কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত-১ম পর্ব
নীহারি চাদরে মোড়ানো দেশের এয়ারপোর্টে নেমে ভেবেছিলাম, একি! মহাদেবের কৈলাসে এলাম যে!
সুবিশাল কানাডার ছোট্ট দ্বীপ কেপ ব্রেটনের শান্ত এক শহর, সিডনি! ঢাকার বিমানবন্দরে অভিবাসন কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? অস্ট্রেলিয়া, না কানাডা?’
ইউনিভার্সিটিতে দেখতাম, সবাই পড়াশোনার কথা কম আর জবের কথা বলত বেশি! সবার মুখে এক জিজ্ঞাসা, ‘চাকরি হয়েছে?’ পড়ার কোনো খবর নেই! প্রায়ই ভাবতাম, সবাই এখানে পড়তে এসেছে, না কাজ খুঁজতে! আসলে দ্বিতীয় কারণটাই পরবর্তীকালের জীবনের গতিপথ বদলে দেবে। সবার লক্ষ্য এদিকেই! আমাদের পাঁচজন বন্ধুর গ্রুপে প্রথম চাকরির দেখা পেল ধ্রুব। ওয়ালমার্টের ক্যাশিয়ার।
আমার রিজিউমে নিয়ে পথে পথে ঘোরা শুরু হলো। ধুলোয় ধূসর রাস্তায় নয়, শুভ্রতার পরশে হিমেল শীতে জমে যেতে যেতে। জামার ওপরে জাম্পার, তার ওপরে শীতের জ্যাকেট, মাথায় টুপি, গলায় মাফলার, পায়ে দুজোড়া মোজাসহ বুট। অবশ্যই হাতে দস্তানা আর আমি তো নাক ঢেকে রাখতাম মাস্কে, ঠান্ডায় লালচে হয়ে যেত নাকের ডগা। তখন কিন্তু করোনা মহামারি বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। পৃথিবী জানত না মহাকাল কোনো মোক্ষম দণ্ড নিয়ে অপেক্ষায় আছে! জবের ব্যাপারে কোনো রকম বাছবিচার না করে সুপারস্টোর (ওয়ালমার্ট, আটলান্টিক সুপারস্টোর, সোবিস, নো-ফ্রিলস), বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, কফি শপ (টিম হর্টনস, স্টার বাকস), ফাস্ট ফুড চেইন শপ (ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং, কেএফসি, এ অ্যান্ড ডব্লিউ, ডি কিউ) রেজিউমে জমা দিলাম। পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ রেস্তোরাঁ, ফাস্ট ফুড শপ থেকে ক্রমাগত ঋণাত্মক জবাবের কারণে অন্য জায়গাগুলোয় অ্যাপ্লাই করে যেতে লাগলাম।
প্রথম ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম আমার সেমিস্টার ফাইনালের প্রথম পরীক্ষার দিনই—সকাল ১০টায় ইন্টারভিউ আর বেলা ২টায় ছিল পরীক্ষা! সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি! সঙ্গে ঝিরিঝিরি তুষারঝড় তো আছেই। দুপায়ে সব মাড়িয়ে মহাদেবের নাম নিয়ে চললাম ইন্টারভিউ দিতে! খুব মিষ্টি স্বভাবের কানাডীয় এক ভদ্রমহিলা সাক্ষাৎকার নিলেন—ক্যাথি। চাকরি হলো না, কিন্তু কথা বলার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ! এখনো মনে হয়, ওই প্রথম ইন্টারভিউতেই ওনার মিষ্টি সুরে কথা বলা আর অমায়িক ব্যবহার আমাকে পুরো আত্মবিশ্বাস দেখানোর সুযোগ দিয়েছিল, যা পরে সব সময়ই অব্যাহত ছিল। উনি আমাকে বুঝতেই দেননি যে সাক্ষাৎকার দিতে এসেছি। এমন লাগছিল, দিব্যি তাঁর সঙ্গে গপ্পো করে বেরিয়ে এলাম! ওটা ছিল মূল রাস্তা থেকে পাহাড়ের ওপরের দিকে একটা বিশাল বড় সুপারশপ—কেন্ট। মূলত, এদের কারবার নির্মাণসামগ্রী নিয়ে। চাকরি না হওয়ার পেছনে কারণ অনুমান করলে বলা যায়, ওটা ছিল আমার প্রথম ইন্টারভিউ। সে ক্ষেত্রে যাঁরা বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, তাঁদের বিবেচনায় রাখা হয়েছিল।
দ্বিতীয় সুযোগ এল পরের মে মাসের শেষে। আমার ইউনিভার্সিটির আর্ট গ্যালারির কর্মকর্তা হিসেবে—অ্যাডমিন অ্যাসিস্ট্যান্ট। কাভার লেটার আর রেজিউমে ঠিকঠাক করতে অকুণ্ঠ সহায়তা করল আমার এক সহপাঠিনী! ইন্টারভিউর ডাক পেলেও ওকে জানালাম না। ও অবশ্য টের পেয়ে গেলেও খুব একটা শোরগোল করল না। এখানকার খুব একটা চল হচ্ছে, যদি চাকরির জন্য ডাকে, তাহলে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। পাশাপাশি অন্য প্রার্থীদেরও অবশ্য বিবেচনায় নিতে হবে আর সেই সঙ্গে চাকরিদাতার ওই মুহূর্তের প্রার্থীর প্রয়োজনীয়তা।
চাকরির সাক্ষাৎকার আর্ট গ্যালারির ভেতরেই হলো। এর আগের দিন যতটুকু পারি পড়াশোনা করে নিয়েছি আর্ট গ্যালারি সম্পর্কে, আর পাশাপাশি তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় তো দিতে হবেই। কীভাবে? তা প্রশ্নের গতিপথই নির্ধারণ করে দেবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন দুজন—আর্ট গ্যালারির পরিচালক ক্যাথরিন, কিউরেটর গ্রেগ। যথারীতি পরিচয় পর্ব দিয়েই শুরু হলো।
তারপর আর্ট গ্যালারিতে কেন কাজ করতে চাই?
আগের যেকোনো অভিজ্ঞতার কথা। সর্বশেষ অভিজ্ঞতার আলোকে কেন এ রকম প্রদর্শনীর আয়োজন করা উচিত? এর প্রয়োজনীয়তা কী?
পরবর্তী প্রজন্মকে কীভাবে শিল্প প্রভাবিত করে?
আমাকে যদি কোনো প্রদর্শনীর আয়োজন করতে দেওয়া হয়, তাহলে কী কী উপায়ে এর প্রচার ও বিজ্ঞাপনের কাজ করব আর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এর খবর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কী কী করা যায়? এমন কিছু করা যায় কি না, যা এর আগে কখনো করা হয়নি। আরও টুকটাক প্রশ্ন ছিল!
কেন জানি ইন্টারভিউ দেওয়ায় আত্মবিশ্বাস খুব বেড়ে গেল। সবকিছুই ভীষণ ইতিবাচক ঠেকছিল! দুই দিন পর জবাব এল—যা ভাবছিলাম, তা–ই হলো। চাকরি হয়ে গেল! তা–ও আবার ইউনিভার্সিটিতে! যেটা যে কারও জন্য অনেক সম্মানের! সহপাঠিনী অনেক অনেক খুশি! পরের সপ্তাহে কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রথম দিন অফিস করেও ফেললাম।
পরের দিন আমার অফিশিয়াল কাজ ছিল যেটা অনলাইনে সাবমিট করাতে হতো। গ্রেগ ও আমি একসঙ্গেই করছিলাম। একটা জায়গায় আমরা দেখতে পেলাম প্রোফাইল সাবমিট করতে পারছি না। কারণও কিছুটা বিদঘুটে! ওরা যে ক্যাটাগরির কথা লিখেছে, তাতে তিনটি বিভাগ দেখতে পাচ্ছি—কানাডিয়ান নাগরিক, স্থায়ী বসবাসকারী আর শরণার্থী। আমি প্রবাসী ছাত্র হওয়ায় তালিকাভুক্ত নই। তাহলে সাবমিট কীভাবে করব? পরে যা হলো, তার জন্য মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না! আমার চাকরি দুই দিনের মাথায় চলে গেল। গ্রেগ ডেভিস-যিনি আমার সুপারভাইজার ছিলেন, উনি আমার হয়ে ইউনিভার্সিটির প্রায় প্রতিটা ডিপার্টমেন্টে কল করে কোনো খালি পদ আছে কি না, তা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
বিধি বাম, কোথাও কোনো নিয়োগের সুযোগ হলো না! ...ক্রমশ