কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত-তৃতীয় পর্ব

আমিও বেশ সন্তুষ্টি নিয়ে বাসায় ফেরত আসি। ভাবছিলাম, হয়তো হয়ে যাবে চাকরিটা। তবে কয়জন ওরা এবার নেবে জানি না। কাজেই অনিশ্চয়তার দোলাচলে রইলাম। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে এক সহপাঠীর মারফত খবর পেলাম, ওর ঘরের এক ছেলেই চাকরিটা পেয়েছে।

ব্যস! সাঙ্গ হলো ভবের খেলা। এ ক্ষেত্রে বলে রাখি, রেফারেন্স ছাড়া রেস্তোরাঁয় চাকরি পাওয়া বেশ মুশকিল! বলতে গেলে ‘উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো’! কথাটা বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি। কখন, কীভাবে, কে বলেছিল, সেটি আগামী পর্বগুলোর মধ্যেই খুঁজে পাবেন।

আপনার রেজুম কতটা অভিজ্ঞতার আলোকে সাজানো, আগে কী করেছেন, কত দিন বা কোথায়—কেউ একবারের জন্যও তাকিয়ে দেখবে না আর যদি দেখে, তাহলে হয় আপনি ভাগ্যদেবীর কৃপাধন্য, না হয় ওরা তখন কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

এর মধ্যেও আবেদন করে গেছি বিভিন্ন পদে। সবচেয়ে বেশিবার দরখাস্ত গেছে ওয়ালমার্টে। অবস্থা শেষমেশ এমন হয়েছিল যে ভাবছিলাম আর আবেদনই করব না! পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে এক সহপাঠিনীর সঙ্গে কথার এক পর্যায়ে ও বলল, এখন পর্যন্ত পাঁচবার অ্যাপ্লাই করেছে। বলতেই ওকে আমার ওয়ালমার্ট পোর্টালের ড্যাশবোর্ডটা দেখালাম।

ওটা দেখার পর ওর মুখের হা টা যত বড় হয়েছিল, তা দিয়ে নিমেষেই এক টুকরা আস্ত কেক গলে যাবে। মোট ২৭টি পদে আবেদন করেছিলাম। হয়তো আমার রেজুমে আবার কাটাকাটি করার সময় এসেছে। রাতে বসেছিলাম সেই কাজ নিয়ে, ই-মেইলে ঢুঁ মারতেই চোখে পড়ল বহু আকাঙ্ক্ষিত ওয়ালমার্টের সাক্ষাৎকারের মেইল! আগেরবার নিয়ে ২৫টি দরখাস্ত পাঠানোর পর অবশেষে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে দেখছি! এবার আরও দুটো পদে অ্যাপ্লাই করেছিলাম— ক্যাশিয়ার, কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স সেলস ফ্লোর। দ্বিতীয়টার জন্য কল পেয়েছি।

সবাই বলে সবুরে মেওয়া ফলে। তবে কতকালের সবুরে তা কেউ বলে না!! ১৩ তারিখ না কি অপয়া? দুর্ভাগ্য বয়ে আনে! আমার ক্ষেত্রে তো উল্টোটা হচ্ছে। ওই দিনই যেতে হবে নর্থ সিডনিতে ইন্টারভিউ দিতে। বাসা থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ, মনে রাখতে হবে এখানে যানজট নেই! যদি কোনো দুর্ঘটনা পথে ঘটে থাকে, সে ক্ষেত্রে হয়তো সামান্য যানজট চোখে পড়বে!

বাসা থেকে প্রথম বাসে উঠে পৌঁছালাম ডরচেস্টার মেইন বাস স্টপেজে। ওখান থেকে ৫ নম্বর বাস নিয়ে যাবে নর্থ সিডনিতে। বাসে উঠে দেখা জেফরির সঙ্গে, আমার সহপাঠী। ঠিক ওর পেছনের সিটেই বসেছি। ও কাজে যাচ্ছে সিডনি রিভার সোবিসের ফার্মেসিতে।

আরও পড়ুন

দেখতে দেখতে বাসে আর দাঁড়ানোর জায়গা নেই। তেমন একটা বড় বাস না হওয়ায় এ কাণ্ড ঘটল। বাসের বেহাল অবস্থা দেখে জেফরি বলতে লাগল, এর আগে এই কয়েক মাসে কখনো এমন হতে দেখেনি! বোঝাাই যাচ্ছে, আসলেই কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে সবাই! গুনে ফেললাম চটপট, বাসে আছে ২৩ জন। ওরা নেবে পাঁচজন। আরও কতজন আসবে, তা ওখানেই গিয়েই দেখতে পাব।

জেফরি সিডনি রিভারে নেমে গেল আমাকে ইন্টারভিউয়ের আগাম শুভকামনা জানিয়ে। এখনো মিনিট বিশেকের পথ। অবশেষে এসে পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে—ওয়ালমার্ট, নর্থ সিডনি। ঢুকেই যেটা মনে হলো, এটা সিডনি ওয়ালমার্টের আকারের অর্ধেক হবে। মিনিট পনের আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম, প্রবেশপথের আশপাশেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এক সাদা চুলের বয়স্ক ভদ্রমহিলা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাই, আই এম লিন্ডা! আর ইউ হেয়ার ফর ইন্টারভিউ?’ বললাম, ‘হ্যাঁ!’ আমার সময় কখন জানতে চেয়ে তিনি ফ্রন্ট ডেস্কের দিকে চলে গেলেন।

এরপর আরেকটা সোনালি কেশের কানাডিয়ান মেয়ে এসে আমাকে, ‘হাই, আই এম ভিকি। আমি তোমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ভেতরে নিয়ে যাব, চল।’ ওকে অনুসরণ করে সোজা চললাম। প্রথমে চারপাশে খুব একটা লক্ষ করার সময় পেলাম না। কিছুদূর গিয়েই বেশ বড়সড় দরজায় লেখা, ‘এমপ্লয়িজ অনলি’।

ভেতরে ঢুকে ডানে মোড় নিয়ে সোজা গিয়ে একেবারে শেষের রুমে ঢুকে দেখলাম, টেবিল সাজানো রয়েছে। পাশে তিনটা ডেস্কটপ কম্পিউটার রাখা আছে। সম্ভবত এখানকার কর্মকর্তাদের কাজকর্মের জন্য। ঠিক মাঝখানের টেবিলের ওপর পাশে চশমা পরা এক কানাডিয়ান ভদ্রলোক বসে রয়েছেন।

ঢুকতেই আমাকে বললেন, ‘ওয়েলকাম মাই ফেন্ড, হ্যাভ এ সিট!’ সাদা রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারটায় বসে পড়লাম। ওর কথা বলার ভঙ্গি এতটাই অমায়িক আর বন্ধুত্বপূর্ণ; মনেই হলো না ও এখানকার ম্যানেজার বা আমার সাক্ষাৎকারগ্রহীতা।
শুরু হলো জীবিকার তাগিদে হন্যে হয়ে ঘোরা আমার চতুর্থ ইন্টারভিউ—
‘মাই নেম ইজ কোরি। হাউ আর ইউ টুডে?’

আমি: আই এম গুড।
কোরি: হোয়াট পজিশন ইউ আর অ্যাপ্লাইয়িং ফর?
আমি: কাস্টমার এক্সপেরিয়েক্স সেলস ফ্লোর অ্যাসোসিয়েট।
পরিচয় জেনে নিয়ে মূল প্রশ্নের দিকে চলে গেল ও।
কোরি: আচ্ছা, এ জবের কাজ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? তোমাকে সবকিছু বলতে হবে না। একটু ধারণা দিতে পার?
আগের চাকরির সাক্ষাৎকার দেওয়ার সুবাদে এ প্রশ্নটা সহজেই অনুমান করেছিলাম। প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল। চার-পাঁচটা পয়েন্ট বলতেই থামিয়ে দিয়ে পরের প্রশ্নে চলে গেল কোরি।

তোমাকে এখন কিছু পরিস্থিতি বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন করব।
কোনো কাস্টমারকে কীভাবে সামাল দেবে, সে সম্পর্কে।
বেশকিছু প্রশ্ন করল ও। যেমন দুজন কাস্টমারের মধ্যে যিনি পেছনের কাস্টমার তিনি তোমাকে বললেন, তাঁর কোনো জরুরি কাজ আছে, তখন তুমি কাকে অগ্রাধিকার দেবে?

বললাম, সে ক্ষেত্রে প্রথম কাস্টমারের অনুমতি সাপেক্ষে পরের কাস্টমারকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে। তুমি একটা জায়গায় মালামাল গুছিয়ে রাখার কাজ করছ এবং আজকের দিনে তোমার নির্ধারিত কাজের সময় শেষ পর্যায়ে। ঠিক ওই সময়ই এক গ্রাহক তোমার কাছে এমন কিছু খুঁজে দেওয়ার কথা বল, তা অন্য ডিপার্টমেন্টে। কী করবে?

প্রশ্নটা বেশ বোকা বোকা লাগলেও বললাম, ক্রেতা যখনই আসবে তাকে যেকোনো সময় সাহায্য করতে হবে। যে নির্ধারিত জায়গায় জিনিসটা আছে, সেটা খুঁজে দেব, সেই সঙ্গে ওনাকে ঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে পরেবারের জন্য।

আমার জায়গায় যে কেউই হয়তো চাকরির ক্ষেত্রে একই উত্তর দেবে। তাই কয়েক লাইন বাড়িয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করলাম—

আমার ওই দিনের সময় শেষ পর্যায়ে হলেও গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েই তবেই কাজ শেষ করব।

ধরো, তুমি কাজ করতে গিয়ে একটা ভুল করেছ। পরিস্থিতি সামাল কীভাবে দেবে?
—যদি কোনো কাস্টমারের সঙ্গে ভুল হয়ে থাকে, তাহলে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা আর পরেরবার যেন আর একই ঘটনা না হয়, সেটা নিশ্চিত করব। আর কোনো সহকর্মীর সঙ্গে হলে বুঝিয়ে বলতে হবে, আশা করি পারস্পরিক সমঝোতা থাকলে কোনো সমস্যা হবে না।

তোমার কোনো কর্মীর সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে। কীভাবে মিটমাট করবে?
—সবাই একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার কারণে এমনটা হওয়ার কথা নয়। তবে যদি হয়, কথা বলতে হবে। মনে রাখতে হবে, একতাই বল, একতার কারণেই আমরা দারুণ সব কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম!

লক্ষ্য করলে যে একটা কাজের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি রয়েছে, যে সময়ের মধ্যে ওটা হওয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে। কাজের গতি বাড়াতে তুমি উপায় খুঁজে বের করলে। এমন কোনো কাজের একটা উদাহরণ দিতে পার।

—সে ক্ষেত্রে আমি ইউনিভার্সিটির এক দিনের কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। ওই দিন কাজ করেছিলাম আর করতে গিয়ে দেখলাম, যেভাবে বলা হয়েছে ওভাবে না করে কিছুটা নিজের মতো বুঝে করলে অনেক সহজেই আর কম সময়ের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। পোস্টার লাগানো আর একটা প্রদর্শনীর জন্য অগ্রিম কিছু ছবি আর কাঠের পুতুল পেছনের সংগ্রহশালা থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় আনার কাজ ছিল। এ প্রদর্শনী সম্পর্কে প্রশ্ন আমাকে ইউনিভার্সিটির সাক্ষাৎকারের দিন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। ওনারা দেখেছিলেন, আমি আর্ট গ্যালারির ব্যাপারে কতটা উৎসাহী। মনে রাখতে হবে, কোনো কাজ ছোট বা বড় হয় না!

হয়তো আপনি সে কাজের জন্য উপযুক্ত নন। কাজের অভিজ্ঞতা এক দিনের হোক বা বছরের হোক—কখন, কীভাবে আপনাকে মোক্ষম জায়গায় বিপদে পার পেয়ে যেতে সাহায্য করবে জানবেন না! যখনই শেখার কোনো সুযোগ পাবেন, হাতছাড়া করবেন না।

কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি ওই এক দিনের অভিজ্ঞতা এভাবে কাজে আসবে! পরবর্তী সময়ে যা তিক্ততার স্বাদ পেয়েছিলাম, তা বাদ দিলে আপাতত ওয়ালমার্টের ইন্টারভিউয়ের টেবিলে বসে বুঝতে পারছিলাম হয়তো কোনো সুখবর পেলেও পেতে পারি। (ক্রমশ)