রোমান কলোসিয়ামে ইতিহাসের কানাগলিতে
রাত ১০টার দিকে রোম বিমানবন্দর থেকে মোটামুটি ১২ কিলোমিটার দূরে গ্রামের মধ্যে এয়ারবিএনবিতে নেওয়া বাসার সামনে হাজির হয়েছি। বাসার মালিক আগে থেকেই মেইলে বাসার লক কোড দিয়ে রেখেছেন। প্রথম গেটের কোড খুব সহজেই খুলে ভেতরে ড্রয়িংরুমে পৌঁছে গেছি। এবার আমাদের কক্ষের নম্বর দেখে কোড ডায়াল করি, কক্ষের লক খোলে না। এ এক মহা যন্ত্রণা। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে স্নান করে বিছানায় গা এলিয়ে দেব; কিন্তু সেই অবকাশ আসছে না। ভাবছি, রাতে বোধ হয় ড্রয়িংরুমেই কাটাতে হবে। সেই মুহূর্তে আমাদের কথা শুনে পাশের কক্ষে থাকা এক দম্পতি বেরিয়ে এলেন, উনারা চেষ্টা করলেন; কিন্তু কক্ষ কোনোমতেই খোলে না। অবশেষে উনারা বাড়ির মালিককে কল দিলেন, উনি এসে আমাদের দোতলায় নিয়ে গেলেন এবং আমাদের কক্ষে রেখে এলেন। আসলে উনারই ভুল হয়েছিল। উনি ভুল করে আরেক কক্ষের কোড নম্বর দিয়েছিলেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের দুই সহকর্মী (সানোয়ার নাফিস) বাড়িওয়ালার দেওয়া কুপন অনুসারে একটা গ্রামের রেস্টুরেন্টের দিকে হেঁটে চলেছি। এই প্রথম ইতালির গ্রামের পরবিশে দেখার সুযোগ হলো। ইতালির গ্রাম দেখে আমাদের দেশের গ্রামের উন্নত ভার্সন মনে হলো। জমিতে যথেষ্ট ফসল আছে, চমৎকার পাকা রাস্তা, রাস্তার দুই পাশে ফাঁকা ফাঁকা বাড়ি। তবে বাড়িগুলো দেখতে খুবই চমৎকার, বাড়ির চারপাশে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা, ঘাসগুলো চমৎকার করে কাটা, সঙ্গে নানা রকম বাহারি ফুলের সমাহার। এ রকম পরিবেশে থাকতে পারলে মানুষের মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে প্রথমে ভাষার বিড়ম্বনায় পড়লাম। আমরা ইংরেজি ভাষায় কাজ চালিয়ে নিতে পারি, কিন্তু রেস্টুরেন্টের কেউ ইংরেজি বলতে পারে না। অবশেষে গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিতে হলো। তথ্যপ্রযুক্তি আসলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। রেস্টুরেন্টটি একেবারে গ্রামীণ পরিবেশের ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছে এবং রেস্টুরেন্টে কয়েকজন তরুণ-তরুণী কাজ করছেন। তবে যাঁরা খেতে এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ এবং এর মধ্যে আবার নারীদের আধিক্য। উনারা টেবিলে বসে খাবার সামনে নিয়ে অল্প অল্প করে খাচ্ছেন আর প্রাণ খুলে আড্ডা দিচ্ছেন। এই গ্রামে থাকা বয়স্ক মানুষগুলো তাঁদের জীবনের শেষ প্রহর অতি আনন্দের সঙ্গে কাটাচ্ছেন দেখে খুব শিহরিত হলাম। জীবনের গোধূলিবেলায় এসেও চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন, এটাও মনে হয় এঁদের অনেক দিন বেঁচে থাকার একটা রেসিপি। রেস্টুরেন্টে নানান পদের খাবারের মধ্যে কেকের আধিক্য দেখলাম। আমার দুজনে চার পদের খাবার নিয়ে ভাগ করে খেলাম, যেটা আসলে আমাদের অল্প টাকায় কয়েক পদের খাবারের স্বাদ নিতে সহয়তা করল।
নাশতা শেষে উবারে চড়ে আমরা রোম শহরের দিকে এগিয়ে চলেছি। রাস্তার দুই পাশে নানান রকমের বাহারি ফুল এমনভাবে ফুটে আছে, যা দেখে মনে হচ্ছে, ওরা নিজেদের মধ্যে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা করছে। গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে রোম শহরে ঢুকতেই দুই পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা হাজার বছরের পুরোনো ভবনের ভগ্নাংশ দেখে প্রথম যে প্রবাদবাক্যটি মনে এল সেটি হলো ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন আ ডে’। আমাদের প্রথম গন্তব্য রোমান কলোসিয়াম। ইতালির রাজপথে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে আর আমরা বিস্ময়াভূত চোখে রাস্তার দুই পাশে থাকা পুরোনো ভবনগুলো দেখছি, ইটগুলো ক্ষয়ে গেছে, ভবনের ওপরের অংশ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, দীনহীন চেহারা, তবে তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে এক আলাদা আভিজাত্য।
আমাদের গাড়ি রোমান কলোসিয়ামের সামনে এসে হাজির হলো। এক বিস্ময়ভরা মুগ্ধতা নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে, যার সঙ্গে মিশে আছে ক্রুদ্ধতা, রক্তপাত আর রোমান সম্রাটদের অহংবোধের মিশেল। গাড়ি থেকে নেমে আমরা পশ্চিম পাশ থেকে রোমান কলোসিয়ামের বিশালত্ব অনুধাবন করার পর ভেতরে গিয়ে কলোসিয়ামের ইতিহাসের কানাগলিতে হারিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে আমার সহকর্মী টিকিট কাটার জন্য লাইনে দাঁড়ালেন। আমার আগে থেকেই অনলাইনে টিকিট বুক করা ছিল। আমি সেই ফাঁকে কলোসিয়ামের আশপাশে অবস্থিত বিভিন্ন পুরোনো ভবন, চার্চসহ স্থাপনাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেতে থাকলাম। একেকটা গলি দিয়ে হাঁটি আর মনে হতে থাকে যেন হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকি। বিভিন্ন অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে সবচেয়ে যে বিষয়টি চোখে পড়ল সেটি হলো, এরা সংস্কারের নামে একটি স্থাপনারও অবয়ব নষ্ট করেনি। পুরোনো ইটগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে জীর্ণ রূপ ধারণ করেছে, তবে তার মধ্যেও ঠিকই যেন এক সদা বহমান পরম্পরার ধারা নিজস্বতার আলোয় দেদীপ্যমান হয়ে চারপাশ আলোকিত করে রেখেছে।
রোমান কলোসিয়ামের আশপাশের অলিগলি ঘুরে আমি পূর্ব দিকে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে আছে এবং বিস্ময়কর হলো, সেখানে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশির সরব উপস্থতিতি। তবে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যেতে চায়। ওখানে উপস্থিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম, কেউ জলের পট বিক্রি করছেন, কেউ সেলফি স্টিক বিক্রি করছেন, কেউ ছোট ছোট খেলনা বিক্রি করছেন। প্রায় সবাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিবিয়া হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি এসেছেন, আবার কেউ রোমানিয়াতে কৃষি ভিসায় এসে সেখান থেকে দালাল ধরে ইতালিতে ঢুকেছেন। ইতালিতে নাকি অবৈধভাবে প্রবেশ করলে পুলিশ ধরে একটা হোমে নিয়ে রাখে, এরপর কিছুদিন গেলে কাজের অনুমতি দেয়। কাজ করে আবার হোমে ফিরে যায়, এভাবে চলতে চলতে ১০ বছর পেরিয়ে গেলে নাকি আচরণ ভালো হলে, সবকিছু ঠিক থাকলে ইতালির নাগরিক হওয়ার আবেদন করতে পারেন।
কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের কেমন চলছে এখানে? কেউ বলেন ভালো চলছে, এখান থেকে আয় করে দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠান, আবার কেউ বলেন অবৈধভাবে থাকার ফলে পুলিশের চোখ এড়িয়ে কাজ করতে হয়, সব সময় আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে। একটা যুবক ছেলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাঁর চোখেমুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। পরিচয় দেওয়ার পর বলছিলেন, ‘স্যার, দেশে যদি ১০ হাজার টাকার একটা চাকরিও জোগাড় করতে পারতাম, তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পেরিয়ে এই অনিশ্চিত জীবনের দিকে ছুটতাম না।’ ছেলেটির কথা শুনে মনটা আর্দ্র হয়ে উঠল। কত তরুণ দেশে কাজ না পেয়ে জীবন বাজি রেখে এক অজানা গন্তব্যে ছুটে চলেছেন!
তবে কলোসিয়ামের আশপাশে যত বাংলাদেশি পেয়েছি, সবাই একটি বিষয়ে সাবধান করে দিলেন। বললেন, পকেট খুব সাবধান, ব্যাগ সাবধানে রাখবেন আর পারলে মেট্রো এড়িয়ে যাবেন। কারণ, এখানে ভদ্রবেশী চোর আপনার আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উনাদের কথা শুনে আমি দ্রুত আমার সহকর্মী সানোয়ার নাফিসের কাছে এলাম। এসে দেখি, ভদ্রলোক লাইন ভঙ্গ করার অপরাধে পেছনের দুজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে আছেন। তাঁদের একটাই কথা, উনি পেছন থেকে এসে সামনের জায়গা দখল করে আছেন। আমাকে দেখে উনি সাহস ফিরে পেলেন। আমি যখন জোর গলায় বললাম, আমরা দুজন একসঙ্গে এসেছি, উনাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি অন্যদিকে গিয়েছিলাম। এরপর ভদ্রমহিলা দুজন শান্ত হলেন। আমি সানোয়ার নাফিসকে বললাম, আমার সঙ্গে কয়েকজন বাংলাদেশির কথা হলো, সবাই ব্যাগ এবং ওয়ালেট সাবধানে রাখতে বলেছেন। আমার কথা শোনার পর ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট বের করে নিজের পকেটে রাখলেন, যেটি আসলে আমাদের বাকি ভ্রমণটাকে বরবাদ করার হাত থেকে রক্ষা করল। সে প্রসঙ্গে আসার আগে একটু কলোসিয়ামের ইতিহাসের কানাগলি থেকে ঘুরে আসি।
প্রাচীন রোমে ‘Pax Romana’ নামে ঐতিহাসিক এক সময় ছিল। ‘Pax Romana’ একটি লাতিন শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ ‘Roman Peace’ বা ‘রোমান শান্তি’। সেই সূত্রে রোমকে বলা হতো ‘চির শান্তির দেশ’। অথচ কালের বিবর্তনে এই রোমেরই প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠল এক বিশাল উপবৃত্তাকার অ্যাম্ফিথিয়েটার, যেটি রোমান কলোসিয়াম বা ফ্ল্যাবিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার নামেও পরিচিত। সম্রাট ভেস্পারিয়ান খ্রিষ্টপূর্ব ৭০-২২ সালে এই কলোসিয়ামের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন এবং তাঁর ছেলে সম্রাট টিটাস খ্রিষ্টাব্দ ৮০ সালে এটি উদ্বোধন করেন। যেটি আসলে ছিল একটি বিনোদনকেন্দ্র। যে বিনোদনকেন্দ্রে ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মানুষ একসঙ্গে বসে গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই উপভোগ করতেন। শান্তির দেশের কেন্দ্রভূমিতে বনের ভয়ংকর হিংস্র পশুদের সঙ্গে মানুষের লড়াই চলত এবং এই তীব্র লড়াইয়ে কত মানুষ অকাতরে প্রাণ হারাতেন। বলা হয়ে থাকে, এই কলোসিয়ামের প্রান্তরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন প্রদর্শনী ও যুদ্ধে পাঁচ লাখের অধিক মানুষ ও এক মিলিয়নের বেশি বন্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছিল, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রুদ্ধতাকেও হার মানাতে চায়।
চির শান্তির দেশের মানুষকে বিনোদিত করতে রক্ত ঝরাতেন গ্ল্যাডিয়েটররা। গ্ল্যাডিয়েটররা ছিলেন মূলত এমন সব যোদ্ধা, যাঁরা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞ হয়ে জনসমক্ষে যুদ্ধ করে মানুষকে বিনোদিত করতেন। এই গ্ল্যাডিয়েটররা মূলত ছিলেন দাস, যুদ্ধবন্দী, দাগি অপরাধী অথবা কিছু ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক। এঁদের জীবন ছিল অতি কঠোর, বিপজ্জনক এবং অমানবিক, যা রোমান সমাজে একসময় আতঙ্ক, বিনোদনদাতা এবং বীরত্বের প্রতীক হয়েছিল। হিংস্র পশুর সঙ্গে লড়াই করে যে গ্ল্যাডিয়েটর নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন, তিনি রোমান সমাজে হয়ে উঠতেন এক বীরত্বের প্রতীক।
গ্ল্যাডিয়েটরদের সেই জীবন-মরণ যুদ্ধকেন্দ্র দেখতে লাইনে দাঁড়ালাম। সারা পৃথিবী থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষ এসে এখানে হাজির হয়েছেন। আমরাও তাঁদের পায়ে পা মিলিয়ে কলোসিয়ামের ভেতরের দিকে এগিয়ে চলেছি। লম্বা প্রবেশপথের দুই পাশে পুরোনো স্থাপনা, কোথাও আবার সংস্কার করা হয়েছে, কোথাও আবার কলোসিয়ামের ইতিহাসগাথা বর্ণনা করা আছে। কলোসিয়ামের বিভিন্ন যুগের ছবির প্রদর্শনী আছে, গ্ল্যাডিয়েটরদের সম্পর্কে অজানা কাহিনি তুলে ধরা আছে, আবার কোথাও ইউরোপিয়ান শিল্পকর্মের প্রদর্শনী রাখা আছে। এগুলো দেখতে দেখতে আমরা সিঁড়ি বেয়ে কলোসিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিছু জায়গা থেকে কলোসিয়ামের ভেতরটা খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং সেখানে আবার পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা সুরক্ষা আছে। কলোসিয়ামের ভেতরের মূল মঞ্চটা যেখানে গ্ল্যাডিয়েটরার সেই ভয়ংকর লড়াই লড়তেন, সে জায়গাটা কিছুটা উপবৃত্তাকার এবং তার চারপাশে আধুনিক স্টেডিয়াম সদৃশ গ্যালারি, যেখানে বসে সাধারণ দর্শকেরা লড়াই উপভোগ করতেন। কালের বিবর্তনে ইটগুলোর ওপর ধুলা পড়ে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেছে, কিছু জায়াগা দেখলে মনে হয়, ইটগুলো খসে পড়ছে, কিন্তু একজন পর্যটকের অন্তর্দৃষ্টি যেন সেই দুই হাজার বছর আগের জাঁকজমক জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চায়। এর সঙ্গে যাঁরা হলিউডের ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ মুভি দেখেছেন, তাঁরা সহজেই কলোসিয়ামের সেই পুরোনো কালকে আরও বেশি করে অনুভব করতে পারেন।
ঘণ্টা দুয়েক কলোসিয়ামের ইতিহাসের কানাগলিতে ঘুরে আমরা দুজন পূর্ব পাশের উঁচু রাস্তার কাছে চলে এলাম, যেখান থেকে কলোসিয়ামের ছবি খুব ভালোভাবে ক্যামেরায় ধারণ করা যায়। আমরা দুজনে মাটিতে ব্যাগ রেখে ছবি তুলছি, দুজনেই ব্যাগের ব্যাপারে সতর্ক। তবে চমৎকার ছবির ফ্রেম আসতে থাকায় দুজনে অন্য জগতে চলে যাই। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন কেতাদুরস্ত মানুষ এসে আমাদের চার-পাঁচ হাত দূরের একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘আরে, তোমরা কোন জায়গা থেকে ছবি তুলছ, আসল ফ্রেম তো এখানেই পাবে’। আমরা দুজনে তাঁর কথার উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে সেই স্পটে দাঁড়িয়ে আনন্দে ছবি তুলছি আর ভালো ফ্রেম পাওয়ার আনন্দে ভেসে যাচ্ছি। ছবি তোলা শেষ হতে ব্যাগের কাছে এসে দেখি, আমার ব্যাগটা ঠিকঠাক আছে কিন্তু আমার সহকর্মীর ব্যাগ হাওয়া, তাঁর ব্যাগে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরাসহ আরও কিছু দামি জিনিস ছিল। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ টাকার জিনিস হবে। দুজনে হকচকিত হয়ে পড়েছি, এমন সময় কয়েকজন বাংলাদেশি এগিয়ে এসে আমাদের ব্যাগ হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনতেই একজন বললেন, এই ব্যাগ আর পাবেন না। সে হাওয়া হয়ে গেছে, এদের চক্র আছে এবং চুরির পর খুব সহজেই সেই চক্রের সঙ্গে মিশে যায়।
এরপর আমরা দুজনে আশপাশের পার্ক এবং বিভিন্ন জায়গায় কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে খোঁজ নিয়ে কলোসিয়ামের পাশের পুলিশ স্টেশনে গেলাম। ছোট্ট একটা পুলিশ স্টেশন, যেখানে দুই-তিনজন কর্মী আছেন এবং তার মধ্যে একজন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। আমরা সমস্যার কথা বলার পর তাঁদের মধ্যে খুব একটা তাগিদ দেখতে পেলাম না। বললেন, যিনি অভিযোগনামা নেবেন, তিনি কয়েক ঘণ্টা পর আসবেন এবং আমাদের সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর ব্যাগ ফিরে পাব কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পুলিশের এই হাবভাব দেখে আমরা দুজন যা বোঝার তা বুঝে গেলাম এবং বাইরে এসে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ভ্যাটিকান সিটির দিকে যাত্রা শুরু করলাম। পেছনে পড়ে থাকল একদা চির শান্তির দেশে ঘুরতে এসে ইতিহাসের গোলকধাঁধায় ঘুরে, বর্তমানের চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনির বাস্তব প্রমাণের সাক্ষী থাকার বাস্তব অভিজ্ঞতা।
লেখক: সুব্রত মল্লিক, পিএইচডি শিক্ষার্থী (সমাজবিজ্ঞান), ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার