বীথি: পর্ব-৮
সময়টা অদ্ভুত, মনটাও নানান দোলাচলে দুলছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, সময়ের তুলনায় অনেক পেছনে পড়া মেয়ে আমি, কিন্তু ঠিক কতটা পেছনে আছি আজও?
তোকে এই চিঠি লেখার ভেতর দিয়ে যে সামান্য কয়েকজন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তারা অনেকেই নানান বয়সী, নানান চিন্তার, নানান মতের, কিন্তু তাই বলে কি বাস্তবতা থেকে এতটা পিছিয়ে আছি এখনো?
মাত্র কয়েকটা চিঠি লিখেছি তোকে। বারবার বলেছি, এই লেখা একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। যেহেতু অনেকটাই একা জীবন যাপন করি, তাই লিখলে একটু হালকা লাগে।
কিন্তু বেশ কয়েক দিন হলো কিছু মেয়ে যোগাযোগ করছে। তাদের কথা স্পষ্ট, আপা আপনি এখনকার ঢাকা শহর চেনেন না, আপনি জানেন না মেয়েরা কতখানি নির্যাতন করতে পারে একটা ছেলেকে।
আপনি কেন মনে করছেন, মেয়েরাই কেবল কষ্ট করছে? মেয়েরাই শুধু প্রতারিত হচ্ছে? আপনি কেন ভাবছেন না যে অনেক ছেলেও মেয়েদের দ্বারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? সংসারের স্বার্থে ছেলেরা চোখ বুজে সয়ে যাচ্ছে অনেক নির্যাতন?
নির্বাক হয়ে শুনছিলাম বীথি। এখনো যে তোকে লিখছি, জানি না আসলেই গুছিয়ে লিখতে পারছি কি না? আমার চেয়ে মাত্র ৮ থেকে ৯ বছরের ছোট হবে বাংলাদেশের উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে দিয়া যে গল্প শোনাল, এই বয়স অবধি এমন গল্প শুনিনি বীথি।
কিন্তু আমারও তো ছেলেবন্ধু আছে অনেক। প্রেম যে আমি কোনো দিন করিনি, এমন কথাই–বা বলতে যাব কেন? তাই বলে বর্তমান কিছু কিছু মেয়েদের যদি এই ভ্যালুজ হয়, তাহলে বাংলাদেশের সমাজ কোন দিকে যাবে, সেটা জানা তো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এই হলো দিয়ার বলা গল্প, হুবহু শেয়ার করছি বীথি তোর সঙ্গে।
তপন আর তনিমার বিয়ের সাত বছর পরের ঘটনা।
তনিমাকে নাকি প্রশংসা করা যাবে না, এমন একটা দিক নেই। পড়াশোনা, সুন্দরী, শ্বশুর বা শাশুড়ির দেখাশোনা, দেবর–ননদের সঙ্গে তনিমার সম্পর্ক, নিজের পরিবারের দায়িত্ব পালন করা, স্বামীর দেখাশোনা করা ও শেষমেশ নিজের ক্যারিয়ারে সফল হওয়া, কোনো দিক থেকেই তনিমার তুলনা নেই। সব ব্যাপারে তনিমা ১০০–তে ১০০।
বিয়ের ছয় থেকে সাত বছরের মাথায় তনিমা ও তপনের ঘর আলো করে আসে মেয়ে তন্বী। তনিমার হাজার ব্যস্ততার কারণে ওদের মেয়ে তন্বী মানুষ হতে থাকে নানুর বাসায়। তনিমা অফিসের একটা প্রোগ্রামে যাবে মালয়েশিয়া, এক বছরের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই তপন নিজে থেকে তনিমার সব কাজ গুছিয়ে দেয়, তনিমাও লক্ষ্মী বউ ও মেয়ের মতো কুয়ালালামপুর চলে যায়।
এক দিন, দুই দিন, তিন দিন তনিমার খোঁজ পায় না তপন। সপ্তাহ ও মাস গড়ায় কিন্তু তনিমার খোঁজ নেই। একদিন তপন কুয়ালালামপুরের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অফিস জানিয়ে দেয়, এই নামে কোনো মেয়ে এখানে কোনো প্রোগ্রামেই এনরোল করেনি। এবার তপন খোঁজ লাগায় তনিমার ঢাকা অফিসে, নানা চ্যানেল ধরে মাস সাতেক পরে জানতে পারে, তপনেরই এক বন্ধুর সঙ্গে তনিমা জাপানে সংসার পেতেছে এবং তনিমা সন্তানসম্ভবা।
এরপর নাকি তনিমার বাবা ও মা জানিয়ে দেয়, ও আমাদের মেয়ে নয়, তপন তুমি যা পারো করো, আমরা আছি তোমার সঙ্গে। কথা এখানেই শেষ নয় বীথি। জাপানে থাকাকালে পুরো সময়টা তনিমা তপনের টাকার ওপরেই চলেছে। এই গোটা দেড় বছরে তনিমা একবারও তার নিজের মেয়ের খবর নেয়নি এবং আজ অবধি তনিমা মেয়ের খবর নেয় না। শ্বশুরবাড়ি তো দূরে থাকুক, নিজের বাবা বা মায়ের বাড়িতেও কোনো যোগাযোগ রাখেনি।
আমি নিশ্বাস বন্ধ করে দিয়ার গল্প শুনছিলাম বীথি। বারবার প্রশ্ন করলাম, দিয়া তোরা কি ঠিকমতো খোঁজ বের করেছিল যে আদৌ তপনের সঙ্গে তনিমার এমন কোনো বিষয় ছিল কি না, যে ও অন্য ছেলের কাছে গিয়েছিল?
দিয়া হেসে দিয়ে বলে, লুনা আপা, আপনি কেন ভাবছেন যে একটা মেয়ে শুধু স্বামীর কাছ থেকে কষ্ট পেলেই অন্য কারও কাছে ভালোবাসার খোঁজে যাবে? কেন ভাবছেন সেটা?
এখনকার মেয়েরা অনেক বেশি আধুনিক। বিবাহবিচ্ছেদ, স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে ফ্লাড করা, বিভিন্ন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে থাকা, এগুলো এখন অনেক মেয়ের কাছেই ডালভাত।
বীথি, সমাজ সামনের দিকে যাওয়া মানে কি এই? মানুষের নীতি ও নৈতিকতা থাকবে না? মানুষের নিজের প্রতিশ্রুতির ওপর সম্মান থাকবে না?
তুই কি জানিস বীথি, এই নর্থ আমেরিকায়ও কোনো ছেলে বা মেয়ে, একজন বয়ফ্রেন্ড থাকলে আরেকজনের কাছে যেতে পারবে না, এটা অনেকটা সর্বজন স্বীকৃত আইন।
পাশ্চাত্য ছেলেমেয়েরা তাই বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের চেয়ে ১০০ শতাংশ বেশি সৎ। তারা যা করে সরাসরি করে, কোনো লুকোচুরি করে না, কিন্তু বাংলাদেশে এসব ব্যাপারে কি কোনো আইন আছে? তনিমা কি একবারও ভেবেছে, তন্বী বড় হয়ে মায়ের কথা কী করে বলবে নিজের কাছে? তনিমা কি ভেবেছে, তপন নিজেকে কী দিয়ে সান্ত্বনা দেবে?
রাত হলো বীথি, কাল অফিস, ঘুমাতে যাব। পিছিয়ে পড়া মানুষ, এই অনেক ভালো আছি। আদর তোকে। চলবে...