মোহিনী: পর্ব ৩

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মোহিনী আজ নীল শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, হাতে নীল রেশমি চুড়ি, কানে নীল পাথরের ঝুমকার সঙ্গে মিল রেখে গলার হার পরেছে। চোখও নীল, মনে হয় কন্টাক্ট লেন্স পরেছে। এত সুন্দর! প্রেমে পড়লে নাকি প্রেমের গান গাইতে ভালো লাগে। মাসুদের মন গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল ‘মোর প্রিয়া হবে এস রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল...।’ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মাসুদ। মোহিনী বলল, হাই! চমকে উঠে মাসুদ বলল, কেমন আছেন? আপনাকে যা সুন্দর লাগছে। মোহিনী বলল, সে আপনার চাহনি দেখেই বুঝেছি। আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। মায়ের কাছ থেকে দুই ঘণ্টার সময় নিয়ে এসেছি। মাসুদ বলল, তাই নাকি! এখনো মায়ের অনুমতি লাগে! ঠিক আছে আগে দুই ঘণ্টা তো পার হোক তারপর দেখা যাবে। মোহনী এবার মাসুদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল, সে জানে পুরুষের দৃষ্টি। সব পুরুষ দৃষ্টি থাকে তার শরীরের বিশেষ অংশে। নারী সব পুরুষের চাহনি সহজেই বুঝতে পারে। মাসুদের দৃষ্টি সরাসরি মোহিনীর চোখে। মাসুদের গভীর দৃষ্টিতে মোহিনী মোটেও বিব্রত হলো না। মনে হলো এ দৃষ্টি যেন গানের কলি, ‘কেবলই আঁখি দিয়ে, আঁখির সুধা পিয়ে, হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব...।’ ঠিক যেন চোখে চোখ রেখে অনেক না বলা কথার প্রকাশ। কোনো পুরুষের দৃষ্টিতে এমন প্রেমাবেগ কখনো দেখেনি। মাসুদের দৃষ্টি যেন তার হৃদয় ভেদ করে মনের গভীর থেকে টেনে আনছে মোহিনীর ভালোবাসার সত্তাকে। মাসুদ সেই কলম, খাম আর ফুল তার দিকে এগিয়ে দিয়ে একই কথা বলল, মোহিনী যেন এক ইন্দ্রজালে আটকা পড়েছে, তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, এমন সুন্দর প্রেম নিবেদন! সে হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিয়ে বলল, আপনি আমাকে সত্যি ভালোবাসার জালে বন্দী করেছেন, কিন্তু?...মাসুদ বলল, কিন্তু কী? সে বলল, না, থাক সময়েই বলব। তারপর বলল, আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন। মাসুদ মোহিনীর গভীরতায় হারিয়ে গিয়েছিল, তার কথায় আত্মস্থ হলো। বলল, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি সম্পন্ন করে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। তাতে বেশ সাফল্য এসেছে।

আরও পড়ুন

তারপর বলল, আপনাকে ভণিতা না করে সরাসরি একটি কথা বলতে চাই। মোহিনী বলল, বলুন। আপনাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন আমাকে চিনেও না চেনার ভান করেছিলেন কেন? মোহিনী বলল, সেদিন আপনাকে হঠাৎ দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। এত অল্প দিনের পরিচয়ে আপনার দেখা পাব, তা ছিল আমার জন্য কল্পনাতীত। মাত্র কদিনের পরিচয়ে আপনার মুখোমুখি হয়ে কথা বলা আমার জন্য ছিল বিব্রতকর। লেখায় যোগাযোগ আর বাস্তবে যোগাযোগের বিস্তর ব্যবধান। খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছিলাম, কী কথা বলব বা কীভাবে কথা শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। সেটাই মূল কারণ ছিল। পরে আমার বেশ খারাপ লেগেছিল, তাই যোগাযোগ করে আজকে দেখা করার ব্যবস্থা করেছি। আমি সেদিনের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ক্ষমা করেছেন তো? মাসুদ হঠাৎ বলল, আপনি কি কাউকে ভালোবসেন? কিংবা কারও প্রতি আপনার কোনো প্রতিশ্রুতি আছে? মোহিনী বলল, কাউকে ভালোবাসব, সে কপাল নিয়ে তো আর জন্মাইনি। মাসুদ তার কথায় কিছুটা অবাক হলো। বলল, এমন কথা বলছেন কেন? আপনাকে যেকোনো ছেলে পছন্দ করবে, আমি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই প্রেমে পড়ে গিয়েছি। যাকে বলে ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’। বলেই হো হো করে হেসে উঠল। ওরা দুপুরের খাবার খেল। মোহিনী কিছু কেনাকাটা করল, মাসুদের দাম দেওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দিতে পারল না। মোহিনী আবার কী মনে করে সে কথা ভেবে। মোহিনী বলল, চলুন আপনাকে অদূরে একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাই, আপনার ভালো লাগবে। মাসুদ নির্দ্বিধায় তার সঙ্গে গেল। জায়গাটা আসলেই সুন্দর। ওরা একটি জায়গায় বসল মুখোমুখি। মাসুদ বলল, জায়গাটি নিরিবিলি ও সুন্দর। এমন পরিবেশে শুধু প্রেমের কথাই বলা যায়। মোহিনী বিষাদমাখা হাসি দিয়ে বলল, একজনের বাইরে থেকে দেখেই কি তাকে বোঝা যায়? আমি কোনোমতেই আপনার যোগ্য নই বলেই ডুকরে কেঁদে উঠল। মাসুদ চুপ করে রইল। একজন নারী কাঁদলে তাকে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়, তা তার জানা নেই। কান্না সংক্রামক, মোহিনীর কান্না মাসুদকেও সংক্রমিত করল। নীরবে তার চোখ ভিজে গেল। মোহিনী বলল, আমি রূপকথার রাজকন্যার মতো রাক্ষসের প্রাসাদে বন্দিনী। আমাকে সেই প্রাসাদ থেকে উদ্ধার করতে হলে সমুদ্রের তলদেশে কাচের কৌটা উদ্ধার করতে হবে। সেই কৌটায় ভ্রমরের দেহে রাক্ষসের জীবন সংরক্ষিত। তাকে হত্যা করে আমাকে উদ্ধার করাটা দুঃসাধ্য। মাসুদ তার কথার রহস্য বুঝতে না পারলেও বুঝল তাকে পেতে হলে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে। মাসুদের প্রভাব–প্রতিপত্তি কম না, ইতিমধ্যে, তার বন্ধুরা পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সরকারের উচ্চপদস্থ পদে আসীন হয়েছে। মাসুদ নিজের অজান্তেই টেবিলের ওপর রাখা হাত ধরে ফেলল, এতে মোহিনীর কোনো আপত্তি ছিল না। জীবনের প্রথম একজন নারীর স্পর্শ। শরীর অবশ হয়ে গেল। মাসুদের হাতের কম্পন অনুভব করল মোহিনী। সে মাসুদের হাত শক্ত করে ধরল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আরও বেশ কিছু সময় কেটে গেল, তাদের কথা যেন শেষ হতেই চায় না। এভাবে কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল, তারা বুঝতেই পারল না। ‘আমাদের কি দুই ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে?’ মোহিনী খিলখিল করে হেসে উঠল, আসলেই কীভাবে সাত ঘণ্টা কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। মাসুদ বলল, মা বকবেন না? মায়ের কথা শুনে মোহিনীর মুখ কঠিন হয়ে গেল। বলল, বকলে বকবে, আমাদের তো সুন্দর সময় কেটে গেল, আমার কাছে এটা খুবই মূল্যবান। মায়ের বকা খেয়ে এমন সুন্দর সময় যদি মেলে, এর চেয়ে আনন্দের কী আছে? মা এখন পর্যন্ত ফোন করে খোঁজ নেয়নি। মাসুদ বলল, সে তো ভালো কথা। আচ্ছা, একটা কথা বলতে চাই, তাহলে কি ধরে নেব তুমিও আমাকে ভালোবেসেছ? মোহিনী প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ–সূচক মাথা নাড়ল। মাসুদ বলল, তাহলে আমাদের একসঙ্গে যাত্রার আজ প্রথম মাইলফলক? এর উত্তর না দিয়ে মোহিনী উঠে দাঁড়াল। বলল, আমাদের আবার কবে দেখা হবে জানি না, আপনি ভালো থাকবেন। তারপর চলে গেল, একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। মাসুদ মোহিনীর এমন হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারছিল না। মোহিনী বেশ রহস্যময়ী। মাসুদ ভাবছে, এমন রহস্যময়ী হলে মন্দ না, তাদের বিবাহিত জীবন মোহিনীর রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে করতেই কেটে যাবে। সে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে এগোল। পথে যেতে যেতে সে ভাবছিল, রাক্ষসের প্রাসাদে বন্দিনী।

ওখান থেকে হঠাৎ চলে আসার পর মোহিনী ভাবছিল, এভাবে হুট করে চলে আসায় নিশ্চয় মাসুদের মন খারাপ হয়েছে। সে যদি তাদের জীবন চলার পথ শুরুর কথা না বলত, তাহলে হয়তো আরও কিছুক্ষণ থাকত ওর সঙ্গে। প্রেম হঠাৎই হয়, কিন্তু তা বেড়ে উঠতে কিছুটা সময় দরকার হয়। হুট করে প্রেম, তারপর বিয়ে, এমন সম্পর্কে খুব তাড়াতাড়ি ভাঙন ধরে। তাই প্ল্যাটনিক প্রেম যত দীর্ঘ হবে, ভালোবাসা তত গভীর হবে। মোহিনী বাসায় পৌঁছেই দেখল মা অপেক্ষা করছে, পাশে বাবা। মনে হয় তাঁদের মাঝে কথা–কাটাকাটি হয়েছে। সে বুঝল, যা হয়েছে, তা তাকে নিয়েই। সে নিজের ঘরে চলে গেল। মুখ–হাত ধুয়ে খাটের ওপর এসে বসল। মাসুদকে লিখল, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে। এমন সুন্দর সময় কাটানোর সুযোগ আগে কখনো আমার জীবনে আসেনি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

আরও পড়ুন

বাবার সঙ্গে গল্প করছিল মাসুদ। বাবাকে মোহিনীর কথা বলছিল। তার এই ভালোবাসার মানুষের কথা, তাদের জীবন একসঙ্গে চলার পরিকল্পনার কথা। বাবা সব শুনে বললেন, মেয়েটির আসল নাম কি তোকে বলেছে? মাসুদ অবাক হয়ে বলল, আসল নাম আবার কী, এ নামেই তো জানি। এমন সময় তার মুঠোফোনে টুং শব্দে বার্তা এলো। বাবা বললেন, দেখ তোর মোহিনী মেসেজ পাঠিয়েছে, যা কথা বল, ওর আসল নাম ও তার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিস। বাবা উঠে পড়লেন।

মাসুদের ঘুম আসছে না। রাক্ষসের রহস্য তাকে তাড়া করে ফিরছে। মোহিনী নিশ্চয় কোনো কুচক্রের খপ্পরে পড়েছে। তারাই কি রাক্ষস? রাক্ষস যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদের হাত থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতেই হবে। সে একসময় বারান্দায় এসে বসল। রাত গভীর, এখনো রাস্তায় গাড়ি ও লোকজনের বেশ চলাচল আছে। আজব এই ঢাকা শহর, সারা রাত জেগে থাকে। বারান্দায় বসে ভাবছে মোহিনীকে মেসেজে পাঠাবে কি না। এত রাতে কি জেগে আছে? কিছুক্ষণ মাসুদ বারান্দায়ই বসে রইল। কিছুক্ষণ পর নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে, মোহিনীকে লিখল তুমি কি জেগে আছ? আমার ঘুম আসছে না, তোমার সঙ্গে কি কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে? কিছুক্ষণ পর উত্তর এলো, হ্যাঁ, জেগে আছি, কিন্তু কথা বলতে পারব না, একটু সমস্যা আছে। এত রাতে জেগে আছে অথচ তার কথা বলতে সমস্যা! মোহিনীর জীবনে মাসুদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ আছে নাকি? মাসুদ চিন্তিত হলো, অনেক আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমে এক দুঃস্বপ্ন দেখল। কয়েকজন রাক্ষস মোহিনীকে তাড়া করছে, সে প্রাণপণে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। তাকে দেখে মাসুদ মোহিনীকে উদ্ধার করতে, তাদের পেছনে দৌড়াতে লাগল, কিন্তু সে মোটেই এগোতে পারছে না। ওদিকে রাক্ষসরা মোহিনীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। মাসুদ চিৎকার করে উঠল, ঘুম ভেঙে গেল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও ঘেমে গিয়েছে। পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। বিছানার পাশের জগ থেকে জল ঢেলে ঢক ঢক করে এক নিশ্বাসে পান করল। তাতে তার ক্লান্তি কিছুটা দূর হলো। এমন অদ্ভুত স্বপ্নের মানে কী? বুঝতে পারল না। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে, ঊষালগ্ন। আকাশের তারা দিনের আলোতে মিশে যাচ্ছে। ঊষালগ্নের নির্মল হাওয়া খুব আরামদায়ক। সে প্রাণ ভরে শ্বাস নিল। আরও কিছু ক্লান্তি দূর হলো। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল। আজকাল আর প্রাতর্ভ্রমণে যাওয়া হচ্ছে না। সকালে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙল। কী রে এত বেলা করে ঘুমাচ্ছিস? শরীর ঠিক আছে তো? মাসুদ ঘড়ি দেখল এগারোটা বেজে গেছে। আজও ছুটির দিন। শ্রমিক দিবস। তাই তাড়া নেই। বলল, না বাবা ঠিক আছে, কাল রাতে একটু দেরিতে ঘুমিয়েছি। চলবে...

* লেখক: বায়াজিদ গালিব, রম্যগল্প লেখক, ক্যালগেরি, কানাডা