ইস্তাম্বুল শহর সমুদ্র পরিবেষ্টিত। এক পাশে মারমারা সাগর ও অন্য পাশে কৃষ্ণসাগর। দুটি সাগরকে যুক্ত করেছে বসফরাস প্রণালি। সাগরে পরিবেষ্টিত বলেই যুগে যুগে শাসকের পছন্দের তালিকায় ছিলো ইস্তাম্বুল। বাইজেন্টাইন সম্রাজ্য, রোমান সম্রাজ্যের এক সময়ের রাজধানী ছিল এটি। ইস্তাম্বুল যে মুসলিমদের পদাবনত হবে, তা তিনি আগেই বলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ, তুর্কিরা যাকে ফাতিহ মেহমেত বলে, ইস্তাম্বুল জয় করে তা অটোমান সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। ইস্তাম্বুলে কত শক্তিশালী রাজার ছিলেন এক সময় ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
ইস্তাম্বুলের সৌন্দর্য অপরিসীম। দুই পাশের সাগর ও চারপাশে সাতটা পাহাড় মিলে এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
স্ট্রোকের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমি আছি ইস্তাম্বুল আইডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল হাসপাতালে।
উঠেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই একটি হোটেলে। এখান থেকে মারমারা সাগর বেশ কাছেই, আড়াই কিলোমিটার হবে। বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ হয়ে যায়। এখানে সূর্য অস্ত যায় সাড়ে আটটায়। অফিসের পর অনেকটা সময় ফ্রি থাকা যায়। তাই সিদ্ধান্ত নেই পাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখব। প্রথম দিন দেখতে যাই ইয়ারিমবুরগাজ গুহা। অনেক পুরাতন গুহা। এটা নিয়ে পরে আলাপ করব। পরের দিন দেখতে যাই মারমারা সাগর। গুগল ম্যাপ বের করে সাগরের একদম শেষ প্রান্ত বাছাই করি।
মেকেজি শাহিল বা পার্ক এলাকাটা বেশ পছন্দ হলো। ম্যাপে দেখলাম এর এক পাশে মারমারা সাগর ও অন্য পাশে কুকুকসেকামেসি হ্রদ। দুটোর মধ্যে গ্যাপ মাত্র ১৫০ মিটার। পাহাড়ের ওপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। পাহাড়ের ওপর একটা অংশ থেকে সাগর ও হ্রদ দুটোই দেখা যায়।
গুগল ম্যাপ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ৪০-৪৫ মিনিট পর পৌছে গেলাম মেকেজি পার্কে। পার্কটি সাগরের সঙ্গে। অসাধারণ দৃশ্য, পাশে সাগর আর এক পাশে সবুজ পার্ক। পার্কে অসংখ্য চেয়ার বা বেঞ্চ পাতা আছে। চেয়ারে বসে সাগর দেখতে খুব ভালো লাগে।
সাগর আমাকে খুব টানে। সাগরের পাড়ে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। সাগরের পাড়ে পানির ঝমঝম শব্দ শুনতে শুনতে হারিয়ে যাই আমার ছোটবেলায়, অতীতে। সাগরের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও আমার মন ভরে না। কক্সবাজারে সাগর খুব উত্তাল থাকে। হাজার হাজার মানুষের ভিড়।
সাগরকে সেভাবে উপভোগ করা যায় না। এখানের সাগর খুব শান্ত। পাশে বসে থাকলে মনে হয় পানির কুলকুল শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। মানুষজনও বেশি থাকে না। কিছু কপোত-কপোতী, কিছু পরিবার ও বাচ্চাকাচ্চা। পরিবারগুলো পার্কে বিছানা বিছিয়ে চা-নাশতা খায় আর সাগর দেখে। কপোত-কপোতীরা সাগরের পাড়ে বসে হাত হাত রেখে কত যে গল্প করে ইয়াত্তা নেই। আর আমার মতো গুটিকয়েক সাগরের যত দূর চোখ যায় তাকিয়ে থাকে।
মারমারা সাগরের নীল পানি মায়া ধরায়। ইস্তাম্বুলে আবহাওয়ার ঠিক নেই। এই মেঘ তো এই রোদ।
বিকেলটা মেঘমুক্ত আকাশ। এসব দেশের আকাশ আমার কাছে কেন যেন অন্য রকম লাগে। এত্ত পরিষ্কার আর এত্ত নীল আকাশ। অসাধারণ, অবর্ণনীয়। আমাদের দেশে মনে হয় দূষণের জন্য আকাশ এত্ত নীল হয় না। আকাশ যত বেশি নীল হয়, সাগর তত বেশি মোহনীয় হয়ে ওঠে। নীল সাগরের চোখ চোখ রাখা প্রেমিকার চোখে চোখ রাখার চেয়েও বেশি মোহনীয় মনে হয় আমার কাছে।
ইস্তাম্বুল বেশ শীতের শহর। সাগরের কাছে আরোও ঠান্ডা থাকে বেশি। ঠান্ডা বাতাসে পরিবেশ আরোও মোহনীয় করে তোলে। সাগরের কিছুটা দূরে জাহাজগুলো নোঙর করে রাখা। সাগরে সিগালগুলোর ওড়াওড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগে।
পার্কের বসে ঠান্ডা হাওয়ায় মোটা জ্যাকেট মুড়ি দিয়ে বসে বসে ভাবি আল্লাহ আমাকে কত দয়া করেছেন। গাইবান্ধার সেই অজপাড়াগাঁ থেকে আজ আমি শক্তিধর শাসকদের শহরে। বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছি। দেখছি নতুন নতুন কত কিছু। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই আনমনে।
সাগরে আর একটা জিনিস আমার খুব মোহনীয় লাগে। সেটা হলো সাগরে সূর্যাস্ত। সূর্য যখন ডোবা শুরু করে কিছু সময়ে নীলাকাশ যেন হলুদে রাঙিয়ে ওঠে। দেখতে অন্যরকম লাগে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য টুপ করে ডুব দেয়। এসব দৃশ্য আমি এক ধ্যানে তাকিয়ে দেখি। সে সময় আশেপাশে কী হচ্ছে ভুলে যাই।
সুর্যাস্তের পর ঠান্ডা বাতাস আরও বেড়ে গেলো মনে হচ্ছে। হু হু করে কানে এসে লাগছে। জ্যাকেটের কলার উঁচু করেও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। পার্কে কিছু টিনের চালা দিয়ে ঘরের মতো বানিয়ে রাখা আছে। সেখানে এসে সাগরের সামনে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষ করেই হোটেলের পথে রওনা দিলাম।
মারমারা সাগরের প্রেমে পড়ে গেছি মনে হচ্ছে। পরের দিন অফিস শেষ করেই আবার মারমারার পাড়ে যাব বলে ঠিক করলাম। গুগল ম্যাপ দেখে ঠিক করলাম ফ্লোরইয়া সাহালি পার্কে যাব। একেবারে মারমারা সাগরের পাড়ে। ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম। ১৫ মিনিট লাগল। এ পার্কে যেতে পাহাড়ের ওপর উঠতে হয়।
পাহাড়ের ওপর দিয়ে রাস্তা বানানো। বেশ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এ পার্কটিও খুব সাজানো–গোছানো। তবে এখানে সাগরের পাড়ে বড় বড় শিলা দেখলাম। আমাদের দেশে অনেকটা ছেড়াদিয়া দ্বীপের মতো। একটা শিলার ওপর বসে সাগর দেখতে থাকি। নীলাকাশ সাগরের সঙ্গে মিশে একাকার। সাগরে এসেছি আর সূর্যাস্ত না দেখলে হয়। সূর্যাস্তের পর পাশেই একটা শপিং মলে গেলাম। বিরাট বড় শপিং মল। তার চেয়ে বড় ফুড কোর্ট। সাগরকে ঘিরে বানানো হয়েছে ফুড কোর্ট। সাগর দেখতে দেখতে খাওয়ার জন্য এ ব্যবস্থা।
সাগরের পাড়ে যখন বসে ছিলাম, তখনই নাকে কাবাবের গন্ধ এসে লাগছিল। তখনই ভেবেছিলাম, এখানে খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরব। ফুড কোর্টে অনেক মানুষ খাচ্ছে। কিন্তু কোনো কোলাহল নেই।
সাগরের পাড়ে এসে সামুদ্রিক মাছ না খেলে কি হয়? ফুড কোর্টে সি-বাস মাছের কাবাব অর্ডার করলাম সঙ্গে ভাত। এরা যেকোন খাবারের সঙ্গে পাউরুটি ফ্রি দেয়। জয়তুনের আচারের সঙ্গে সামুদ্রিক মাছের কাবাব খেতে বেশ লাগল। বেশি ভালো লাগলো সাগরের সামনে বসে সাগর দেখতে দেখতে খাওয়া।
সাগরের হিমেল বাতাসে যেন সমস্যা না হয়, তাই প্রত্যেক টেবিলে আছে হিটার। সামনে সাগর, সাগরের হিমেল বাতাস আর হিটারের উষ্ণ বাতাস মিলেমিশে অন্য রকম আবহ তৈরি করেছে। ইস্তাম্বুলে এসে ভালো খাবারের পর বাকলাভা না খেলে কি হয়! আমি যেখানে বসেছি, তার পাশেই ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত হাফিজ মোস্তফা বাকলাভার দোকান। ১৮৪৭ সাল থেকে তারা বাকলাভার ব্যবসা করছে। ভাবা যায়! দুই পিস বাকলাভা মুখে দিয়ে হেঁটেই হোটেলের রাস্তা ধরলাম।
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]