কানাডার চাকরি বৃত্তান্ত: ২য় পর্ব

ছবি: সংগৃহীত

আমার অবস্থা তখন বেশ বেগতিক। প্রায় ছয় মাসের অপেক্ষার পর চাকরি পেলেও স্থায়িত্ব হলো দুই দিনের! নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও সবাই দোষ দেখল এক প্রবাসী ছাত্রের।

পরদিন সকালে ক্লাসের ব্রেকে চলে গেলাম আর্ট গ্যালারিতে ক্যাথরিনের সঙ্গে দেখা করতে। গ্রেগই বলেছিল ওর সঙ্গে দেখা করার কথা। এনারাই আর্ট গ্যালারির ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন! ক্যাথরিন আর্ট গ্যালারির পরিচালক। কিন্তু অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, এ পদে আবেদনের আগে ঠিকমতো কেন সবকিছু যাচাই করিনি? পাল্টা প্রশ্ন করার ইচ্ছে থাকলেও ওই সময় আর রুচি হয়নি।

অত কর্কশভাবে বলেননি যদিও, বক্তব্যের মূল সুরটা এমনই ছিল। যত দূর জানতাম ইউনিভার্সিটিতে প্রতিটি পদের জন্য একাধিক প্রার্থী থাকে। এরপর সবার কাভার লেটার আর রিজিউমের পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাইয়ের পর সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে ভুলটা কার হয়েছিল, তা আপনারাই বুঝে নিন।

কানাডিয়ান চাকরিতে আবেদন করার পদ্ধতি খুবই সহজ–সরল। মূলত দুইভাবে হতে পারে—অনলাইনে আর সরাসরি রিজিউমে নিয়ে জমা দেওয়া। দ্বিতীয়টা মূলত রেস্তোরাঁ বা ফাস্ট ফুড চেইন (কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং, সাবওয়ে ইত্যাদি) কফিশপগুলোতে (টিম হর্টনস, স্টার বাকস) আবেদন করতে চাইলে।

আর অনলাইনের ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানে আবেদন করবেন, তাদের অনলাইন পোর্টালে গিয়ে যে ডকুমেন্টস চাওয়া হচ্ছে, সে অনুযায়ী আপলোড করে দিন। তবে এর আগে ওদের চাকরিসংক্রান্ত বিবরণী খুব ভালোভাবে পড়ে সে অনুযায়ী রিজিউমে বা কাভার লেটার তৈরি করে নিতে হবে। প্রতিবার আবেদনের সময় অনেক সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ে পদের জন্য  প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রতিটি পজিশনের জন্য আলাদা কাভার লেটার আর প্রয়োজনে সিভিতেও পরিবর্তন আনা যেতে পারে।  সিভি একই রেখে দিলে ক্ষতি নেই।

বলা যায়, এটাও নিজেকে কষ্টিপাথরে ঘষে যাচাই করার মতোই পরীক্ষা! এখানে যুদ্ধ নিজের সঙ্গে নিজের—নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়াই মূল লক্ষ্য হতে হবে। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়তো সেরা আর আপনাকে বিশ্বাস রাখতে হবে আপনি সর্বসেরা!
নতুন দেশ, নতুন চাকরি—সবকিছু বুঝতেও সময় লেগেছিল। নিয়ম–কানুনের যে এত প্যাঁচ আছে, তা বুঝে ওঠার আগেই ঘটনা ঘটে গেল। মোদ্দাকথা, সরকারি চাকরি হাতছাড়া হয়ে গেল। ইউনিভার্সিটির জব এককথায় বিবিধ সুবিধাদি, বেতন—সবকিছু মিলিয়ে সরকারি চাকরির সমতুল্য।

এরপর থেকে প্রথমেই ভালোভাবে দেখতাম কারা এ পজিশনে আবেদন করতে পারবে। পরে বাকি গপ্পো! আমার সহপাঠীরাও বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সবাই সান্ত্বনা দিল, সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াল। বিশেষ করে গ্রেগ ডেভিস। বাসায় এসে আমার বেতনের টাকাসহ আরও উপরি টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। এ ঘটনা আমার সারা জীবনের স্মৃতি! শুধু তা-ই নয়। এর পরের চাকরির জন্যও তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। খুবই কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, যেদিন আমার চাকরি চলে যায়, ওই দিন বেলা আড়াইটা নাগাদ ইন্টারভিউ ফোন পাই বার্গার কিং থেকে। (প্রথম এবং একমাত্র কল এখন পর্যন্ত) পরদিন দুপুরের দিকে ডেকেছে। গ্রেগকে আগেই জানিয়েছিলাম কলের ব্যাপারে। যখন বাসায় এসেছিলেন, তখন নিজেই বলেছিলেন, পরদিন সকালে তিনি নিজে গিয়ে বার্গার কিং-এর ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করবেন। তবে তাঁর দেখা করার সঙ্গে চাকরি হওয়ার বা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই! তিনি দেখা করে আমাকে কল করে কনফার্ম করেছিলেন। সপ্তাহের ছুটিতেও নিজের কাজ ফেলে আমার পেছনে দৌড়ানো এমন মানুষের দেখা মেলা ভার।

ঘড়িতে আড়াইটা। আমি বসে আছি বার্গার কিংয়ের ভেতরে। সিরিয়াল অনুযায়ী আমার নম্বর ৪। মাঝের সারির বেঞ্চের তৃতীয়টিতে বসে ইন্টারভিউ নিচ্ছেন ম্যানেজার—চীনা ভদ্রলোক। যদিও পরে জেনেছিলাম সে ফিলিপাইনের—লেনিস নাবং।  সিভিতে অনেক মনোযোগ দিয়ে খুঁটিনাটি দেখছেন আর প্রশ্ন করছেন। আমি বসেছি কোনাকুনিভাবে বাঁ দিকের সারিতে আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কীভাবে ইন্টারভিউ হচ্ছে। আগের মেয়েটি যেমন সুন্দরী, ভাবভঙ্গি তেমন সাবলীল। মনে হলো ওর চাকরি শতভাগ নিশ্চিত।

এরপরই আমার পালা। মেয়েটার ইন্টারভিউ দুর্দান্ত হলো। ম্যানেজার মহা খুশি!
এর মধ্যে খুব আশ্চর্যজনক একটা ঘটনা চোখে পড়ল। এক মধ্যবয়সী কানাডীয় লোক, সেও আমাদের মতোই চাকরিপ্রত্যাশী কিন্তু হাবভাব একেবারেই বেখাপ্পা ঠেকল। যখন থেকে বার্গারের ভেতরে ঢুকে ডাইনিং বেঞ্চে বসেছি, তখন থেকেই দেখছি সে আমার আগের সাক্ষাৎকারপ্রার্থী মেয়ের সঙ্গে সমানে বকবক করে চলেছে। চাকরিসংক্রান্ত কোনো কথাই হচ্ছিল না! ঢিলেঢালা নীল রঙের একটা প্যান্ট আর গায়ে হুডি দেওয়া বাদামি বর্ণের একটা জ্যাকেট পরেছে। পায়ে সাদা রঙের পুরোনো জুতা যেটার অনেক জায়গায় সেলাই দেওয়া। বেশভূষা দেখে কস্মিনকালেও আপনার হবে না সে চাকরির খোঁজে এসেছে। ম্যানেজার এক এক করে প্রার্থীর নাম হাঁকছেন, দেখলাম একজনের নাম ডাকার পর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ওই ভবঘুরে ভদ্রলোক সোজা ম্যানেজারের সামনে গিয়ে হাজির নিজের সিভি নিয়ে আর শুনলে আরও হতবাক হবেন যে নাম ডাকা হয়েছিল ওটা ভারতীয় নাম! সে নানা অঙ্গভঙ্গি করে ওটা জমা দিতে চাইল আর যথারীতি পরিচালক বেশ তাচ্ছিল্যভাবে ওকে নাকচ করে তাড়িয়ে দিলেন! সবকিছু মিলিয়ে বিব্রতকর একটা পরিস্থিতি।

যা-ই হোক। এর পরে ওই মেয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসল। এখন আমার পালা! এর আগে একবারই রেস্তোরাঁয় ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম—ম্যাকডোনাল্ডসে। খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা ছিল না। অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল, যেটার অর্থ আজও আমার জানা নেই, ‘তুমি কাজ করছ, হঠাৎ দেখতে পেলে এক বৃদ্ধা শীতে কাঁপছেন, তখন তুমি এ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে?’ এ ক্ষেত্রে প্রথম যে ব্যাপারটা মাথায় এল, তা হলো শীতে তো হিটার থাকে,  কাজেই ভেতরে খেতে বসে শীতকাতুরে হওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন??
ফিরে আসি বার্গারে—নামধাম জিজ্ঞেস করা হয়ে গেল। এখন মূল প্রশ্নের জটে জড়ানোর পালা—

ম্যানেজার: প্রথমে আমার কাজের সফলতার গল্প শোনার পর জানতে চাইল, তোমার দুর্বল দিক কোনগুলো বলে মনে করো?
বললাম: আমি অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করি, যাতে কাজে কোনো ভুল না থাকে, আর এটা নিশ্চিত হতে গিয়ে সময়ের প্রতি খেয়াল রাখা হয় না।

ম্যানেজার: এটা তো ভালো দিক। আমি জানতে চেয়েছি কি তুমি পারো না!
আমার কাজের এই একটা দিক আছে যেখানে আমি অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে আছি বলে মনে করি। কারণ, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে অবশ্যই সমস্যা পড়তে হবে।
ম্যানেজার: আচ্ছা! যদি তা–ই হয়, তাহলে কীভাবে তুমি এ সমস্যা কাটিয়ে উঠবে বলে মনে করো?

যে সময় যা করতে হয়, তা তখনই করতে হবে। এটা খেয়াল রাখতে হবে কাজও নির্ভুল হতে হবে আর সে সঙ্গে সময়ের দিকেও লক্ষ্য রাখব।

ম্যানেজার: এখানে তোমাকে খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে রান্নাঘরের ভেতরকার কাজ, সব ধরনের খাবার বানানোর নিয়ম এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও করতে হবে। তোমার সিভি দেখে যা বুঝলাম, এমন কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। সে ক্ষেত্রে এসব কাজে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে?

আমি মনে করি, যেকোনো কর্মীর জন্য কাজ শেখার আগ্রহটাই মূল কথা। একবার কাজ শিখে গেলে তখন কাজকে আর কাজ বলে মনে হবে না, অসুবিধা তো দূরের কথা। এরপর ওখানকার খাবারের মেন্যু নিয়ে প্রশ্ন করলেন ওই ভদ্রলোক। নিজের পছন্দ (হুপার জুনিয়র উইথ চিজ) কোনটা বলে আমাকেও জিজ্ঞেস করলেন। চট করেই বলে ফেললাম, ক্রিসপি চিকেন স্যান্ডউইচ। বেশ বুঝতে পারলাম এসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আমি ওদের সম্পর্কে কতটা জেনে এসেছি, সেটা যাচাই করা।
কী বানাতে পছন্দ করি, ওয়েস্টার্ন বা ট্র্যাডিশনাল এশিয়ান?

কী কী উপকরণ থাকে ওতে? সব কথাবার্তা বেশ হাসি-গল্পের মধ্য দিয়েই হয়েছিল। কোন কোন খাবার তৈরি করতে কত সময় লেগেছে, রান্নাঘরের কাটাকুটি—সব কথা আর গল্পের মাঝে আমি কিছু তৈরি করতে পারি কি না, সেটা জানার চেষ্টা করছিলেন।
বেশ পছন্দ হলো আমার কথাবার্তা, সিভিতে ঝটপট লিখে ফেললেন ‘ভেরি গুড!!’ ক্রমশ....