বীথি: শেষ পর্ব ২৭

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বীথি,

২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি চিঠি লেখা শুরু করেছিলাম টরন্টো টাইমে। বাংলাদেশে তখন ৬ জানুয়ারি ভোর ৫টা।

এই এক বছরে তোকে অনেকগুলো চিঠি লিখলাম। এক বছরের কত কত কথা, ইচ্ছা, স্বপ্ন, হুট করে নিজেকে প্রকাশ করা, প্রবলভাবে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, শেয়ার করতে ইচ্ছা হচ্ছে, বসে গেছি তোকে লিখতে, তোর কাছে এই এক টুকরা চিঠি আমাকে কতটা ভারমুক্ত করেছে, সেই খবর কি কোনোদিন জানবি তুই? হয়তো আমার এই লেখা অনেক পাঠক পড়েছে, বা মাত্র অল্প কিছু মানুষ পড়েছে বা মাত্র দু–একজন পড়েছে—কিন্তু তুই যে একটা চিঠিও পড়িসনি, সেটা তো ভীষণ সত্য। কি অবাক বল?

বাংলাদেশে থাকিস তুই, ঢাকা শহরেই থাকিস, কিন্তু তোর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, তোর নেট অ্যাকসেস নেই, এমনকি একটা ই–মেল অ্যাকাউন্টও নেই। অথচ আমাদের সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পড়ে আসা ৪ জন বেস্ট ফ্রেন্ডের ভেতরে তুই সবচেয়ে বেশি স্মার্ট ও আধুনিক। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স করেছিস। তোর বাবা পরিচিত সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তুই ছাড়া তোর বাকি ৪ ভাই–বোন–ই বিদেশে সেটেল। কাউকে বললে বিশ্বাস করবে যে তোর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই! আমি কিন্তু ভীষণ খুশি হয়েছিলাম, যেদিন তুই বললি, লুনা—তুমি আমাকে লিখবা, কিন্তু আমি তো পড়তে পারব না। আমি বললাম, সেই কারণেই তোকে লিখব বীথি—মন খুলে লিখব, যদি জানতাম তুই প্রতিটা চিঠি পড়বি, তাহলে মাথার ভেতরে একটা চাপ কাজ করত, সেই ভালো—তোর পড়ার দরকার নেই।

আরও পড়ুন

আজ তোর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার দিন বীথি। কেমন যেন শূন্য একটা অনুভূতি চেপে আছে আমাকে। সঙ্গী হারানোর বেদনা কি এটা? বা অনেকদিনের একজন মানুষ, যাকে চোখে দেখি না। কিন্তু যে আমার সময় জুড়ে থাকে, আমার কথা শোনে মন দিয়ে, তাকে আজ ছেড়ে যেতে হবে বলে কি এমন হতবিহ্বল লাগছে? আজ অফিস থেকে ফিরতি পথে, কি ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে আজ, জবুথবু হয়ে শুধুই ভেবেছি কী করে এই চিঠি শেষ করব? জীবনে সত্যিকার ভালোবাসলেই শুধু ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন আসে, তাই না রে? মনে আছে, যখন লেখা শুরু করলাম, ঢাকায় ফোন করে তোকে জানালাম আমার আইডিয়া, তুই বললি—লুনা, তোমার মনে আছে, তুমি যখন ঢাকা ছেড়ে সাভারে গেলে, তুমি আমাকে চিঠি লিখতে, তোমার তো চিঠি লেখার অভ্যাস অনেকদিনের। তুই আমার সেই ষষ্ঠ শ্রেণির বন্ধু, কতবার তোকে ছেড়ে গেলাম, কতবার, আবার ফিরে ফিরে পেলাম, এই তো টরন্টো আসার আগেও প্রায় ৬–৭ বছর আগেও কোনো যোগাযোগ ছিল না, আবার তোকে পেলাম তোর বড় বোনের মাধ্যমে, যিনি আমার শহরেই থাকেন।

বীথি-রে খুব খারাপ লাগছে জানিস। ভীষণ খারাপ, কেমন যেন ভেতরটা হাহাকার করছে। এই এক বছরে কত কত দিন কষ্ট দুঃখ আনন্দ বুকের ভেতর চেপে বাসায় ফিরেছি, সারা পথ কথা বলেছি তোর সঙ্গে, বাড়ি ফিরেই নাইয়ার হাতে সেলফোন দিয়ে বলেছি বাবু—আগামী দুই ঘণ্টা আমাকে ডাকবে না, আমি লিখছি। পড়ার টেবিলের সঙ্গেই বড় একটা টিস্যু বক্স, আমি লিখি আর টিস্যু ভেজাই বা কখনো নিজের রাগ ঝেড়ে ফেলি তোর কাছে, নিজেকে ভীষণ হালকা লাগে একটা চিঠি লেখার পর। কিন্তু এরপর আমি কী করব, বল? প্রকৃতি নাকি শূন্যতা সহ্য করে না। তাহলে কি আমিও পেয়ে যাব অন্য কোনো আশ্রয়? কেঁদে ফেরার জন্য অন্য কোনো ঘাড়? সেই বিদেশি কবির মতো—আই নিড আ শোল্ডার টু ক্রাই।

আরও পড়ুন

অনেক অনেক প্রাপ্তি আছে জীবনে, অনেকবার বলেছি সেসব কথা। ভালো একটা চাকরি আছে, ছেলে সুস্থ আছে, কর্মক্ষম আছি, মমতাময়ী বোনেরা আছে, মা–বাবা বেঁচে আছেন। নিজের একটা গোছানো ঘর আছে, দিনশেষে প্রিয় ঘরে ফেরার ভীষণ তাড়া আছে, জীবনে গভীর অপেক্ষাও আছে। আর আছে আমার দেশ, যে দেশ ছেড়ে এসছি মাত্র ১০ বছর আগে। তোকে লেখা প্রতিটা চিঠিতে আমার দেশ আছে, যত ক্ষোভ, ঘৃণা, অপমান–ই আমি দেশকে নিয়ে করি না কেন—সেটাই আমার শিকড়, আমার একমাত্র পরিচয়, অস্বীকার করে বাঁচা মানেই নিজেকে ছিঁড়ে ফেলা।

এই চিঠিতে যাঁরা যাঁরা কমেন্ট করেছেন, তাঁদের সবার কথা আমি বারবার পড়েছি, শক্তি পেয়েছি, মনে হয়েছে আমি কিছুতেই একা না। একেকটা চিঠি পোস্ট করেছি আর বারবার তাকিয়ে দেখেছি—দেশের সব চেনা–অচেনা পাঠককে। অনেকে বলেছেন, লুনা তোমার চিঠিতে কমেন্ট লিখি না, কিন্তু সব চিঠি পড়ি। এমন অনেকে আছেন, মাত্র ২–৩ দিন না লিখলেই তাঁরা ইনবক্সে লিখেছেন—আপনি ভালো আছেন? আপনার লেখা দেখছি না। বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে এক পাঠক নিয়ম করে আমার আর নাইয়ার জন্মদিন পালন করেছেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে—মধ্যরাতে এই জানুয়ারি মাসেই, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন—লুনা আপা, আপনার জন্মদিনের কেক কাটছি, ফরিদপুর থেকে ঢাকায় গিয়ে আমার বই কিনে এনেছেন। তিনি কি ১৭ হাজার মাইল দূরে বসে ফোনের অপর প্রান্তে আমার চোখের কোন ভিজে ওঠা দেখেছিলেন? এসব প্রাপ্তির পরেও কি বেঁচে থাকার জন্য অনেক অনেক ডলার বা সম্পদের প্রয়োজন হয়, বল? আমার সব না পাওয়াকে জয় করি আমি এসব ভেবে, কিন্তু তবু নিঃশব্দ নিশীথ রাতে বা ভীষণ শূন্য দুপুরে মনে পড়ে সেই ভয়াবহ স্মৃতি, যা এই জীবনেই ভীষণ সত্য, ভুলতে পারি না—মনে হয়, কেন পেলাম এমন উপেক্ষা, এমন অবহেলা, নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় মুহূর্তের জন্য।

আর না বীথি, অনেক হলো—যাঁরা লেখা পড়েছেন, তাঁদের সবার জন্য মঙ্গলকামনা। তোকে বরাবরের মতো আদর বীথি। অনেক অনেক ভালো থাক সোনা।

আরও পড়ুন
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]