মোহিনী: পর্ব ১
রমনার এই সুন্দর পরিবেশে বসন্তের হাওয়া বইছে। নানা রকম পাখির ডাক বিশেষ করে কোকিলের মনমাতানো ডাকে নিজের অজান্তেই নিজেকে হারিয়ে ফেলল মাসুদ কোনো এক দূর অজানায়। হঠাৎ ধাক্কা খেল এক বিশাল দেহীর সঙ্গে। প্রায় ছিটকে পড়েছিল। অনেক কষ্টে সামলে নিতেই লোকটি খিস্তি করে উঠল, চোখ কি বাড়িতে রাইখ্যা আইছেন। লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে দ্রুত পালাল। আজ দিনটি খারাপ। তার মানে সামনে আরও সমস্যা আছে। প্রাতঃভ্রমণ আজ চুলোয় যাক। বাড়ির দিকে রওনা হতেই চোখে পড়ল অদূরে বেঞ্চে বসা মেয়েটির দিকে। বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করল। অপরিচিতজনের দিকে তাকিয়ে থাকা খুব একটা শোভন নয়, আর সে যদি হয় নারী। চকিতে তার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল মোহিনী। মেয়েটির দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। মেয়েটি বেঞ্চের কাঁধ বরাবর দুই হাত প্রসারিত করে মাথা আকাশের দিকে রেখে চোখ বন্ধ করে সকালের নির্মল ঝিরঝির বাতাস উপভোগ করছে। অথবা কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
সকালের ঢাকা যে এত সুন্দর, তা মাসুদের জানা ছিল না, বিশেষ করে রমনা পার্ক। ঘন সবুজ ঘাস, লতাগুল্ম, ছোট ও মাঝারি গাছ, মৌসুমি ফুলে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী পার্ক এই রমনা। এখানে রয়েছে অতি দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ ও পাখি। সকালের বাতাসের সঙ্গে গাছের পাতার শব্দ আর পাখির কলতান। এমন নৈসর্গিক পরিবেশে মনে এক অপূর্ব আবেশের সৃষ্ট হয়। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা মনে মনে ...।’ সেই আবেশে যেন আচ্ছন্ন হয়ে মাসুদ ধীর পায়ে মেয়েটির খুব কাছে চলে গেল। ঠিক তখনই সে চোখ মেলে তাকিয়ে চারিদিক দেখল। হঠাৎ মাসুদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই তা স্থির হলো। লোকটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার মানে সে যতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল, ততক্ষণই কি লোকটি তাকে দেখছিল? মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল, কিছু বলবেন? মাসুদ বুঝল, সে মোহিনী নয়। বলল, আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছিল, এখন মনে হচ্ছে; না, আপনি সে নন। মেয়েটি বলল, ‘এ সব পুরোনো মুখস্থ বুলি বাদ দিয়ে নতুন কিছু আবিষ্কার করুন। মেয়ে দেখলেই পরিচিত মনে হয়? যত সব ফালতু লোকের আনাগোনা।’ মাসুদ সেখান থেকে তাড়াতাড়ি রওনা হলো বাসার দিকে। এমন অপমান সে তার জীবনে কখনো হয়নি। আজকের দিনটি তার জন্য নয়। মেয়েটিও তার গমন পথের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে ফুসফুস ভর্তি করল, তারপর কিচ্ছুক্ষণ ধরে রেখে ধীরে ধীরে নিশ্বাস ছাড়ল। এতে কিছুটা রাগ দমন হলো। তারপর নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল একটি শব্দ, আজিব! মাসুদ নিজেকে ধিক্কার দিল, মোহিনী হোক আর যে–ই হোক, এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকা ঠিক হয়নি। মেয়েটি নিশ্চয় তাকে দুশ্চরিত্র আর লম্পট ভাবল? মাসুদের সমস্যা হচ্ছে, আজকাল এ বয়সী সব মেয়েদেরই মোহিনীর মতো লাগে।
সব কিছু থেকে কিছুদিন নিজেকে সরিয়ে রেখেছে মাসুদ। ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে থাকা যে কি সুখের, তা আগে বুঝেনি। জীবনের চলার পথে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। রাত দিন একটানা কাজের চাপে হাপিয়ে উঠেছিল। জীবনের সাফল্যের ছোঁয়া একটি অন্য রকম ভালো লাগা হলেও একাকী জীবনের ভার বহন করা বেশ কষ্টের। এক সময় প্রতিটি মানুষের ইচ্ছা হয় তাদের জীবনের সাথী নিয়ে পথ চলার। ইচ্ছা হয় দাম্পত্য জীবনে সুখের সংসার গড়ার। মাসুদ এর ব্যতিক্রম নয়। এ বয়সে নিজের চেষ্টায় যা করেছে, সেও কম নয়। নিজের অর্জনের সফলতায় বেশ তৃপ্তি আছে। দেখতে দেখতে বয়স দাঁড়িয়েছে মধ্য তিরিশে। বাবা তাকে বিয়ে করানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু সে তার কর্মজীবন নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে বাবার কথা আমলে আনেনি। সে বলত তার এমন ব্যস্ত জীবনে কেউ এসে কখনই স্বস্তি পাবে না। যাকে সময় দিতে পারবে না, তাকে ঘরে এনে কষ্ট দেওয়ার অর্থ হয় না। এখন তার কিছুটা অবসর হয়েছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিয়ের পাত্রী দেখা তার খুব অপছন্দ। ছাত্রজীবনে যে দু–একজন মেয়েকে মনে মনে ভালোবাসেনি তা নয়। তবে কখনোই তাঁদের প্রস্তাব করা হয়নি। হয়তো সে জন্য তার জীবনে কোনো বান্ধবী নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবা তাকে সব সময় বলতেন, তারুণ্য হচ্ছে প্রেমে পড়ার বয়স, তুই কারও প্রেমে পড়েছিস কখনো? এ ধরনের কথায় বাবার সঙ্গে মাসুদের কোনো সংকোচ নেই, সে হেসে বলে, কি যে বলো বাবা! পড়াশোনার চাপে ওসব করার সময় কোথায়? বাদ দাও। তুমি আছো, তোমাকে ভালোবাসি এটাই তো আমার বড় প্রেম। আপাতত আমাদের মধ্যে আর কাউকে টেনে আনতে চাই না। বাবা হেসে বলেন, আরে বোকা আমিও তো ভালোবেসে সংসার করেছি, আমারও বাবা ছিলেন তাই বলে কি বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কমে গিয়েছিল? মায়ের কথা মনে পড়ায় মাসুদের অজান্তেই এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। খুব কম বয়সে মা কে হারিয়েছে। মায়ের মুখশ্রীর ছবি হৃদয়ের পাতায় আঁকার আগেই চলে গেছেন। ভাগ্যিস বাবা মায়ের বিয়ের একমাত্র ছবিটা টাঙানো ছিল। সবাই বলে ছবির চেয়ে তার মা, আরও বেশি সুন্দরী ছিলেন। মা মারা যাওয়ার পর ওরা বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে ছিল। শুনেছে বাবা সব কাজ বাদ দিয়ে আপনমনে বসে থাকতেন উঠোনে পাতা বেঞ্চের ওপর। মা–বাবার ছবির এলবাম গ্রামের বাড়িতে বেশ কিছু বই পত্রের সঙ্গে একটি ট্রাঙ্কে অযত্নে ছিল। সেগুল উঁইয়ের কবলে পরেছিল। সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মাসুদ মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। চোখ জ্বালাপোড়া করে তারপর ঝাপসা হয়ে আসে চারিদিক। মায়ের প্রতি তার অনেক অভিমান। এখনো অভিমানে তার গলায় অনুভব করে এক খণ্ড মাংসপিন্ডের অস্তিত্ব, যা কণ্ঠনালি দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। ইহজগতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা ঠিক নয়। মাসুদ তার মাকে হারিয়ে একা, আর বাবা তার সহধর্মিণীকে হারিয়ে একা। এ বাড়িতে তারা দুজন প্রাণী, দুজনেই একা। আগে বাবার সঙ্গে সকাল বিকাল কথা হতো, এখন মাসুদ বড় হয়েছে। বাবার সঙ্গে আলাপনের দূরত্ব বাড়ছে। এ দূরত্ব তাকে কতদূর নিয়ে যাবে! ভাবতেই একধরনের শূন্যতা অনুভব করে।
মাসুদ ফেসবুকের খুব একটা অভ্যস্ত নয়, কালেভদ্রে যায়। সেখানে মাঝেমধ্যে খুব সুন্দর গল্প লেখা হয়। কিছু কিছু গল্প বেশ সুন্দর। ফেসবুক সামাজিক মাধ্যম হিসেবে সুফল–কুফল দুটোই আছে। আজকাল ফেসবুকে সবাই আসক্ত। অনেকটা নেশাগ্রস্ত। অনেক দিন পর ফেসবুক খুলে একটি মেয়ের পোস্ট দেখে মজা পেল। মোহিনী নামে ফেসবুক খুলেছে। মনে হয় ছদ্ম নাম। ফেসবুকে এমন রূপবতী মেয়ে দেখলেই মনে হয় এর পেছনে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। এমন নকল মিথ্যা পরিচয়ে অনেকেই এই মাধ্যমে আসে। যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করার জন্য এমন ছবি ব্যবহার করে। অধিকাংশ সময়ই প্রতারণার উদ্দেশ্য থাকে। মোহিনীর প্রোফাইলে লেখা, ‘আমি ফেক না, দয়া করে ইনবক্সে এসে অযথা বিরক্ত করবেন না।’ এমন একটি উক্তি দেখে মাসুদ তাকে বিরক্ত না করে পারল না। সে মোহিনীর ইনবক্সে লিখল, ‘ফেক হলে কি কেউ বিরক্ত করে? আসল বলেই তো বিরক্ত করতে ইচ্ছা হলো।’ এরপর কোনো উত্তর পেল না কেটে গেল প্রায় মাস। সে অপেক্ষা করল মোহিনী হয়তো তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। মাসুদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে আবার লিখল, কেমন আছেন। তারপর অপেক্ষার পালা। মেয়েটিকে ফেসবুকে সক্রিয় দেখাচ্ছে কিন্তু তার বার্তার কোনো সাড়া নেই। মাসুদ মোহিনীর আশা ছেড়েই দিল। হয় তো ছবি আসলেই ফেইক। এভাবে কেটে গেলো আরও কয়েক মাস। যাকে নিয়ে নিজের মনে এত অনুযোগ, তবু তাকে ভুলতে পারছে না মাসুদ। সে ভাবল কিছুদিন ফেসবুক থেকে দূরে থাকবে। তার আগে মোহিনীকে তার ফোন নম্বর ও ঠিকানা দিয়ে বার্তা পাঠাল। ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আপনার এই ছবি আসল। এখন ধীরে ধীরে সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরছে। এমন প্রতারণা করা ঠিক নয়। যদি মনে করেন এ প্রতারণার জন্য আপনি অনুতপ্ত তাহলে এখানে মেসেজ দিলে বা ফোন করলে খুশি হবো। ভালো থাকবেন মাসুদ।’ এরপর ফেসবুক থেকে নিজেকে বিরত রাখল। মোহিনীর মায়াজাল থেকে বের হতে হবে। তারপরও মনের মধ্যে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা রয়েই গেল।
মোহিনী, অবসর সময়ে মাঝেমধ্যে ইনবক্সের বার্তা পড়ে দেখে। সবার প্রায় একই উক্তি। আপনি সুন্দরী, আপনি আকর্ষণীয়া, আমার বন্ধু হবেন? কিংবা ‘প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেলাম’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর নিজস্ব ধারণা, পুরুষ মানুষের প্রেম হচ্ছে দেহ–সর্বস্ব। একটি মন্তব্যে তার চোখ আটকে গেল, নাম হাসান মাসুদ। লিখেছে, ‘ফেইক হলে কি কেউ বিরক্ত করে? আসল বলেই তো বিরক্ত করতে ইচ্ছা হলো।’ বার্তা পড়ে আপন মনে কিছুক্ষণ হাসল। তারপর লিখল আমার ছবি দেখে সবাই আমাকে লিখে আপনি কি আসল, নাকি নকল? তাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে এই পোস্ট দিয়েছিলাম। আপনার কমেন্টস পড়ে আপন মনেই বেশ কিছুক্ষণ হেসে হালকা হলাম। ক্লান্তির মধ্যে এক গ্লাস লেবুর শরবত যেমন সারা দেহকে প্রশান্তি এনে দেয় ঠিক তেমন। ভালো থাকবেন। চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন: মোহিনী: পর্ব ২
লেখক: বায়াজিদ গালিব, রম্য গল্প লেখক, ক্যালগেরি, কানাডা