সবুজ ঘাসের মাঝে হলুদ প্রজাপতি
১৯৯৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সময় আমাদের গ্রামের ক্লাবে সাদাকালো টেলিভিশন কেনা হলো। বাবার হাত ধরে রাত জেগে বিশ্বকাপের খেলা দেখতে যাই। তখন আসলে ম্যারাডোনা নামক এক অদ্ভুত মাদকতায় ডুবে আছে পুরো ফুটবল বিশ্ব। আমারও ম্যরাডোনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। মনে আছে, ডোপিংয়ের দায়ে যখন ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হলো, অন্য সবার মতো আমিও অনেক দুঃখ পেয়েছিলাম। যাই হোক, ম্যারাডোনাকে ছাড়া আর্জেন্টিনা বেশিদূর এগোতে পারল না।
এরপর অন্য দলের খেলা দেখতে দেখতে হলুদ জার্সির ব্রাজিলের খেলা কেমন যেন মনে দাগ কেটে গেল। বেবেতো–রোমারিও জুটির হাত ধরে ২৪ বছর পর ব্রাজিল বিশ্বকাপ জয়ের খরা কাটাল। সেই থেকে হলুদ জার্সির সঙ্গে গড়ে উঠল অলিখিত মিতালি, এক ফুটবল আবেগীয় বন্ধন; বলা যায় ফুটবল আত্মার খোরাক।
এরপর তো সেই কাফু, কার্লোস, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো, আদ্রিয়ানো, কাকা, নেইমারদের হাত ধরে হালের ভিনি, রদ্রিগো, এস্তেভাও। সেই ব্রাজিলের খেলা ভালো লাগার পর থেকে দলের উত্থান–পতন এসেছে, কিন্তু ভালো লাগার, ভালোবাসার জায়গাটুকু রয়ে গেছে অবিরাম।
ব্রাজিলের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে একটা স্বপ্ন ছিল—গ্যালারিতে বসে বসে হলুদ সাম্রাজ্যের ফুটবল কানাগলিতে একদিন মিশে যাব, দলের হয়ে গলা ফাটাব, সাম্বার তালে ৯০ মিনিট হারিয়ে যাব। অবশেষে কীভাবে যেন ১৫ নভেম্বর সেই স্বপ্ন পূরণের মাহেন্দ্রক্ষণ এসে হাজির হলো। ব্রাজিলের ম্যাচের শিডিউল দেখে টিকিট কাটার কথা ভাবতে থাকি এবং ৫৬ পাউন্ডে একটি টিকিট পেয়ে যাই।
আর্সেনালের এমিরেটস স্টেডিয়ামে ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে গিয়ে হাজির হই। দলে দলে ব্রাজিলের সমর্থকেরা হলুদ জার্সি, হলুদ মাফলার আর ব্রাজিলের জাতীয় পতাকা নিয়ে গান গাইতে গাইতে স্টেডিয়ামের সামনে হাজির হচ্ছে, ড্রামের তালে নাচ–গান করছে, ছবি তুলছে, ভুভুজেলা বাজাচ্ছে, সবার মুখে হাসির আভা। এর মাঝে টিম বাস আসতেই একটা হুড়োহুড়ি লেগে গেল; জটলা দেখে আমিও দৌড়ে গেলাম। সমর্থকেরা ব্রাজিল দলকে হর্ষধ্বনির মাঝে স্বাগত জানাচ্ছে, খেলোয়াড়দের নাম ধরে চিৎকার করছে। টিম বাস চলে গেলে নিরাপত্তাতল্লাশি শেষে এমিরেটসের ভেতরে গিয়ে হাজির হলাম।
এমিরেটসের ভেতরটা দেখলে মনে হয় লাল সমুদ্রের মধ্যে একটা সবুজ জাহাজ গালিচা বিছিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে একটু পর সাম্বার নৃত্য পরিবেশিত হবে। গা গরম করার জন্য ব্রাজিলের ফুটবলাররা মাঠে প্রবেশ করতেই তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে সমর্থকেরা স্বাগত জানাল। তবে সবচেয়ে বেশি করতালি পেলেন ভিনি ও এস্তেভাও। খেলা শুরুর আগে জাতীয় সংগীতের সময় বোঝা গেল জাতীয় দলের খেলার মাহাত্ম্য। পুরো গ্যালারি দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে, জাতীয় পতাকা নাড়ছে, আর জাতীয় সংগীত শেষে যে তুমুল উল্লাসধ্বনির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখতে পাওয়া গেল, সেটি আসলে জাতীয় দলের খেলার আবেগকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
গ্যালারিতে ব্রাজিল সমর্থকদের একচেটিয়া আধিপত্য। খেলার শুরুতে ব্রাজিল আক্রমণ করতেই গ্যালারিজুড়ে শুরু হলে কোরাস গাওয়া। প্রায় ৫৭ হাজার সমর্থক একসঙ্গে পর্তুগিজ ভাষায় গাইছে—Pra frente, Brasil, Do meu coraço! Todos juntos, vamos pra frente Brasil!
Salve a seleção!
আমি কিছু না বুঝে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের তালে তাল মেলালাম। আমার সামনের সারিতে একদল তরুণ–তরুণী অবিরত গানের তালে তালে নেচে চলেছে। তারুণ্যের সেই উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছিল, এটাই তো ফুটবল—যে সব বয়সী মানুষকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে পারে। এরপর গ্যালারিজুড়ে ‘ব্রাজিল ব্রাজিল’ বলে করতালির কোরাস উঠল। সবাই ছন্দে ছন্দে হাততালি দিয়ে ব্রাজিল ব্রাজিল বলে গলা ফাটাচ্ছে। সত্যি, সে এক অন্য রকম মোহনীয় পরিবেশের ঐকতান সৃষ্টি হলো। অথচ কিছুদিন আগেও এই ব্রাজিল দলকে নিয়ে কত সমালোচনা ছিল।
২০২২ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে ব্রাজিল ফুটবল দল বলতে গেলে একেবারে খাদের কিনারে চলে যায়। বারবার কোচ বদলাতে থাকে, কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। সাম্বার ব্রাজিল যেন এক ছন্নছাড়া, অগোছালো দলে পরিণত হয়। সমর্থকদের মন ভেঙে যেতে থাকে। একসময় এমন অবস্থা হয় যে ব্রাজিল একেবারে বাছাইপর্বের তলানিতে চলে যায় এবং প্লে–অফ খেলে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে কি না, সেটা নিয়েও কথাবার্তা শুরু হয়ে যায়। অবশেষে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নিলেন কার্লো আনচেলত্তি। এই ডন কার্লোর হাত ধরে ব্রাজিল একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
সেনেগালের সঙ্গে ব্রাজিলের খেলার প্রথমার্ধে সেই ছাপ পাওয়া গেল। এ যেন সেই পুরাতন ব্রাজিল, বল পেলেই যারা প্রতিপক্ষের দ্বারে আক্রমণের ঢেউ তোলে। ব্রাজিল শুরুতে ৪–২–২–২ ফরমেশনে খেলা শুরু করে। আক্রমণভাগের মূল দায়িত্বে ছিলেন ভিনি, রদ্রিগো, এস্তেভাও ও কুনহা। ভিনি ও রদ্রিগো মাঝেমধ্যেই অবস্থান পরিবর্তন করছিলেন এবং মাঝেমধ্যে ব্রাজিল ফরমেশন পরিবর্তন করে ৪–৪–২–এ খেলছিলেন। ফুটবলের এই ফরমেশন আমি খুব একটা বুঝতাম না, তবে ইংল্যান্ডে এসে মাঠে বসে কয়েকটি ক্লাব ম্যাচ দেখার পর এখন ফরমেশনটা মোটামুটি বুঝতে শিখেছি।
যাই হোক, ব্রাজিল প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করল। বল পেলেই প্রতিপক্ষের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এস্তেভাওয়ের কাছে থেকে পাওয়া বলে ভিনি গোলে কিক করলেন, কিন্তু গোলকিপারকে পরাস্ত করতে পারলেন না। গ্যালারিজুড়ে একসঙ্গে হতাশার সুর অনুরণিত হলো। তিন মিনিটের দিকে ব্রাজিলের অর্ধ থেকে ভিনি চমৎকার একটি রান মেইক করে রদ্রিগোর সঙ্গে ওয়ান–টু–ওয়ান খেলে ডি-বক্সের ভেতর থেকে একটা পাস দিলেন। কুনহা শট নিলেন, কিন্তু ক্রসবারে লেগে বল বাইরে চলে গেল। আবারও সে আশাভঙ্গের বেদনা। ব্রাজিলের আক্রমণের সময় বসে খেলা দেখা দায়। খেলোয়াড়দের সঙ্গে সমর্থকেরাও সমান তালে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। ব্রাজিল যখন দ্রুতগতির কাউন্টার অ্যাটাকে যাচ্ছিল, তখন সত্যি একেবারে স্টেডিয়ামের ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একদল হলুদ প্রজাপতি সবুজ মাঠের গালিচায় দ্রুতগতির ছন্দে অবিরত নেচে চলেছে। মাঝমাঠ থেকে একটা বল পেয়ে ভিনি যেভাবে দুজন ডিফেন্ডারের মাঝ থেকে রদ্রিগোকে একটা বাঁকানো পাস দিলেন, সেটি দেখে শুধু একটাই কথা মনে হলো—সবুজ মাঠের ক্যানভাসে এ রকম রংতুলির আঁচড় দেখতেই মানুষ এত কষ্ট করে মাঠে খেলা দেখতে আসে।
ব্রাজিল-অন্তঃপ্রাণ সমর্থক হিসেবে মাঠে বসে প্রিয় দলের খেলা দেখার অনির্বচনীয় অনুভূতির সাক্ষী হলাম। স্বপ্ন পূরণের কথা ভাবতে ভাবতে পাশের চেয়ারে বসা বাবা-ছেলের ফুটবল আলাপ খেয়াল করছিলাম। বছর আটেক বয়সী ছেলে বাবার সঙ্গে জীবনে প্রথম তার প্রিয় দলের খেলা দেখতে এসেছে। হাজারটা প্রশ্নের ডালি নিয়ে তার বাবার কাছে কাবুলিওয়ালার মিনির মতো অবিরাম বকে চলেছে।
২৭ মিনিটের মাথায় সেনেগালের ডি-বক্সের মধ্যে জটলার মধ্যে থেকে ফাঁকায় বল পেয়ে এস্তেভাও ত্বরিতগতিতে বানানা শট নিলেন। বল গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে জালে প্রবেশ করল। পুরো গ্যালারি তখন যেন হলুদের আবাহন। দর্শকের চিৎকারে কান পাতা দায়। সবাই এস্তেভাওয়ের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। এস্তেভাও ছেলেটির মধ্যে অন্য রকম সম্ভাবনা আছে। এত অল্প বয়সে তার চেলসি ও ব্রাজিল দলে তার যে পারফরম্যান্স, সেটি সত্যি অবাক করার মতো। সব ঠিক থাকলে ব্রাজিলের এই ওয়ান্ডার কিড আগামীতে ব্রাজিলকে নেতৃত্ব দেবে। এস্তেভাওয়ের প্রতি সমর্থকদের উজাড় করা ভালোবাসা দেখে মনে মনে তাকে আগামী দিনের শুভেচ্ছা জানালাম। এরপর ৩৫ মিনিটের মাথায় রদ্রিগোর সেটপিস থেকে ক্যাসিমিরোর নিখুঁত ফিনিশিংয়ে ব্রাজিল ২–০ গোলে এগিয়ে গেল। পুরো গ্যালারিতে হলুদ সমর্থকদের নৃত্য চলছে। গুটিকয়েক সেনেগাল সমর্থক মন খারাপ করে বসে আছে।
দ্বিতীয় গোলের পর গ্যালারিজুড়ে শুরু হলো মেক্সিকান ওয়েভ। একদিক থেকে ওয়েভ ওঠে, পুরো গ্যালারি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়। এই ঢেউ যেন থামতেই চায় না। এক গ্যালারি পেরিয়ে আরেক গ্যালারির সমর্থকেরা অপেক্ষায় থাকে—কখন তারা এই ঢেউয়ের তালে তাল মেলাবে। এই অপার্থিব পরিবেশ দেখে ভাবছিলাম, এটাই তো খেলার মাঠে সমর্থকদের সৌন্দর্য—যারা খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যের সঙ্গে সাড়া দিয়ে খেলার মাঠের পরিবেশটাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যান। প্রথমার্ধে ব্রাজিল দুই গোলের লিড নিয়ে খেলা শেষ করল। ডন কার্লোর দলের প্রথম অর্ধে একটা ঝাঁঝালো পারফরম্যান্স দেখা গেল। আমি মাঠে প্রবেশের পর থেকে মনে মনে বলছিলাম—এই প্রথম ব্রাজিলের খেলা দেখতে এসেছই, অন্তত দুই–একটি গোল যেন দেখতে পাই। ফুটবল বিধাতা বোধ হয় আমার কথা শুনে মুচকি হাসছিলেন।
দ্বিতীয়ার্ধে সেনেগাল দাপট দেখাতে শুরু করল। সেনেগাল যখন ব্রাজিলের অর্ধে বল নিয়ে ঢুকে পড়ছে, তখন স্বল্পসংখ্যক সেনেগাল সমর্থকের আওয়াজের কাছে বৃহৎ অংশের ব্রাজিল সমর্থকদের আওয়াজকে খুব ম্রিয়মাণ লাগছিল। মাঝেমধ্যে অল্প মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের আবেগের বহিঃপ্রকাশ অনেক বড় শক্তিকেও হার মানিয়ে দিতে থাকে। এই খেলায় আমার চোখ সব সময় ব্রাজিলের আক্রমণভাগের দিকেই ছিল। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ডানদিক থেকে বল পেয়ে এস্তেভাও একটা রান মেইক করে বাঁ দিকে কাট করে ঢুকে পড়ে দুই–তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে যেভাবে ভিনিকে একটা পাস দিলেন, সেটি দেখে মনে হলো—এটাই তো সাম্বার ঝলক।
দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আক্রমণ–প্রতিআক্রমণের মধ্য দিয়ে চোখের পলকে ৯০ মিনিট শেষ হয়ে গেল। ব্রাজিল ২–০ গোলের একটা স্বস্তির জয় পেল। একজন ব্রাজিল-অন্তঃপ্রাণ সমর্থক হিসেবে মাঠে বসে প্রিয় দলের খেলা দেখার এক অনির্বচনীয় অনুভূতির সাক্ষী হলাম। আমার এই স্বপ্ন পূরণের কথা ভাবতে ভাবতে আমার পাশের চেয়ারে বসা বাবা–ছেলের ফুটবল আলাপ খেয়াল করছিলাম। বছর আটেক বয়সী একটা ছেলে তার বাবার হাত ধরে জীবনে প্রথম তার প্রিয় দলের খেলা দেখতে এসেছে। হাজারটা প্রশ্নের ডালি নিয়ে তার বাবার কাছে কাবুলিওয়ালার মিনির মতো অবিরাম বকে চলেছে। বাবা হাসিমুখে ছেলের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, দুজনের মুখেই লেগে আছে হাসির ঝলক। বাবা–ছেলের এই রসায়ন দেখতে দেখতে শুধু একটা কথাই মনে আসছিল—এই যে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মাঝে পরম্পরা আর ঐতিহ্যের হাতবদলের এক অমোঘ বন্ধন, সেই বন্ধনের অটুটতায় ব্রাজিলের সাম্বা হারাবে না। দলের উত্থান–পতন আসবে, কিন্তু ঠিকই পরের প্রজন্ম পরম মমতায় তার গৌরবময় ইতিহাসকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নতুন আশার বীজ বপন হবে, সেই আশার পালে হাওয়া লাগবে, পালতোলা নৌকার মতো ঠিকই আবার একদিন বন্দরে এসে সাফল্য লুটিয়ে পড়বে।
*লেখক: সুব্রত মল্লিক, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য।