মোহিনী: পর্ব ২
কোনো এক তরুণীর নূপুরের রিমিঝিমি শব্দ তাকে ছুঁয়ে গেল, সে ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেল। কোথাও কেউ নেই। পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন হলেও তা হৃদয় স্পর্শ করল। মাসুদের অন্তরে ডাক পাঠিয়েছে মোহিনী। অলস ভঙ্গিমায় উঠে বসল। পিপাসায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে। খুব ক্লান্ত লাগছে। ফ্রিজ খুলে ঢক ঢক করে বোতল থেকে জলপান করল। ক্লান্তি ভাব কিছুটা কমে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে মোহিনীরূপী নূপুরের ঝংকার যেন আবার অনুভব করল। ঘুম আসছে না। হাসান অলসভাবে মুঠোফোন হাতে নিল। মেসেঞ্জারে অনেক বার্তার মধ্যে মোহিনীর বার্তাও আছে। হাসান মাসুদের হৃদয় রোমাঞ্চিত হলো। আন্দোলিত হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ‘হে সখা, বারতা পেয়েছি মনে মনে, তব নিশ্বাসপরশনে....।’ মোহিনী বারতা দিয়েছে। যাক অন্তত তাকে স্পর্শ করতে পেরেছে। এভাবেই তাদের নিয়মিত যোগাযোগ।
কিছুদিন পর আবারও শপিং মলে মোহিনীরূপী এক মেয়েকে দেখলো মাসুদ। এ কি সত্যই মোহিনী? না কি পার্কের মতোই দৃষ্টিভ্রম? কৌতূহলবসে সামনে এগিয়ে গেলো মাসুদ তাকে অনুসরণ করে। মোহিনী হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাল। দুজনের দৃষ্টিবিনিময় হলো। মোহিনী ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে একবার দেখল মাসুদকে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, মানে চেনে নাই। শুধু ফেসবুকের ছবি দেখেই কি বাস্তবে চেনা সম্ভব? মাসুদ মোহিনীর প্রোফাইলে ঢুকে অনেক ছবি দেখেছে তার। তাই মোহনীকে চিনতে ভুল করেনি। তার প্রতিটি পোশাকই জাঁকজমকপূর্ণ, ঠিক রাজরানীর মতো। তাহলে কি সে নাচ করে? না কি মডেল? ওর পেশা জানা হয়নি এখনো। আজ লাল রঙের সালোয়ার–কামিজ পরে এসেছে। হালকা প্রসাধনে ছবির চেয়েও সুন্দর লাগছে। ছিপছিপে লম্বা। ওকে দেখেই তার হৃদয় অশান্ত হয়ে উঠল, হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। তার হৃৎস্পন্দন এতো জোরে হচ্ছে যে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। আরেকটু বেড়ে গেলে মনে হয় আশেপাশের লোকজনও শুনতে পাবে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল কিছুটা। হঠাৎ মোহিনী বলে ডাক দিলো, মেয়েটি তার দিকে তাকাল, তার দৃষ্টিতে কোনো রকম চাঞ্চল্য নেই। উদাস দৃষ্টি। মনে হলো না যে চিনতে পেরেছে। অথবা মোহিনী তার নামই না। তার ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে বেশ আহত হলো মাসুদ। সত্যিই মোহিনী, নাকি চোখের ভুল। যাকেই দেখছে মোহিনী বলে ভুল করছে।
পড়ন্ত বেলায় ছাদে বসে ভাবছিল মোহিনী, এমন গভীর ভাবনা যে আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, শীতল বাতাস, বৃষ্টির লক্ষণ—এসব সে কিছুই লক্ষ করেনি মোহিনী। ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির জলের স্পর্শে চমকে উঠল, তারপর নিশ্চল বসে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। বৃষ্টির অঝোর ধারায় শীতল হলো তার দেহ–মন। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির তীব্রতা অনুভব করতে করতে রবীন্দ্রনাথের গানের একটি কলি আপন মনে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়/ এমন দিনে মন খোলা যায়।’ কিন্তু এমন দিনে মন খুলে যাকে মনের কথাটি বলবে, তাকে এ মুহূর্তে কোথায় পাবে? নিজের মনকে প্রশ্ন করল। এ অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আগে তো কখনো প্রেমে পড়েনি। তার চারপাশে অনেক পুরুষ তারপরও প্রেম করার মতো পুরুষ আসে নি তার জীবনে। ঠিক যেমন বন্যায় চারিদিক থৈ থৈ জল কিন্তু পানীয়ে জল নেই এক ফোটাও। দিন যতই যাচ্ছে তার হৃদয়ে বেড়ে উঠছে হাসান মাসুদ নামের একটি প্রেমময় সত্ত্বা। এখন কাজে মন বসে না। এভাবে বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেল। ম্যাসেঞ্জারে মাসুদকে তার জিজ্ঞাসার উত্তর দিল, ‘আমার ছবি যে আসল তা তো আপনি সেদিন শপিং মলেই দেখলেন! এখনও সন্দেহ! এতো অল্পে হতাশ হওয়া কি ঠিক? ভালো থাকবেন।’ মাসুদ তার মেসেজে পড়ে অবাক হলো, শপিং মলের মেয়েটিই মোহিনী ছিল! তাহলে এমন অভিনয় কেন করলো? সে লিখলো, আপনি আমাকে না চেনার ভাণ করলেন? এ কেমন প্রহসন? উত্তর এলো, হ্যাপি চকোলেট দিবস। মাসুদ অনেক দিবসের নাম শুনেছে কিন্তু চকোলেট দিবস বলে কোনো দিবস আছে কি না জানে না। লিখল, চকোলেট দিবসে তো চকোলেটে পাঠাতে হয়, আপনাকে কীভাবে পাঠাব? সে বললো, আপনি আমাকে চকোলেট পাঠাবেন কেনো? আমি আপনার কে ? মাসুদ বললো, কেউ না তবে চকোলেট দিবসের নাম আগে শুনি নাই। আপনি চকোলেট দিবসের শুভেচ্ছা পাঠালেন, তাই ভাবলাম পাঠাই। মোহিনী বললো, চকোলেট আমার খুবই প্রিয়, ঠিক আছে পাঠান। এটা আমার ফোন নম্বর, আমার নামে পাঠিয়ে দিন ফোন নম্বর দিয়ে। তাহলে ওরা আমার নম্বরে ফোন করে ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে দিবে। তারপরই লিখল, ‘দুষ্টুমি করেছি, পাঠাতে হবে না। আপনি ভালো থাকুন ।’
পরদিন কলিং বেলের শব্দে মোহিনীর কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দেখে পার্সেল এসেছে, একটি বিশাল ফুলের তোরা, সবই লাল গোলাপ। উত্তেজিত হয়ে মোহিনীকে ডাকল, আপা দেহেন, কী আইছে। ব্যাপারটি মোহিনীর মায়ের দৃষ্টি এড়াল না। এ বাসায় কোনো ধরনের উপহার আগে কখনোই আসেনি। তার মা বেশ বিরক্ত হলেন। বললেন, এসব কি? উত্তরে মোহিনী তাকে একটি মিষ্টি হাসি উপহার দিল। আজ তার ফোনে এই পার্সেলের জন্য ঠিকানা চেয়েছিল কুরিয়ার সার্ভিস। এ নিশ্চয় মাসুদের কাজ। মায়ের চোখ রাঙানোর ভয় উপেক্ষা করে, সেগুলো নিয়ে খুলে দেখলো, নানা রকম সুস্বাদু চকোলেট, একটি সুন্দর কার্ড, তাতে লেখা—
‘সুস্বাদু চকোলেট মতো আপনার জীবন আনন্দময় হোক আর ফুলের মতো নির্মল হোক, ভালো থাকবেন। মাসুদ’
মোহিনী সেদিন যমুনা পার্কে সুদর্শন মাসুদকে প্রথম দেখেছিল। মুগ্ধ হলেও সে ভাব গোপন রেখে না চেনার ভাণ করেছিল। খুব কষ্ট হলেও কাজটি সে সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছিলো। মাসুদ যখন অসহায়ভাবে তার নাম ধরে ডেকেছিল, মনে হচ্ছিল সংযমের বাঁধ ভেঙে তার ডাকে সাড়া দেয়। তাহলেই তো সব হয়ে যেত। সে যখন মাসুদকে না চেনার ভাণ করেছিলো তখন তার করুণ মুখ দেখে খুব মায়া হয়েছিলো। মাসুদের সঙ্গে দেখা করার অদম্য ইচ্ছা তাকে তাড়িত করল। সে লিখলো, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। এমন একটি সহজ কথা মাসুদ মোহিনীকে বলতে পারছিল না। অনেক দিন থেকেই বলবে বলবে করে বলা হচ্ছিল না। তার মনের কথাটিই মোহিনী কত সহজভাবে লিখেছে। সে লিখল, ‘আমার মনের ইচ্ছা আপনি কীভাবে জানলেন? কবে কোথায় দেখা হবে? উত্তর এল, কাল সকাল ১১টায় একই শপিং মলে, যেখানে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল।’
‘বাহ! খুব ভালো, এবারে চিনবেন তো? না কি আগের মতো নিখুঁত অভিনয় হবে?’ উত্তরে সে, সুন্দর হাসি মাখা ছবি পাঠালো। মোহিনীর ছবি দেখলেই মনে গুনগুনিয়ে বেজে উঠে গান, ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লেখা ….’ এখন থেকে কি আকাশের গ্রহ–তারার মতো সত্যি হয়ে আসন গাড়বে তার হৃদয় আকাশে? প্রেমের আগমন হলে হয়তো মানব দেহের অনেক কিছুই সাময়িক বিকল হয়ে পরে। এক মাত্র সচল থাকে হৃদয়। সেখানে একধরনের ঝড় এসে সবকিছুই ভেঙে চুরমার করে দেয়। তারপর হৃদয়ে যে মিষ্টি ব্যথা অনুভূত হয়, তা বর্ণনা করা যায় না, শুধুই অনুভব করতে হয়। মাসুদেরও তেমন হলো। সারা রাত ঘুমাতে পারল না। শেষ রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টায়। বাথরুমে গিয়ে গোসলের পর কাপড় পাল্টে বের হবার পথে দেখলো বাবা পত্রিকা পড়ছেন, সামনে চা। ছেলের আগমন টের পেয়ে বললেন, ছুটির দিন ফুলবাবু হয়ে সাতসকালে কোথায় চললি? মাসুদ মৃদু হেসে বলল, বাবা আমি কি তোমার কাছে আমার কোনো কথা গোপন করেছি? বাবা বললেন, না। সে বলল, এবারও বলব, আগে ঘুরে আসি। মুখে রহস্যের হাসি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো শপিং মলের উদ্দেশে।
মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তার এক আধপাগল কিন্তু মেধাবী সহপাঠী ছিল। ইংরেজি সাহিত্যের। সবাই তাকে আঁতেল বলত। না বলে উপায় আছে? এ বয়সে সে যা লেখাপড়া করেছে, তা ছিল তার জন্য অনেক বেশি। সে জ্ঞানের ভার সইতে না পেরেই হয়তো কিছুটা খাপছাড়া চালচলন। ছেলেটি তাদের ডিপার্টমেন্টের এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সেই মেয়ের সম্মুখীন হয়ে তার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ালো। তারপর একটি কলম, একটি খাম ও একটি লাল গোলাপ তার সামনে ধরে বলল, এই কলম হচ্ছে আমার শিক্ষা, এই খাম হচ্ছে আমার ঠিকানা আর এই লাল গোলাপ হচ্ছে আমার ভালোবাসা, তুমি কি এগুলো গ্রহণ করবে? মেয়েটি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষার্থী যারা এই এই দৃশ্যের সাক্ষী ছিলো, তারা সবাই করতালি দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানালো। আজ মাসুদের মনে সে পাগলামি জেগে উঠল। সে যাবার সময় একটি কলম, খাম ও ফুলের দোকান থেকে আধফোটা একটি লাল গোলাপ নিয়ে নিল। চলবে...
লেখক: বায়াজিদ গালিব, রম্যগল্প লেখক, ক্যালগেরী, কানাডা