গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: কানাডা পর্ব ৭
ওয়ালমার্টের চৌমুহনীতে পৌঁছার কিছুটা আগেই ইমার্জেন্সি লাইট অফ করে দিলাম। অনবরত ঝরে পড়ছে শ্বেতশুভ্র হিমবৃষ্টি, পুরো রাস্তায় বরফ সরানোর কাজে নিয়োজিত ভারী ট্রাকগুলো কাজ করে যাচ্ছে। ফ্রন্ট অ্যান্ড লোডার, গ্রিটার, স্নো ব্লোয়ার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাজ করে চলেছে। এখানের রাস্তা তা-ও অনেক ভালো লাগছে, সেটা মোড় নেওয়ার পর বুঝলাম। বাসায় পৌঁছে কীভাবে এ ভয়ংকর রাস্তা আজ পাড়ি দিলাম, সেটা ভাবতে ভাবতে খেয়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলাম।
শীতকালে আরও একটা ব্যাপার বেশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেটা হলো, গাড়ির কলকবজার উৎপাত! আমার গাড়িতেও সেটাই হলো। কথা নেই-বার্তা নেই—হঠাৎ দেখি, গাড়ির ব্রেকে সমস্যা হচ্ছে! তখন আবার বাসে চেপে ওয়ালমার্টের কাজে যেতে লাগলাম। কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় কোথায় দেখাব, খরচ কেমন, সাশ্রয়ী থাকার কৌশল কী—এসব যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন ওয়ালমার্টের এক সহকর্মী বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, গ্যারেজে গাড়ি সারাতে দিলেও কোনো পার্টস ওদের কাছ থেকে নেওয়া যাবে না। পার্টসগুলো বাইরের কোনো অটো রিপেয়ার দোকান থেকে কিনে নিতে হবে। তাহলে অনেক সস্তায় ম্যানেজ করা যাবে। ওর কথার যথার্থতা বুঝতে আমি গ্যারেজে গাড়ি নিয়ে গেলাম। ওরা ফোন করার কথা থাকলেও ফোন এল না। তখন নিজেই নক দিয়ে যা কথা বলে জানতে পারলাম, সেটা আমার সহকর্মীর কথার সঙ্গে মিলে গেল। সবকিছু মিলিয়ে প্রায় ৪৫০ ডলারের কথা বলল ওই মেকানিক। আমি যন্ত্রাংশের লিস্ট চাইলাম। সে অনুযায়ী চলে গেলাম নাপা অটো পার্টসে। বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কেনার পর আমাকে ট্যাক্সি ডাকতে হলো। এতই ভারী যে এসব বহন করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অথচ ওই গ্যারেজ থেকে দোকান মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বের! ট্যাক্সি ড্রাইভারকেও আমাকে সাহায্যে হাত বাড়াতে হলো। জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসার কয়েক দিন পর আবার কল দিয়ে অবস্থা জেনে নিলাম। কোনো কারণে আমার কাছে গ্যারেজ থেকে কোনো আপডেট আসেনি।
কেন? সেটা আজও বোধগম্য নয়। কারণ, এরা কাজের ব্যাপারে খুবই পেশাদারত্বের পরিচয় দিয়ে থাকে। সঠিক কত দিন পর গাড়ি আনতে গিয়েছি, সেটা হলফ করে বলতে পারব না। তবে যখন গিয়ে খরচাপাতি দিতে হলো, তখন বিল পেলাম আনুমানিক ১৯৫ ডলারের মতো। খরচের পার্থক্য দেখে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! বেশ ভালো মনেই বাসায় ফিরে এলাম।
অধিকাংশ সময়ই এখানকার সবাই যেসব গাড়ি কেনেন, সেগুলো ব্যবহৃত। আমারটাও তেমন। তবে অন্যান্য যেকোনো গাড়ির তুলনায় একে নিতান্তই উৎপাতহীন বলা যায়। আমাদের হোস্টেলে সবচেয়ে বেশি গাড়ি সারাতে হয়েছিল রাহুলকে। ওর ছোট্ট লাল রঙের হায়উন্ডাই আই টেন নিয়ে কাঠখড় পোহাতে হয়েছে মোটামুটি। একবার সামনের হেডলাইটের পাশের জায়গাটা কীভাবে যেন দেবে গেল। ওইটা কখনোই পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায়নি। কারণ, এর জন্য ওকে পুরো কাঠামোর অনেকটাই পরিবর্তন করতে হতো। এরপর গাড়ির ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিল। প্রায়ই ওকে আমার গাড়ি থেকে প্লাগ নিয়ে জাম্পার কেব্লের সহায়তায় ব্যাটারি অন ব্যাটারি মেথডে চার্জ দিয়ে গাড়ির স্টার্ট নিতে হতো। আর যেদিন আমি থাকব না, সেদিন হয়তো ও জুয়েলকে বলত। এ ছাড়া ওর গাড়ি সকালে স্টার্ট নেয় না। জাম্পার কেব্ল এক বিশেষ তার, যেটার লাল ও কালো দুটি প্রান্ত গাড়ির ভেতরের ব্যাটারির মধ্যে লাগিয়ে একে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। অনেকটা আমাদের ফাস্ট এইড বক্সে থাকা ডি-ফিব্রিলেটরের মতো। এর কাজ হৃৎপিণ্ডের কম্পন ফিরিয়ে আনা। তখন আরেকটা গাড়ির সহায়তার প্রয়োজন হয় বলে একে বলা হয় ব্যাটারি অন ব্যাটারি মেথড। ও প্রায়ই সকালে কাজে যাওয়ার সময় এসে দরজায় নক করে গাড়ির চাবিটা চাইত। বোঝো হ্যাপা কাকে বলে? সকালে কাজের জন্য দৌড়াদৌড়ি করব না গাড়ির জন্য? দুটি নিয়েই চলতে হবে, কিছু করার নেই।
আবার গাড়ির চাকার হাওয়া ফুরিয়ে গেলে সেটা ঠিক করে নিতে হয়। ঠিক যেমন আমরা সাইকেলের চাকায় হাওয়া দিই। বাসার কাছেই একটা গ্যাস স্টেশনের পেছনে বিনা মূল্যে এ কাজ সারা যাবে। হোস্টেলের ছেলেপেলেরা ওখানেই যায়। প্রতিদিন লক্ষ রাখতে হয় চাকার যেকোনো ধরনের সংকোচনের দিকে। কারণ, বাতাস ফুরিয়ে গেলে বা ঠিকঠাক না থাকলে মধ্যপথে যখন-তখন বিগড়ে যাবে আপনার চতুর্চক্রযান। হাইওয়ের মাঝামাঝি পথে কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ দয়া পরবশ হয়ে লিফট দেয় আরকি! না হলে কী হবে, সেটা আপাতত না ভাবলেও চলবে। গাড়ির বায়ুসেবনের কাজটা প্রথম খুব সম্ভবত জুয়েল করে দেখিয়ে দিয়েছিল। এরপর আরও অনেক দিন এর প্রয়োজন না হওয়ায় পরেরবার যখন সময় এল, তত দিনে সব বেমালুম ভুলে বসে আছি। তবে পরেরবার গিয়েই মূলত বিষয়টা ভালোভাবে রপ্ত হলো। কৃতিত্ব রাহুলের। রাতে ওকে বলাতে ও নিয়ে গেল কাছাকাছির সেই নিডসের গ্যাস স্টেশনে। চাকায় কতটা বাতাস লাগবে, সেটা গ্যাস মাপার মেশিনে দেখে নিতে হবে।
বেশ কয়েক রকমের হয়—আমারটা ছিল অ্যানালগ আর ওরটা ডিজিটাল। আমরা আগেই দেখে নিয়েছিলাম কতটা বর্তমানে আছে। জায়গায় পৌঁছে রাহুল কালো লম্বা পাইপটা চাকার হাওয়ার নজলের কাছাকাছি নিয়ে ওখানে চেপে ধরতেই একটা শব্দ হলো। এর অর্থ হলো, গ্যাস ভর্তি করার পাইপ থেকে বাতাস চাকায় প্রবেশ করছে। কতটা প্রয়োজন হবে, সেটা প্রাথমিকভাবে ধারণা করে নিতে হবে। রাহুলের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে ওর বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না। আমি অবশ্য প্রথমবার বুঝতেই পারলাম না। পরেরবার নিজে ওর কাছ থেকে নিয়ে ওখানে চেপে ধরলাম, কাজ হলো না। ও নিজেই করে ফেলল। আমরা দুটি চাকারই হাওয়া ভর্তি হওয়ার পরের রিডিং দেখে নিলাম। একেক গাড়ির চাকার অবস্থা ভেদে বুঝে কাজ সারতে হবে। পরেরবার আমি নিজেই কাজটা সারলাম। ও আইডিয়া করে থামতে বলল আমাকে। বাতাস বেশি হয়ে গেলেও কিন্তু সমস্যা হবে। সবকিছুই পরিমিত পরিমাণে হওয়া চাই। ওই রাতেই চাকার বায়ুসেবনের পদ্ধতি রপ্ত হয়ে গেল।
গাড়ি চালানোর সময় আরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা। বিশেষ করে পিঠের ব্যথা আর হাতে বা পায়ে যদি কোনো আঘাত পান, সাবধানে থাকাই উত্তম। এক রাতে হয়তো কাজ করতে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মচকে গিয়েছিল বা ঠিক কখন ব্যথা পেয়েছি, সেটা অতটা ঠাওর করতে পারিনি। তখন ছিল শীতকাল। বাইরে থাকলে হাত, পা অধিকাংশ সময়ই ঠান্ডায় জমে থাকে। রাতে বাসায় তেমন কিছু বুঝতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্যান্ডেলে পা রাখতেই পুরো আঙুলের জয়েন্টে ভয়ংকর তীব্রভাবে কনকনে ব্যথা হতে লাগল। এতটাই যে বুড়ো আঙুলটা মাটিতে স্পর্শ করতে পারছি না! এমন ব্যথা আজ পর্যন্ত কখনোই হয়নি। ছোটকালে প্রতিদিন এত ক্রিকেট খেলেছি, বর্ষাকালে ফুটবলের পেছনেও দৌড়েছি আর শীতকালে তো দিনে ক্রিকেট আর রাতে ব্যাডমিন্টন। কখনো হলে নিশ্চয়ই মনে থাকত। অনেক সাবধানে ওপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম, ওয়াশরুমের কাজ সেরে আবার শুয়ে পড়েছি। কপাল জোরে ওই দুই দিন চাকরির ডিউটি ছিল না। পরে যখন ঠিকঠাক ঘুম ভেঙেছে, তখন বুঝলাম পরিস্থিতি ভয়াবহ। এ পায়ে আঙুল মাটিতে ঠেকিয়ে কিছুই করা যাবে না।
খোঁড়াদের মতো কাজকর্ম সারতে লাগলাম। পরে হোস্টেলের ছেলেপেলেদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম কারও হয়েছে কি না এমন কিছু। প্রথমে ভেতরে হাড়গোড় কিছু ভেঙে গেছে কি না, কারণ আঙুলের চারপাশে হালকা লালচে হয়ে ফুলে গেছে আর কোনো কিছুর স্পর্শে তীব্র ব্যথা!
চিকিৎসকের কাছে যাব কি না ভাবতে ভাবতে রাহুল বলল, ‘আরে দাদা! এসব কিছুই না। আপনি ব্যথার ওষুধ খান, আর কিচ্ছু লাগবে না।’ কথাটা ও আন্দাজে বললেও এতে কাজ হলো। ওকে নিয়ে বাসার কাছেই ফার্মেসিতে গিয়ে ব্যথানাশক ওষুধ আর একটা অ্যামালজেল নিলাম। ব্যথা সারাতে নানাবিধ গবেষণা চলতে লাগল। কতটা সেরেছে, এটা নিয়ে দ্বিধাবোধ করছি। এদিকে চাকরির ডিউটির সময় হয়ে এল। তখন হোস্টেলের ছেলেদের অনুরোধ করলাম, কেউ যদি একটু নামিয়ে দিয়ে আসে। রাহুল নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিল আর আসার সময় রাতে নূর। নিজের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও ড্রাইভ করল রাহুল আর নূর, অবশ্য ওর গাড়ি চেপেই গিয়েছিল। কাজেই নিজের গাড়ি থাকলেও অনেক সময় পরিস্থিতি ভিন্ন দৃশ্যের অবতারণাও ঘটাতে পারে। ক্রমশ...