ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে এক টুকরা বাংলাদেশ
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উপলক্ষে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এক মনোজ্ঞ আয়োজনে ভাষাশহীদ, নিজের মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে স্মরণ করেন। এ আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক অন্য রকম আবেগ ও ভালোবাসা।
ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ‘দ্য ক্লাব একাডেমি’ প্রাঙ্গণে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে মূলত বাংলাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
আগের রাতে শিক্ষার্থীরা রাত জেগে প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরি করেন। অনেক রাত পর্যন্ত সবাই মিলে টুকরা টুকরা জিনিসপত্র জোগাড় করে শহীদ মিনার প্রস্তুত করেন। পরের দিন সন্ধ্যা ৭টার পর মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনেক ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে অনুষ্ঠানে হাজির হন। শহীদ মিনারের সামনে কিছুটা আলোকসজ্জা করা হয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ঢাকার শহীদ মিনার যেন ম্যানচেস্টারে এসে হাজির হয়েছে।
আসলে মানুষ দেশান্তরী হলে তার হৃদয়ের গহিনে যেন দেশের সুর-তাল-লয় আরও বেশি করে বাধা পড়ে যায়। যে ছেলেমেয়েগুলো এ আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিল, রাত জেগে শহীদ মিনার তৈরি করেছে, তাঁদের চোখেমুখের উচ্ছ্বাস বলে দিচ্ছিল, তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের সত্ত্বা কত গভীরভাবে মিশে আছে। আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম ছিল আহনাফ রহমান, নাজিফাহ হায়দার, তাশফিক রহমান, তাসনুভা মাসুদ, আদরিকা রহমান, হুমাইরাহ আহমেদ।
তাঁদের মধ্যে একটা ছেলে আমাকে বলছিলেন, জানেন ভাইয়া বাংলা অক্ষর শহীদ মিনারের সঙ্গে আটকানোর সময় আঠা ফুরিয়ে গিয়েছিল। অত রাতে আঠা কোথায় পাই? পরে মধু দিয়ে সেই অক্ষর শহীদ মিনারের সঙ্গে আটকে দিয়েছি। ছেলেটির কথা শুনে শরীরে কেমন যেন শিহরণ খেলে গেল। এই বিদেশবিভূঁইয়ে এসে কাজের খাতিরে সারাদিন ইংরেজিতে কথা বলা লাগে, মনের আরাম পাওয়া যায় না। যখন নিজের মাতৃভাষা বাংলায় কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই, তখন মনে হয় আহা কী প্রশান্তি। আসলেই নিজের মাতৃভাষায় মধু আছে। আর বাংলা ভাষা এত মিষ্টি, সেটি তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভাষাশহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি বাজানো হয়। গান শেষে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারি দেখানোর পর আনিলা নেহরীন বিনয়ী গিটার হাতে নিয়ে বাংলা গান নিয়ে হাজির হল। প্রথমে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা গানটি মেয়েটি সুললিত কণ্ঠে গেয়ে চলেছে।
পিনপতন নীরবতা। ওখানে উপস্থিত সবাই তন্ময় হয়ে গান শুনছে। আসলে শুনছে বললে ভুল হবে, সবাই মানসচোখে সেই শ্যামল বাংলা মায়ের রূপ দেখছে। সে এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ। বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে থেকে যেন বাংলাদেশকে খুব বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। এটাই হলো মায়ার টান, আত্মার বন্ধন। ভালো থাকুক আমাদের মায়ের ভাষা, ভালো থাকুক আমাদের মাতৃভূমি, ভালো থাকুক আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ।
লেখক: সুব্রত মল্লিক, পিএইচডি শিক্ষার্থী (১ম বর্ষ), ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, ইউকে এবং সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস