গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: কানাডা পর্ব-৮
গাড়ি কেনা নিঃসন্দেহে যেকোনো ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা বাড়ায়। বঙ্গদেশে তো বটেই, এখানে প্রবাসের মাটিতেও দৃশ্যের কোনো হেরফের হয়নি। যিনি আপনাকে কোনো দিনও পাত্তাই দিতেন না, তিনিও আপনার সঙ্গে বেশ সমীহ করেই কথা বলবেন। অনেককেই তখন লিফট দিতে হতো। সেটা বাসায় হোক আর কাজের জায়গায় হোক। বিষয়টা কখনো কখনো অস্বস্তিকর। যতটা পারা যায় মানিয়ে নিতে হয়। আমার ক্ষেত্রে কখনোই গাড়িতে কাউকে নিয়ে যাওয়া বা নামিয়ে দিয়ে আসা নয়; বরং কীভাবে লিফট দেব, সেটাই ভাবনার হতো। এ ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকলেও গাড়ি চালানোর জড়তার কারণে কখনো কখনো মনোমালিন্যের ঘটনাও ঘটেছে, যা সত্যিই অনভিপ্রেত।
একদিন রাতে সহপাঠিনী উলফাতকে নিয়ে কাজ থেকে ফেরত আসছি। ওর সঙ্গে সবকিছু নিয়েই কথা চলল। একপর্যায়ে গাড়ির প্রসঙ্গ উঠতেই সটান জানিয়ে দিলাম, আমার লাইসেন্স টেস্ট এখনো দেওয়া হয়নি। ও কিছুটা অবাক হলেও চুপ করে গেল। খানিকটা ভয়ও পেয়েছিল হয়তো। কারণ, এরপর আর কখনো ও আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে বলেনি। যদিও সবই ঠিকঠাক ছিল ওই রাতে। আমার লাইসেন্স নেই, এটা সমস্যার কারণ ছিল বা টেস্ট দিইনি এখনো—আমার এখনো জানার খুব ইচ্ছা হয়।
আরেক দিন বাসার ছেলেপুলেদের গ্রুপ জেঁকে ধরল ওদের নিয়ে বের হতে। প্রথমে আমি ভাবলাম, ওরা নিতান্তই ফাজলামোর ছলে কথা বলছে। পরে বুঝলাম, ওরা ডাউনটাউনে যেতে চায়। কোনো সঠিক উপলক্ষ নেই। হঠাৎই রাতের ১০টা বা সাড়ে ১০টা নাগাদ সবার ঝোঁক উঠল পিৎজা খাবে! আর ড্রাইভিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে। অবশেষে ওদের মনোভাব বুঝতে পেরে বের হলাম। সামনে আমি, জুয়েল আর পেছনে আকিব, নূর, রাহুল। আলেকজান্দ্রাস পিৎজায় হবে আজকে রাতের পার্টি। বাসা থেকে বের হয়ে মেইন রোডে নেমে গেলাম বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই। পাশ থেকে গাড়ির দিকনির্দেশনা দিয়ে কাজটা অনেক সহজ করে দিল জুয়েল। প্রথমে আমি যে জায়গায় ওরা থামাতে বলল, ওখানে না থামিয়ে একটু এগিয়ে চলে গিয়েছিলাম। পরে পুরো রাস্তাটা ইউটার্ন নিয়ে আবার বৃত্তাকার পথে ঘুরে ডাউন টাউন হয়ে একই জায়গায় হাজির হলাম। ওই দোকান বন্ধ ছিল। পরে আলেকজান্দ্রাস পিৎজায় পৌঁছে গেলাম সদলবল। ওই দিনের পরে কাকতালীয়ভাবে আর কখনোই ওদের নিয়েও ড্রাইভ করা হয়নি!
পরের গল্পটা কনসেনট্রিকসের অফিসে যাওয়ার পথে হয়েছিল। বরাবরই আমার সমস্যা ছিল রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে হঠাৎই যদি কোনো কারণে গতিপথ বদলে যায় বা অন্য কোনো পথে গিয়ে পড়ি, তখন বেসামাল হয়ে পড়া। এ ক্ষেত্রে রাস্তায় সাইন কোথায় আছে, সেসব লক্ষ রেখে চালানো দুষ্কর মনে হতো আমার। কারণ, গাড়ি সামাল দেব, না নিজেকে, না সাইনের প্রতি খেয়াল করব। নিয়ম হচ্ছে, সবকিছুই আপনাকে লক্ষ করে চলতে হবে। জুয়েল একবার বলেছিল, গাড়ি চালানোর সময় আপনার দৃষ্টি তিনটি রেয়ার ভিউ উইন্ডোতেই রেখে চালাবেন। আর লেইন চেঞ্জ করার সময় অবশ্যই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে তারপর পরিবর্তন করুন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এসব অভ্যাসে চলে আসে। আমার ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টাকেই মানিয়ে নিতে না পারা, গাড়ি চালানোর সিটে বসে চরম অস্বস্তি বোধ করা, মাল্টি টাস্কিং করতে না পারা—এসব মিলিয়েই সমস্যার পথে এগিয়েছে। বরাবরের মতোই স্বাভাবিকভাবে ওই দিনও অফিসে পৌঁছে গেছি প্রায়। এমন সময় দেখলাম, অফিসের ঠিক সামনের রাস্তাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওখান থেকে অন্য আরেকটা পথে ঘুরে যেতে বলেছে। কিন্তু ওই পথে ঘুরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। কারণ, সঠিক কোন পথে আমি অফিসে ফেরত আসব, সেটা জানা নেই। হঠাৎই ওরকম একটা সাইন দেখে অন্য গাড়ির দেখাদেখি আমিও নির্দেশনা দেখানো পথে ঢুকে গেলাম, কিন্তু কোথায় কী? এরপর শুধু গলির বিভিন্ন রাস্তায় শুধু চরকির মতো ঘুরেই যাচ্ছি, কিন্তু অফিসে ফেরার পথ কোনোভাবেই বের করতে পারলাম না। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার সময় লক্ষ করলাম, পেছনের গাড়ির চালকেরা বেশ কটু ভাষায় কথা বলছেন। তাই আমি অন্য একটা রাস্তায় ঢুকে অজানা একটা খালি জায়গায় গাড়িটা পার্ক করে দিলাম ভোঁ দৌড় অফিসের দিকে। তখন মনে হয় আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি আছে কল রিসিভ করার। পরে ব্রেকে ম্যানেজারকে পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বললাম। উনি বেশ সায় দিয়ে বললেন, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব। লাঞ্চ ব্রেকের সময় ওনাকে ডেকে নিতে বললেন। তা-ই করলাম। উনি আমাকে নিয়ে অফিসের পেছনের দিকে চলে গেলেন। মূলত অন্য পথটা পেছনের দিকে। ওখান থেকে আমাকে নিয়ে হেঁটে সোজা চলে গেলেন ওই জায়গায় যেখানে আমি গাড়ি পার্ক করে রেখে এসেছি।
মোটামুটি একবার দেখিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পথটা বুঝলাম। এর আগেও আমি এখান দিয়ে গেছি। ওই পথ থেকে কিছুটা কাছাকাছির মধ্যেই বাস নামিয়ে দিয়ে যায়। উনি আমাকে এটাও দেখিয়ে দিলেন ফিরব কোনো পথে। এরপর বাসার দিকে চললেন। আমি গাড়ি চালিয়ে অফিসের পেছনের দিকে গাড়িটা পার্ক করলাম। এ ঘটনায় রাস্তা হারিয়ে ভ্যাবাচেকা খাওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, যখন আমি রাস্তা হারিয়ে দিশাহারা অবস্থায়, কোথায় পার্ক করব সেটা খুঁজে ফিরছি, তখন অন্য ড্রাইভাররা ভাবছিলেন, আমার কৃতকাজ নিতান্তই ফাজলামো! গাড়ির ভেতর থেকে তো আর তাঁদের আমার করুণ অবস্থার জানান দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক গালিগালাজ শুনেছি, তবে ঘাবড়ে যাইনি মোটেও। এ ক্ষেত্রে শাহরুখের একটা কথা স্মরণে এসেছিল, ‘যা-ই ঘটুক, কখনো প্যানিক করবেন না!’ চলবে...