ির দুটি অংশ ছিল, একটিতে মা–বাবার সঙ্গে আমি থাকতাম অন্য অংশে আমার যাওয়া নিষেধ ছিল। দূর থেকে দেখতাম সেখানে অনেক লোকের আনাগোনা ছিল, যে মেয়েরা আসতো তারা সবাই শিক্ষিত আর সুন্দরী। তাদের মধ্যে একজন আমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যে কথা বললো, তাতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই নারী যাকে আমি মা বলি, তার নাকি মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা। এ মেয়ে না কি আমার মতোই একদিন এভাবে এ বাড়িতে এসেছিল। এখন সে প্রায় প্রতি রাতে সমাজের বিভিন্ন প্রভাবশালী লোকের শয্যাসঙ্গিনী। সমাজের প্রতিষ্ঠিত লোকদের জন্য শিক্ষিত মার্জিত মেয়ে চাই। সে কারণেই আমাদের পেছনে এত টাকাপয়সা খরচ করা হয়। সময়ে এ খরচের কয়েক শ গুণ উঠে আসে। আমি প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে সত্যতা জেনেছিলাম। যাকে মা বলে ডাকি, তিনি খুব প্রভাবশালী নারী। আমি যেখানেই পালিয়ে যাই না কেন আমাকে ঘরে ফিরিয়ে আনা তার জন্য খুবই সহজ কাজ। তিনি বোধহয় বুঝতে পারলেন যে তার ব্যবসার বিষয় আমি জানি, তাই হঠাৎ একদিন তার অনুমতি ছাড়া বাইরে না যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। বাবা ব্যাপারটি পছন্দ করলেন না। বললেন, দোহাই তোমার এই মেয়েকে আমার মেয়ে হিসেবে থাকতে দাও। তাঁর কথা মা শুনলেন না। বললেন, বেশি বাবাগিরি ফলাতে এসো না। আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না।
এখান থেকে পালানো অসম্ভব। আমি রাক্ষসের রাজপ্রাসাদে বন্দী হলাম। তারপর আমার অনিচ্ছায় একদিন প্রভাবশালী এক লোকের শয্যাসঙ্গিনী করা হলো। সেই থেকে আমার রূপের আগুনে মাঝেমধ্যে রাতে একেকজন পুরুষকে জ্বালাই আর আমি জ্বলি সারা দিন। এই হচ্ছে আমার জীবন। আমাকে ভালোবাসতে পারেন কিন্তু দয়া করে আমার এই নোংরা জীবন আপনার পবিত্র জীবনের সঙ্গে জড়াবেন না। শেষ কথাগুলো বলতে তার কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেল, তারপর ফোন কেটে দিলো।
সব কথা শুনে মাসুদ নিশ্চল বসে থাকল কিছুক্ষণ, নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মোহিনীর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ, রাক্ষসের কবল থেকে তাঁকে উদ্ধারের প্রতিজ্ঞা, আরও দৃঢ় হলো মাসুদের।
লেখক: বায়াজিদ গালিব, রম্যগল্প লেখক, ক্যালগেরী, কানাডা