কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত-চতুর্থ পর্ব

ছবি: সংগৃহীত

এরপর পেশাগত প্রশ্নের দিক থেকে সরে এসে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল ম্যানেজার। জানতে চাইল, তোমার মাতৃভূমি কোন দেশ? এমন তিনটি তথ্য দাও, যেগুলোয় অন্য সব দেশ থেকে তোমার দেশ অদ্বিতীয়।

কোরির এসব প্রশ্ন করার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল স্বাভাবিক বিষয়ে কথা বলতে কতটা পারঙ্গম, সেটা বোঝার চেষ্টা করেছিল ও।

গ্রাহকদের সঙ্গে শুধু বৈষয়িক বিষয়ে কথা বললেই হলো না, অন্যান্য বিষয়েও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারতে হবে।

বেশ নিঃসংকোচে বলে ফেললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা—ব্র্যাক—বাংলাদেশের, যার প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত—কক্সবাজার—আমার দেশে এবং দীর্ঘতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আমাদের দেশে। (ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের)। এগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। ওকে দেশে আসার আমন্ত্রণ জানালাম।

তখন ও জানাল, ভারতের পাঞ্জাবে বেড়াতে গিয়েছিল। ওখানকার খাবারদাবার খুব পছন্দ; যদিও কানাডিয়ানরা মসলাযুক্ত খাবারের ধারেকাছেও ঘেঁষে না! এ ক্ষেত্রে কোরির খাদ্যাভ্যাস ব্যতিক্রমধর্মীই বলতে হবে।

যাতায়াতের ক্ষেত্রে নর্থ সিডনির দূরত্ব অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়; বিশেষ করে যাঁরা সিডনি থেকে যাতায়াত করবে, তাদের ক্ষেত্রে। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে আমার কোনো আপত্তি আছে কি না। এ ব্যাপারে অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম, চাকরির সুবাদে দুর্লঙ্ঘ পথ হলে সেটাও পাড়ি দেব। আসা–যাওয়াতেই দুই ঘণ্টার পথ! আর গাড়িতে সেটা ৪০ থেকে ৫০ মিনিট।

শেষে অভ্যাসবশত জিজ্ঞাসা করল, আমার কোনো প্রশ্ন আছে কি না? এটা সব ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রেই ছিল। প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম, এ প্রশ্নের মাধ্যমেও আপনি চাইলে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর মনে নিজের সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা এনে দিতে পারেন। আমরা পরে দেখতে পাব।

সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হলে বাইরে এসে ওয়ালমার্টের ভেতরে চারদিকে একটু ঘুরে দেখলাম। বেশ উৎফুল্ল লাগছিল। কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো—
এখানে সবজির জন্য কোনো আলাদা ডিপার্টমেন্ট নেই। সিডনি ও সিডনি রিভারের ওয়ালমার্টে আছে। (সিডনি শহর মূলত সিডনি, সিডনি রিভার এবং নর্থ সিডনি—তিন ভাগে বিভক্ত)
অবশ্য ওগুলো আকারে ঢের বড়! ইলেকট্রনিকস ডিপার্টমেন্টও অনেক ছোট।
সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটল বাসায় ফেরার পর।

এসে পৌঁছলাম সাড়ে ৩টা বা ৪টা নাগাদ। ল্যাপটপ নিয়ে বসে ই–মেইলে উঁকি দিতেই দেখি, ‘অভিনন্দন অতনু। তোমাকে ওয়ালমার্ট পরিবারে স্বাগত!’ তবে ওখানে শর্ত হিসেবে এটাও ছিল—আমার আরও কিছু কাজ করতে হবে। কানাডা পোস্টে (সরকারি পোস্ট অফিস) নিজের ছবি যুক্ত সরকারি পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং স্টাডি পারমিট কপি জমা দিতে হবে। এসব যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যেও সব কাজ স্রষ্টার অশেষ আশিসে নির্দ্বিধায় করতে পেরেছিলাম। দিন সাতের মধ্যে যোগদানের তারিখ নিশ্চিত করে আরেকটা ই–মেইল এল। বুঝলাম, শেষ হলো ছয় মাসের অপেক্ষার।

কথায় বলে, সুখের দিন অস্থায়ী! এরপর চাকরি থাকলেও অনেক ঘটনায় জীবন জর্জরিত হয়ে পড়ল। পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষাগত টানা সমস্যার টানাপোড়েনে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কথা দিচ্ছি, এসবের কথা নিয়েও অন্য কোনো সময় গল্পের ঝাঁপি খুলে বসব!

ওয়ালমার্টের জবে পরিশ্রম হচ্ছিল প্রচুর, কিন্তু সে অনুপাতে টাকা কম আর সময়সাপেক্ষও। নিরুপায় হয়ে কাজ করে গিয়েছিলাম দিনের পর দিন। এদিকে ইউনিভার্সিটির পাহাড়সম খরচ মেটাতে অবশ্যই আমার আরও জবের প্রয়োজন ছিল এককথায় অবশ্যম্ভাবী। অথই সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম রীতিমতো। কিন্তু ঈশ্বরে অসীম বিশ্বাস রাখলে তিনি কখনোই কাউকে ফেরান না। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে এক সহপাঠী এগিয়ে এল। জানাল ডিনের সঙ্গে দেখা করার কথা। আরও বলল, আমরা কিছু বিষয় আগে পড়ার সুবাদে ক্রেডিট পেতে পারি। তাহলে বেশ বড় খরচ বেঁচে যাবে। ওর পরামর্শ মতো পরের দিনই ডিনের সঙ্গে দেখা করে নিজের দুরবস্থার কথা জানালাম। তবে এটাও ঠিক, হেলেন, আমাদের ডিন, প্রথম থেকেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে যা হয়! সবকিছু শুনে হেলেন যা জানালেন, তাতে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম! আমাকে ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আপাতত কাজ শুরু করতে বললেন। কাজ মূলত ল্যাবের পরীক্ষার খাতা সংশোধনী করা। এ ক্ষেত্রে এ চাকরি পাওয়াটা ভালো ছাত্র এবং ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কারণে সম্ভব হয়েছিল। তবে সহপাঠিনী আর্শদ্বীপ আমার জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল নিঃসন্দেহে! ইন্টারভিউ নেওয়ার রীতি থাকলেও হেলেন নিজ উদ্যোগেই সেটা তো নেননি, বরং উল্টো অফিস থেকে আমার জন্য সব প্রয়োজনীয় চুক্তির কাগজপত্রও জোগাড় করে আমার সই নিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন যাতে আমি ঠিক সময়ে বেতন পাই আর পড়ার খরচ দিতে পারি! সত্যিই অসাধারণ! এমন সুসম্পর্ক আসলেই ঐশ্বরিক ব্যাপার! তা এখনো বজায় আছে।

দুটি চাকরির সুবাদে আপাতত বেসামাল পথ পাড়ি দেওয়াটা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এল। পরের বছর থেকে খরচ গেল বেড়ে! প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পড়ার খরচ বাড়ায়। এটা একরকম রীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। যতই আমরা বলি না কেন আমরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে বিদেশে যাই। কিন্তু এর আসল রূপ খুবই কদাকার। শিক্ষার বদলে মূল উদ্দেশ্য অর্থ বা পুঁজি উপার্জন! অপ্রিয় সত্যি কথা অকপটে বলতে আপত্তি দেখছি না। কথাটা কেন বললাম, সেটা আগামী পর্বেই আমরা দেখব।

আমি ইউনিভার্সিটির ভেতরে আরও কয়েকটা পদের জন্য আবেদন করেছিলাম। সব সময়ই লক্ষ ছিল ক্যাম্পাসের ভেতরের কোনো কাজ করতে পারা। সাক্ষাৎকারের ডাক পেলাম ক্রীড়া বিভাগের সহকারী ম্যানেজারের পদে। কেপ ব্রেটন ইউনিভার্সিটির চাকরিসংক্রান্ত সব ব্যাপার ই–মেইলেই হয়ে থাকে। ক্রীড়া বিভাগের ম্যানেজার শন রনির ই–মেইলে উল্লেখ করা ছিল—২৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১টা থেকে ২.৩০টার মধ্যে আমি যেন ওর অফিসে উপস্থিত হই। সময় ১৫ মিনিটের বেশি নয়। যথাসময়ে ক্লাসের অবসরে হাজির হলাম সালিভান ফিল্ডহাউসের দ্বিতীয় তলায় কক্ষ নম্বর এ.সি-২১৮–তে।

আরও পড়ুন

আমার আগেই সহপাঠী সিলভার ইন্টারভিউ ছিল। লাইব্রেরিতে যখন শেষ মুহূর্তের ইন্টারভিউর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন সিলভা আগাম শুভকামনা জানিয়ে চলে গেল। ধীরে ধীরে আমিও বুকস্টোরের পাশ ঘেঁষে যে করিডর সোজা স্টুডেন্ট ইউনিয়নের দিকে চলে গেছে, ওদিকে গিয়ে সালিভান ফিল্ডহাউসের দ্বিতীয় তলায় যখন পৌঁছাই, তখন ঘড়িতে ২টা ২৪ মিনিট। ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার। দরজায় টোকা দিলে ভেতর থেকে আওয়াজ এল, ‘কাম ইন।’

কালো রঙের স্যুট পরিহিত ব্যক্তিই শন রনি। আমার সঙ্গে করমর্দন করে বসতে বললেন।

অন্যান্য প্রাথমিক প্রশ্নের পর্ব শেষে মূল প্রশ্নে চলে গেলেন—

কেন এ পদে আবেদন করেছি? কী আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে?

খেলাধুলার সঙ্গে ছোটকাল থেকেই জড়িত। এখানে আসার পর এখানকার খেলার পরিবেশ, নতুন খেলার ধরনের সঙ্গে পরিচিতি আর ইউনিভার্সিটির হয়ে কিছু করতে পারা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, এ পদ আমাকে একদিকে যেমন নতুন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দেবে, তেমনি অনেক নতুন খেলার ধরন যা এত দিন কেউ দেখেনি, সেগুলোকে সবার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার কাজও হবে।

এমন কিছু খেলার উদাহরণ দিতে পারো?

নিঃসন্দেহে! ক্যারম, লুডো, পিকল বল ও বোলিং।

আরও পড়ুন

এ ক্ষেত্রে বোলিংয়ের জন্য আমরা ফিল্ডহাউসে আলাদা একটা জায়গা বরাদ্দ করতে পারি। খুব জনপ্রিয় এ খেলার কথা বন্ধুরা প্রায়ই বলে থাকে। কাজেই বোলিংয়ের সংযোজন অনেক বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে আমাদের ক্রীড়া বিভাগে। পিকল বল আমরা যেখানে ব্যাডমিন্টন খেলছি, সেখানেই হতে পারে। ক্যারমের জন্য যেখানে টেবিল টেনিস খেলা হয়, সেখানে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর লুডোর আয়োজন খুব সহজ, দাবা খেলার মতোই একটা বোর্ড আর গুটির প্রয়োজন হয়।

আর বর্তমানে যেভাবে কাজ হচ্ছে, তার তদারকি কীভাবে করবে, কোনো ধারণা আছে?

হ্যাঁ, মূলত ছেলেমেয়েরা তাদের কার্ড জমা রেখে ভেতরে খেলতে যায়। বাইরের মানুষও আসে, সে ক্ষেত্রে ওদের কাছে থেকে ফি নিতে হয়। কার্ড ছাড়া ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। ওদের খেলাধুলার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগান দেওয়া এবং দেখভাল করার দায়িত্বও আমার  ওপর বর্তায়।

খেলায় কেউ আহত হলে কী করবে? তোমাকে তৎক্ষণাৎ কী ব্যবস্থা নিতে হবে?

আমি সিপিআর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কাজেই কেউ আহত হলে কী করা প্রয়োজন, এর সম্পর্কে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার ধারণা আছে। অবশ্যই জরুরি সেবা ৯১১–এ ফোন করতে হবে যেন সঠিক সময়ে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানো যায়। প্যারামেডিক টিম আসার আগপর্যন্ত চিকিৎসার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।

এরপর আরও কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন, যেমন আমার প্রিয় খেলা, খেলোয়াড় বা দেশে কোনো কোনো খেলা জনপ্রিয়, তা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।

সবকিছু দেখে তখন পর্যন্ত শন রনিকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হতে পারে, তা ঠাওর করতে পারলাম না! ও জানিয়ে দিল, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল ই–মেইল করে জানিয়ে দেবে।

চলবে...

আরও পড়ুন