স্ট্রোক একটি ঘাতক ব্যাধি। প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা যান অর্ধকোটি মানুষ আর অর্ধকোটি পঙ্গুত্ব বরণ করেন। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ এটি। মারা যাওয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ আমাদের মতো দেশে ঘটে। দিন দিন স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার প্রায় ৮০ গুণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশেও এ হার কিন্তু কম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে দেশে প্রতি ১ হাজার জনে প্রায় ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন।
স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি অসুখ। মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ এটি। স্ট্রোক দুই ধরনের।
১. ইসকেমিক স্ট্রোক
২. হেমোরেজিক স্ট্রোক
ইসকেমিক স্ট্রোক: মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায়। ফলে মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। শুরুতে কোষগুলো রক্ত চলাচল কমে গেলেও বেঁচে থাকতে পারে। একটা সময় পর কোষগুলো মারা যায়। একে বলে কোর। কোরের চার পাশে মস্তিষ্কের বেশ কিছু অংশেও রক্ত কমে যায়। একে বলে প্যানামব্রা। যদি প্যানামব্রা অংশে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা যায় তাহলে স্ট্রোকের ভয়াবহতা অনেকটা কমানো যায়।
হেমোরেজিক স্ট্রোক: মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।
ইস্কেমিক স্ট্রোকের আছে আধুনিক চিকিৎসা। রক্তনালি বন্ধ হলে তা খুলে দেয়ার জন্য দুটো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আইভি থ্রোম্বলাইসিস ও মেকানিকেল থ্রোম্বেকটমি। মস্তিষ্কের রক্তনালিতে জমে যাওয়া রক্ত শিরাপথে ওষুধের মাধ্যমে গলিয়ে দেয়া যায়। একে বলে আইভি থ্রোম্বলাইসিস। স্ট্রোকের সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে এ চিকিৎসা দেয়া যায়। ১৯৯৬ সালে এফডিএ স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে এল্টিপ্লেজের অনুমোদন দেয়। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী স্ট্রোকের চিকিৎসা হিসেবে আইভি থ্রোম্বলাইসিস ব্যবহার করা হচ্ছে। আধুনিক এ চিকিৎসার ফলাফল কিন্তু বেশ আশাব্যঞ্জক। গবেষণায় দেখা গেছে এ চিকিৎসা পাওয়া রোগীদের ৭০ শতাংশের উন্নতি হয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস) হাসপাতালে এ চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।
মেকানিক্যাল থ্রোম্বেকটমি— স্ট্রোক অত্যাধুনিক চিকিৎসা। ইস্কেমিক স্ট্রোকের রোগী সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে আসলে তাদের অ্যাল্টিপ্লেজ দিয়ে আইভি থ্রম্বোলাইসিস করা যায়। সাড়ে ৪ ঘণ্টার পরে আসলে স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা হলো মেকানিকাল থ্রোম্বেকটমি। স্ট্রোকের ৬ ঘণ্টার মধ্যে আসলে অত্যাধুনিক চিকিৎসা করা সম্ভব। রোগীকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে হার্টের এনজিওগ্রামের মত ব্রেনের এনজিওগ্রাম করা হয়।
যদি তাতে দেখা যায় মস্তিষ্কের মোটা রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধেছে তাহলে একটি বিশেষ সাহায্যে জমাটবাধা রক্ত টেনে বের করে আনা হয়। ফলে বন্ধ রক্তনালি খুলে যায়। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়।
শতকরা ৭০ ভাগ রোগী এতে সুস্থ হয়ে যান। আমাদের দেশে চিকিৎসা এখনো জনপ্রিয় হয় নি। কিছু কারণে শুরু করা সম্ভব হয় নি।
কিন্তু এ চিকিৎসা উন্নত দেশগুলোতে খুবই জনপ্রিয়। মানুষের জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা। এ চিকিৎসায় প্রফেসার সরদার গেইক (Serdar Geyik) বেশ নামকরা। তার কাছ থেকে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেকটমির খুঁটিনাটি শিখতেই ইস্তাম্বুলে আসা। ইস্তাম্বুল আইডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল হাসপাতালটি স্ট্রোক চিকিৎসা কীভাবে দেয়, তা নিয়েই আজকের লেখা।
এখানে এসেই পরিচয় হয় ইরানি চিকিৎসক এহসানের সঙ্গে। উনিও প্রশিক্ষণের জন্য এসেছেন। উনি দুই মাস ধরে আছেন। তাঁর সঙ্গে প্রথম কথায় বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে যায়। তাঁর কাছে থেকে তালিম নেই কিছু কিছু বিষয়ে। দুজন মিলে গল্প করছি। হঠাৎ হাসপাতালের মাইকে ঘোষণা হলো, দিক্কাত দিক্কাত, নোরকোড। দিক্কাত দিক্কাত, নোরকোড।
বাংলা মানে দাঁড়ায় সাবধান, সাবধান, স্ট্রোকের রোগী এসেছে।
ইরানি এহসান বললেন, স্ট্রোকের রোগী এসেছে। চলুন।
এ হাসপাতালের ক্যাথল্যাব মাটি থেকে ২ তলা নিচে। দুজন মিলে লিফট দিয়ে আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোরের ইমার্জেন্সি বিভাগে চলে আসি।
একজন স্ট্রোকের রোগী শুয়ে আছেন। ওনাকে ঘিরে রেখেছে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান। আমি অবাকই হলাম। আমরা ২ তলা আসতে আসতে এত্ত জন চলে এসেছেন। ভিড়ে স্ট্রোক নিয়ে কাজ করা একজন প্রফেসর দেমেতকেও দেখলাম।
রোগী স্ট্রোক করার ২ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে চলে এসেছেন। স্ট্রোক নির্ণয় করার পর দেখলাম প্রফেসর দেমেত রোগীর লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। টার্কিশ ভাষায় কথা বলছেন তাঁরা। আমি যতটুকু আন্দাজ করলাম, উনি রোগীর লোককে স্ট্রোক সম্বন্ধে বোঝালেন। স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা সম্বন্ধে জানালেন।
রোগীর স্বজন অনুমতি দেওয়ামাত্রই চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশয়ান সবাই মিলে রোগীকে নিয়ে ছুটে গেলেন সিটিস্ক্যান রুমে। সিটিস্ক্যান রুমের টেকনিশিয়ানও রেডি। রোগী যাওয়ামাত্রই সিটিস্ক্যান মেশিনে তোলা হলো। কোথাও সেকেন্ডের বিলম্ব নেই।
সিটিস্ক্যান পরীক্ষা করে স্ট্রোকের চিকিৎসক সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট পাঠালেন প্রফেসর সরদার গেইকের মোবাইলে। তিনি রিপোর্ট দেখে জানালেন রোগীর মেকানিক্যাল থ্রোম্বেকটমি করতে হবে। এত্তগুলো কাজ কতক্ষণে শেষ হয়েছে? অনুমান করুন। ২ ঘণ্টা না তার বেশি?
অবাক করা ব্যাপার হলো এত্ত কিছু শেষ হয়েছে মাত্র ১৫ মিনিটে!
আমি ভাবছি আমাদের দেশে কতক্ষণ লাগত। রোগীর লোকের অনুমতি পেতেই ২ ঘণ্টা যেত। রোগীকে নিয়ে সবাই ছুটছে ক্যাথলবে। সঙ্গে আছি এহসান ও আমি। ২ ফ্লোর নিচেই ক্যথাল্যাব।
ক্যাথল্যাবে ঢুকে আমিও থ বনে গেলাম। প্রফেসর সরদার গেইক ওটি ড্রেস পড়ে রেডি হয়ে বসে আছেন। রোগীকে ক্যাথল্যাবের টেবিলে তোলা হলো।
কুচকিতে ছোট একটা ফুটা করে ক্যাথেটার, ওয়ার, স্টেন্ট দিয়ে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে জমাটবাধা রক্ত বের করে আনেন প্রফেসর সরদার। বন্ধ রক্তনালি আবার সচল হয়। ক্যাথল্যাবের এ কাজে সময় লাগে সর্বোচ্চ ১০-১৫ মিনিট। পরে রোগীকে স্ট্রোক ইউনিটে শিফট করা হয়।
স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসায় এরা একেবারে দক্ষ। চিন্তা করা যায় হাসপাতালে পৌঁছার মাত্র ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে।
আমার কাছে মনে হয়েছে স্ট্রোক চিকিৎসায় এদের ডেডিকেশন এদেরকে এ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।
পরের দিন রাত তিনটা। হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠে। হাসপাতাল থেকে ফোন। স্ট্রোকের রোগী এসেছে।
আমি পড়িমরি করে ছুটলাম। হোটেল থেকে হাসপাতালে যেতে হেঁটে ১০ মিনিটের মতো লাগে। গিয়ে অবাক হয়ে যাই। রোগী নিয়ে ক্যাথল্যাবে বসে আসছে প্রফেসর দেমেত ও তাঁর দল। কাজ শেষ করে ঘণ্টাখানেক পর হোটেলে ফিরে আসি। সাড়ে ছয়টায় আবার হাসপাতাল থেকে ফোন। আমিও দৌড়ে যাই। সাড়ে সাতটায় হোটেলে ফিরি। ৯টায় অফিসে গিয়ে দেখি সবাই অফিসে চলে এসেছে।
রোববার, বন্ধের দিন। বিকেলে ভাবছি কোথাও ঘুরতে যাব। ৪ কিলোমিটার দূরে একটা লেক আছে। বেশ সুন্দর। লেকের পাড়েই সাজানো পার্ক। পার্কের মধ্যে হাঁটছি। লেকের পাড়ে বসে আছি। মিনিট দশেক পর হাসপাতালের ফোন। আমিও দেরি না করে ট্যাক্সি নিয়ে ছুটে যাই হাসপাতালে। রাস্তায় জ্যাম থাকায় আসতে ৩০ মিনিটের বেশি লাগে। এসে দেখি অপারেশন শেষের দিকে।
স্ট্রোকের চিকিৎসায় কী ডেডিকেশন তাদের! অবশ্য তাদের আরও কিছু সুবিধা আছে। অপারেশনে তাদের যে ডিভাইস লাগে, তা তাদের কাছে সহজলভ্য। তারা চাইলেই যেকোন ডিভাইস ব্যবহার করতে পারে। রোগী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে চিকিৎসকের সম্পর্ক বেশ ভালো। আমাদের দেশে কেন যেন চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে সম্পর্ক সুখকর নয়।
চিন্তা করুন চিকিৎসক ২৪ ঘণ্টা রোগীর চিকিৎসা দেয়ার জন্য স্ট্যান্ডবাই থাকেন। আমাদের দেশেও চিকিৎসকরা নির্ঘুম রাত কাটান। পারিবারিক কোনো প্রোগ্রামে উপস্থিত হতে পারেন না। পরিবারকে সময় দিতে পারেন না। তারপরও চিকিৎসকদের নিগ্রহের শিকার হতে হয়। চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীদের সম্পর্ক খারাপ করে কারা সুফল ভোগ করছেন তা একটু চিন্তা করুন।
আইডিনে যে সব সময় চিকিৎসায় সফল হয়, তা–ও না। একদিন এক রোগীকে অনেকবার চেষ্টা করেও রক্তনালি খোলা যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর রোগীকে ওপরওয়ালার সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন। কিন্তু রোগীর লোকেরা চিকিৎসকের সঙ্গে টুঁ শব্দ করেননি। হাসপাতাল ভাঙচুরের প্রশ্নই আসে না। কোনো দিন প্রশ্ন করে নাই, এত টাকা খরচ হল কিন্তু রোগী ভালো হলো না কেন?
স্ট্রোকের চিকিৎসায় আইডিন এত দূর এগিয়ে গেছে শুধু তাদের ইচ্ছায়। তাদের চিকিৎসক কিন্তু বেশি না। সিনিয়র জুনিয়র মিলে স্ট্রোকে কাজ করে মাত্র ৪ জন চিকিৎসক। তাদের দিয়েই ২৪ ঘণ্টা স্ট্রোক চিকিৎসা চলছে। তাদের স্ট্রোকের বেড আছে মাত্র ১২টি। এত কম বেড দিয়ে তারা বছরে পাঁচ শর মতো মেকানিক্যাল থ্রোম্বেকটমি করে। ভাবতেই অবাক লাগে।
আমাদের দেশে স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল আছে। আধুনিক ক্যাথল্যাব আছে। কিন্তু যে ডিভাইসের দরকার হয়, তার দাম বেশি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমাদের দেশেও এ চিকিৎসা সহজলভ্য করা সম্ভব। একদিন আমাদের দেশেও ইস্তাম্বুলের মতো স্ট্রোকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা হবে, প্রতিনিয়ত সে স্বপ্নই দেখি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস), আগারগাঁও, ঢাকা
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]