পাকিস্তানিরা লজ্জিত, ক্ষমা চায়

আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তানের চিকিৎসকের সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

ইমরান খান তাঁর জনসভায় বলেছিলেন, বাংলাদেশিদের সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষ যা করেছে, তাতে তিনি লজ্জিত। এমনকি তিনি আমাদের জনগণের কাছে ক্ষমা চান। তাঁর এ বক্তব্য আমার কাছে রাজনৈতিক মনে হয়েছিল। পাকিস্তানি জনগণ কী মনে করে, তা আমার জানার ইচ্ছে ছিল।

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আছি এখন। দুই সপ্তাহ ধরে ইস্তাম্বুলের একটি হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। সেই সঙ্গে নিউরোইন্টারভেনশনের আন্তর্জাতিক একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। পাকিস্তানের কয়েকজন আসেন সেখানে। পরিচয় হয়, কথা হয়। আমাদের দেশের উন্নয়নে তাঁরা খুব খুশি। তাঁদের রুপি এখন আমাদের টাকার অর্ধেকের কম। মানে তারা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। যদিও বেশ কিছু কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেমিনারে অংশ নেওয়া পাকিস্তানি চিকিৎসকেরা তাঁদের পূর্বপুরুষের অতীত কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত মনে হলো।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মারমারা সাগর মাত্র চার কিলোমিটার দূরে। শনিবার হাসপাতালের কাজ না থাকায় ভাবলাম হেঁটেই যাব। আসরের নামাজ পড়ে রওনা দিই। হেঁটে যাতে ৩৫-৪০ মিনিট লাগল। অসাধারণ প্রকৃতি। সাগরের নীল পানি দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। সাগরের পাশেই সাজানো পার্ক। এ পার্কের নাম মেনেকসে সাহিল পার্ক। সারি সারি পাতানো চেয়ার। একেবারেই সমুদ্রের কাছ ঘেঁষে বসানো হয়েছে চেয়ারগুলো। চেয়ারে বসে প্রকৃতি উপভোগ করা যায়। পার্কের সবুজ আর সমুদ্রের নীল পানি চোখের প্রশান্তি আনে।

আরও পড়ুন

এ দেশে একটা জিনিস বেশ ভালো লাগল, তাহলো শিশুদের খেলার জায়গা। মসজিদের পাশেই ছোট বাগান করে সেখানে বাচ্চাদের দোলনা, স্লিপারসহ নানান খেলনা রাখা আছে, যেন তারা খেলতে পারে।

মারমারা সমুদ্রের পাশের এ বাগানেও বেশ কিছু খেলার সামগ্রী দেখে নিজের ছেলের কথা মনে পড়ল। কিছু টার্কিশ ছেলেমেয়েকে খেলাধুলা করতে দেখলাম। দুটি ছেলে ফুটবল নিয়ে খেলছে। ছেলের বন্ধুদের মতোই লাগছে। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেললাম। তারাও মজা পেল।

সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকতে আমার বেশ ভালো লাগে। সমুদ্রের বাতাস শরীরে যেমন প্রশান্তি আনে, তেমনি মনকেও প্রশান্ত করে তোলে। কক্সবাজারে গিয়ে একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও বিরক্ত লাগত না। কক্সবাজারের ভিড়ভাট্টা এখানে নেই। চারদিকে শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ। শুধু কিছু টার্কিশ পরিবার চাদর বিছিয়ে চা-নাশতা খাচ্ছে।

আমি চেয়ারে বসে আছি আর যত দূর চোখ যায় সমুদ্র দেখছি। বেশ প্রশান্তি লাগছে। সমুদ্রে বড় বড় জাহাজগুলো নোঙর করে রেখেছে। ঠান্ডা বাতাসে শীত শীত অনুভব হলেও খারাপ লাগছে না।

দূর থেকে দেখলাম সমুদ্রের তীর থেকে কাঠের সাঁকো বানিয়ে সমুদ্রের কিছুটা ভেতরে যাওয়ার রাস্তা বানানো হয়েছে। ইচ্ছে হলো কাঠের সাঁকোতে গিয়ে কিছু ছবি তুলব। সেখানে দুজন মাছ ধরছেন। ভাবলাম তাঁদের একজনকে ছবি তোলার অনুরোধ করব। আমি দূর থেকে মাছ ধরা দেখছিলাম। অল্প বয়স্ক ছেলেটা আমাকে কাছে ডাকল। আমি ওকে ছবি তুলে দিতে বললাম। তুলে দিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল বাড়ি কোথায়? বাংলাদেশ বলাতে বেশ উচ্ছ্বসিত হলো। আমি জানতে চাইলাম বাংলাদেশ চেনে কি না? সে বলল, হ্যাঁ, সে চেনে। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধু বাংলাদেশি।

আমি তাকে টার্কিশ ভেবেছিলাম।

সাঁকোর ওপর দুজন বসে আছে। ছবি তুলে দেওয়া ছেলেটাও। ওর নাম ফাহাদ। এসে যুক্ত হয় তাদের সঙ্গে। চিপস, কোমল পানীয় খাচ্ছে। আমি ফিরে যাচ্ছি। আমাকে দেখে একজন জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশে বাড়ি কই, কক্সবাজার? বাংলায় দু–একটা কথাও বলে। আমাকে বসে তাদের সঙ্গে চিপস খেতে অনুরোধ করে। আমাকে তারা জানায় তারা পাকিস্তানি।

ফাহাদ লাহোরের ও অন্য দুজন করাচির। তিনজন মিলে তুরস্কে ব্যবসা করছে। ফাহাদ ব্যবসার পাশাপাশি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।

সমুদ্রের পাড়ে পাকিস্তানের আদনান ও ফাহাদ
ছবি: লেখক

বাংলাদেশের বেশ প্রশংসা করে তারা। করাচির আদনান জানায়, করাচিতে নাকি বেশ কয়েক লাখ বাংলাদেশি আছেন। তার বাবা প্রতি শুক্রবার সেখানে যান। সেখান থেকে বাংলাদেশের আনারস, আমড়া কিনে আনেন। সেখানে নাকি ঝাল–ঝোলের মাছের তরকারি পাওয়া যায়। বেশ সুস্বাদু। বাংলাদেশে ঘুরতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে আদনানের।
হালকা ধরনের আলোচনা হচ্ছিল। হঠাৎ করে ফাহাদ আমাকে প্রশ্ন করে, তোমরা কি আমাদের এখনো ঘৃণা করো? শুধু প্রশ্ন করেই থামে না, আমাকে বলে, মন থেকে উত্তর দেবে। মিথ্যা কিছু বলবে না।

আমি বেশ হকচকিয়ে গেলাম। কেউ সামনাসামনি জানতে চায়, তাকে আমি ঘৃণা করি কি না? সময় নিচ্ছি কী উত্তর দেব।

আমি সময় নিচ্ছি দেখে সে বলল, দেখো আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভালো কাজ করেননি তোমাদের সঙ্গে। আমরা লজ্জিত। তোমরা আমাদের মুসলিম ভাই। কীভাবে এক মুসলিম ভাই অন্য মুসলিম ভাইয়ের ওপর অত্যাচার করতে পারে! কীভাবে মা–বোনদের ধর্ষণ করতে পারে! কীভাবে তোমাদের সম্পদ লুট করে এনে আমাদের পাকিস্তানে খরচ করতে পারে!

সে আরও বলে, ‘আমি সত্যি বলছি, আমাদের পূর্বপুরুষের কাজে আমরা লজ্জিত, তোমাদের কাছ ক্ষমা চাই।’ অন্য দুজন হাতজোড় করে ক্ষমা চায়। আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি।

ওদের থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় আদনান তার বাসায় দাওয়াত দেয়। তার টিকটক চ্যানেলে আমাকে নিয়ে ভিডিও করে। বাংলাদেশি বলে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।

ছাত্র ছেলেটা বলে, শোনো, আমরা আগের সব ইতিহাস জানি। তোমাদের ব্যাপারটা আমাদের অন্তরে বেশ অস্বস্তি করে। তোমরা বেশ উন্নতি করেছ দেখে আমাদের ভালো লাগে। তোমাদের জন্য দোয়া থাকে সব সময়।

ফেরার পথে বারবার চিন্তা করছি এখনকার পাকিস্তানিরা মননে উন্নত। না হলে কি ওরা এভাবে ক্ষমা চায়? ব্রিটিশরা কত শোষণ করেছে। কই, আমাদের কাছে তো কোনো দিন ক্ষমা চায়নি। আরও কতজন কতভাবে শোষণ করছে, তারা তো উল্টো আমাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। চলবে...

  • দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]