স্ট্রোকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা নিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চার দিন ধরে আন্তর্জাতিক সেমিনার হবে। বেশ আগে থেকেই খবর নিয়ে রেখেছি। আয়োজক সংস্থা বেশ কিছু গ্রান্টের ব্যবস্থা রেখেছে। এ গ্রান্টের মধ্যে আছে যাতায়াতের টিকিট, পাঁচ তারকা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা ও খাবারদাবার। আমি নিউরোলজিস্ট হিসেবে কাজ করছি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস) হাসপাতালে। স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসায় দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের মধ্যে এগিয়ে আছে নিনস। এ হাসপাতালের স্ট্রোকের চিকিৎসা এগিয়ে নিতে এ আন্তর্জাতিক সেমিনারগুলোয় অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। গ্রান্টের আবেদন করার পর অপেক্ষায় থাকি। হঠাৎ ই-মেইলে গ্রান্ট পাওয়ার খবর আসে। যেহেতু সরকারি চাকরি করি তাই গ্রান্ট ছাড়া ছুটি পাওয়া যায় না। গ্রান্ট পাওয়ায় ছুটি নিয়ে সমস্যা আর থাকল না।
ইস্তাম্বুলে একজন নিউরোইন্টারভেনশনালিস্ট অধ্যাপক সরদার গেইক স্ট্রোকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমিতে খুব নামকরা। আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে এ চিকিৎসা সেভাবে শুরু করা যায়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিই যেহেতু ইস্তাম্বুলে যাচ্ছি অধ্যাপক সরদার গেইকের সঙ্গে কিছুদিন হাতে-কলমে স্ট্রোকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা শিখে নেব। ই-মেইলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। সেমিনার ও প্রশিক্ষণ মিলিয়ে বেশ কিছু দিন ইস্তাম্বুলে থাকতে হবে। প্রস্তুতিও নিলাম। ইস্তাম্বুলে আসার আগের দিন ব্যাগ গোছাচ্ছি। কাপড়চোপড় সব নিলাম। দেশে বৃষ্টির জন্য হাপিত্যেশ। তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপন্ন। হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন কয়েকজন। যেদিন ব্যাগ গোছাই সেদিন রোদ না যেন আগুন ঝরছিল। আসার সময় কী মনে করে একটা জ্যাকেট ব্যাগে ঢুকিয়েছিলাম। সেটি যে এত কাজে দেবে, তা বুঝতে পারিনি।
এমিরেটস এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে দুবাইয়ে ট্রানজিট হয়ে চলে আসি ইস্তাম্বুল। কত স্মৃতিবিজড়িত শহর ইস্তাম্বুল। বাইজেন্টাইন, রোমান, অটোমান শাসকের কত স্মৃতির এ শহর। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
দুবাই বিমানবন্দরে বিমান আধা ঘণ্টা ধরে শুধু চক্কর দেয়। কেন যেন নামতে পারছিল না। ভয় পেয়েছিলাম বেশ। দুবাই থেকে ইস্তাম্বুল আসার পথে ৪ ঘণ্টার প্রায় ৩ ঘণ্টাই টার্বুলেন্সে পড়ে বিমান। টার্বুলেন্স মানেই ঝাঁকুনি। ইস্তাম্বুলে ল্যান্ড করার ঘোষণায় ভয় কেটে গেল। বেশ গোছানো বিমানবন্দর ইস্তাম্বুল। সরকারি পাসপোর্টে অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে লাগেজ বেল্টে যাই। গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে লাগেজ পাওয়ায় বেশ অবাক হয়ে যাই। আমাদের বিমানবন্দরে কেন যেন এত্ত সময় লাগে জানি না।
ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে ফ্রি ওয়াই-ফাই আছে। এক ঘণ্টার জন্য ব্যবহার করা যায়। স্পিড ভালো। দুবাইয়ে ফ্রি ওয়াই-ফাই আছে। কিন্তু নেটওয়ার্ক দুর্বল। কথা ঠিকমতো বলা যায় না। ইস্তাম্বুলে ওয়াই-ফাই অসাধারণ।
দেশে থাকতেই অনলাইনে ট্যাক্সি বুকিং করেছিলাম। ওয়াই-ফাইয়ের কানেকশন দিতেই দেখলাম ট্যাক্সি থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে। গেট দিয়ে বাইরে বের হতেই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ট্যাক্সিতে করে যখন হোটেলে আসি, তখন এ দেশে রাত সাড়ে ১২টা।
বিমানে দেওয়া কিছু রুটি এনেছিলাম। সেটা খেয়ে গোসল সেরেই ঘুম দিই। সকাল ৯টায় হাসপাতালে যেতে হবে।
সকাল ৮টায় শার্ট ও প্যান্ট পরে তৈরি হই। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য হোটেলে থেকে রাস্তায় নেমেছি। ১-২ মিনিট হাঁটার পর মনে হলো ঠান্ডায় জমে যাব। ঠান্ডা বাতাসে গায়ে হিম ধরিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঠান্ডায় দাঁতে দাঁতে লেগে যাচ্ছে। খুব অবাক হলাম। এত্ত ঠান্ডা হবে কল্পনাও করিনি। আশপাশের সবাই প্রায় আইডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ঠান্ডা নিয়ে কারও মাথাব্যথাই যেন নেই। কয়েকজনকে জ্যাকেট পড়া দেখলাম। কী করব ভাবছিলাম।
আমি সহজেই ঠান্ডায় আক্রান্ত হই। আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। সেখানে ঠান্ডার দিনে শরীরের রক্ত জমে আসে। কিন্তু আমি কেন ঠান্ডা সহ্য করতে পারি না, তা নিয়ে আমার স্ত্রীর বেশ অভিযোগ আছে।
হিম ধরা বাতাসে রক্ত জমে যাচ্ছিল মনে হলো। সেই সঙ্গে বাসার কথা মনে পড়ল, শীতের দেশে যার জন্ম, সে কেন শীত সহ্য করতে পারে না।
না, দেরি না করে হোটেলে আবার ফিরে এলাম। লাগেজ খোলা হয়নি তখনো। লাগেজের তালা খুলে সব নিচে থেকে বের করলাম জ্যাকেটটা। আমার এক রোগীর গার্মেন্টসের ব্যবসা আছে। গেল শীতে তিনি আমাকে উপহার দিয়েছেন। এত্ত মোটা জ্যাকেট কী করব, তা ভেবেছিলাম তখন। তবে বেশ সুন্দর জ্যাকেটটি। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে আবার রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ি। বেশ আরাম লাগল। রক্ত হিম করা ঠান্ডা বেশ উপভোগ্য মনে হলো।
হাসপাতালে গেলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম আমার ডিপার্টমেন্ট কই? ইংরেজি কেউ বুঝে না। একজন কিছুটা বুঝে আমাকে আর একজনের কাছে নিয়ে গেল। সে আমাকে বলল, যে ইংরেজি বোঝে, সে ৯টায় আসবে অপেক্ষা করো।
গত দিন বিমানে খেয়েছি। রাতে ছোট একটা পাউরুটি খেয়েছি। পেট খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। ওকে বোঝালাম আমি ক্যানটিনে যাচ্ছি পরে আসব। ক্যানটিনে খাচ্ছি আর আমার ডিপার্টমেন্টের কো-অর্ডিনেটর ওমিতকে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে বললাম আমি ক্যানটিনে আছি। সে-ও ভালো ইংরেজি পারে না। ঠিক ৯টায় ক্যাথল্যাবের টেকনিশিয়ানকে সঙ্গে করে এসেছে আমাকে ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেতে।
হাসপাতালে পরিচিত হলো ইরানি চিকিৎসক এহসান শারিপিফুরের সঙ্গে। সে-ও এখানে প্রশিক্ষণের জন্য এসেছে। তার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো কিছুক্ষণেই। বেশ মিশুক।
দুপুরে খাবারের জন্য বাইরে যাব আমরা। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যে-ই রাস্তায় নেমেছি, ঠান্ডা বাতাসে কাঁপুনি ধরে গেল। দ্রুত খেয়ে হোটেলে আসি মাফলার নিতে হবে। কী মনে করে মাফলারও নিয়েছিলাম।
হাসপাতালে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে হোটেলে ফিরতে যাব পড়ি বিড়ম্বনায়। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু ঠান্ডায় রক্ত জমে যাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে আবার জ্বর আসে কি না, দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জ্বর হলে কে দেখাবে?
এখানে আসার তিন দিন সূর্যের দেখা নেই। আকাশ মেঘলা। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি। সঙ্গে তীব্র ঠান্ডা। আবহাওয়ার কোনো স্থিতি নেই মনে হয়।
তিন দিন পর হোটেল থেকে বের হয়েছি, হাসপাতালে যাব। সুন্দর রোদ্দুর। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। চারদিক কেমন চকচক করছে। অসাধারণ সাজে সেজেছে প্রকৃতি।
এখানে সূর্যাস্ত হয় সাড়ে আটটায়। পাঁচটায় অফিস শেষ করার পর হাতে অনেক সময় থাকে। চাইলেই ধারেকাছে ঘুরে আসা যায়। গুগলে দেখলাম হোটেল থেকে ট্যাক্সিতে গেলে ১৫ মিনিটে ক্যানারি কোস্ট। এটি হলো কুকুকসেকমেসি হ্রদের তীর। বেশ সাজানো-গোছানো। তীরের পাড়েই পার্ক। সেখানে বাসার জন্য সারি সারি বেঞ্চ পাতা আছে। তুর্কিরা পরিবার নিয়ে এখানে চলে এসেছে।
হোটেলে ফেরার পথে রাতের খাবার খেয়ে যাব। ট্যাক্সি থেকে নেমে রেস্তোরাঁ খুঁজছি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আজকে সারা দিন রোদেলা আবহাওয়ার পর সন্ধ্যার পর আবার বৃষ্টি। আমি ইস্তাম্বুলে আবহাওয়া প্রেডিক্ট করতে পারছি না। বৃষ্টি হলে এত সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস থাকে, যা শরীর হিম করে দেয়। রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁয় খেয়ে হোটেলে ফিরছি, হঠাৎ ঝমঝম করে জোরে বৃষ্টি নামে। কিছুদূর হাঁটার পর শরীর ঠান্ডার জমে আসা শুরু করে। সত্যি সত্যিই দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় করা শুরু করে। মনে হচ্ছে পড়ে যাব। দ্রুত একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে যাই। দুটি মিষ্টি অর্ডার করি। দোকানে ঠান্ডা এতটা নেই। এখানে বেশির ভাগ দোকান রাত ১০টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এখন পৌনে ১০টা বাজে। ১৫ মিনিটে বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, দোকান কখন বন্ধ করবে? সে জানাল রাত ১১টায়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ঝমঝম করে ঝরা বৃষ্টি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। গ্রামে যখন ছিলাম আমার খুব প্রিয় ছিল বৃষ্টি দেখা ও টিনের চালে ঝমঝম শব্দ শোনা।
ইস্তাম্বুলে ঝমঝম বৃষ্টি দেখে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। দোকানের এক কোনায় বসে বৃষ্টি দেখছি, ছোটবেলার কথা ভাবছি। অজপাড়া এক গ্রাম থেকে ইস্তাম্বুলে আসার পথটা পেছনে ফিরে দেখছি। খুব ভালো লাগছে। ঢাকা শহরে ব্যস্ততায় বৃষ্টি উপভোগ করেছি কবে, তা মনে করতে পারছি না।
ইস্তাম্বুলের আবহাওয়া গিরগিটির মতো রং বদলালেও ছোটবেলার স্মৃতি মনে জাগিয়ে দিচ্ছে। চলবে...
* দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]