গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: কানাডা পর্ব-৯
গল্পের শেষের দিকে চলে এসেছি আমরা। ১০ পর্বে শেষ করার ইচ্ছা থাকলেও হয়তো পরের পর্বে শেষ হবে। এর মধ্যে অনেক খুঁটিনাটি ঘটনা বলা হয়নি। যাদের কথা উল্লেখ করেছি, তারা ছাড়াও আরও অনেকের ঘটনা আমার ড্রাইভিংয়ের গতিপথকে প্রভাবিত করেছে। তবে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি থাকার সুবিধার কোনো অন্ত নেই!
কনসেনট্রিকসের পরে অন্য চাকরির জন্য যখন বিভিন্নজনের মারফতে কর্মী নিয়োগের খবর পেলাম, তখন গাড়ি নিয়ে বেশ কয়েকটা লোকেশনে চষে বেড়িয়েছি। প্রথমে একদিন গেছি ভিক্টোরিয়া রোডের অফিসে। ওখানে সামনে রাস্তায় পার্কিং করা যায় না। পেছনে জায়গা আছে, তাও মাত্র দুই-একটা গাড়ি রাখার। ওদের অফিসটাও একেবারে যাকে বলে আরও অনেকগুলো অফিসে ঘেরা। শহরের কেন্দ্রে। আগেই ওই জায়গায় একবার ঘুরে এসেছিলাম।
কোথায় গাড়ি পার্ক করব বা কোথায় রোডের নিদের্শনা কি রয়েছে, সেটা চাক্ষুষ দেখে নিতে। এত দিন ড্রাইভিংয়ের পরও ওখানে সরাসরি গিয়ে উপস্থিত হওয়ার সাহস জুগিয়ে চলতে না পারাটাও একপ্রকার ব্যর্থতার পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু যদি পথ কঠিন হয়, ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়েই সেটা পার হওয়া উচিত। পার্ক করতে গিয়ে দেখলাম আরেকটা সমস্যা, যেটা এর আগের দিন চোখে পড়েনি। কোনো জায়গা থেকে পার্কিং করব, সেটা দেওয়া থাকলেও কোথায় এর শেষ সেটা দেওয়া নেই!
তাই আমি মোটামুটি নিজস্ব ধারণায় পার্কিং করে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চললাম। ফিরে এসে দেখি আমার গাড়ির কিছুটা সামনেই একটা বেশ ঢাউস সাইজের সবুজ রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে কিছু কর্মী ঘাস মাড়াইয়ের কাজ করছিল। পার্কিংয়ের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করলাম। ওরা আমাকে কিছুটা ধারণা দিল।
পরেরবার গেলাম বাসা থেকে কিছুটা দূরের এক জায়গায়—জর্জ স্ট্রিট। একই পথে ঘুরে সিডনির সরকারি হাসপাতালে যাওয়া যায়। এবারের রাস্তাটাও আগে কিছুটা চেনার উপায় খুঁজতে একদিন রাতের বেলা জুয়েলকে নিয়ে এক ঢুঁ মেরে এলাম। পরে নিজে যখন রওয়ানা হলাম, তখন পৌঁছলাম ঠিকঠাকভাবেই। সমস্যা হলো ফিরে আসার সময়। ওখানে একটা গোল চক্কর আছে, যেখানে গাড়িগুলো নির্দেশনা দেখে চক্রাকারে চলে।
এর একটা জায়গায় এসে সোজা পথে না গিয়ে বাম দিকে ঘুরে যেতে হতো। ওখানেই ভুল করে পরের রাস্তায় চলে গেলাম। তখনও টের পাইনি ভুল পথে এগিয়ে চলেছি। এরপর কিছুদূর গিয়েই আশপাশের সবকিছু এলোমেলো ঠেকলো। আমার হাইওয়েতে থাকার কথা আর তখন ক্রমশ একটা সরু রাস্তার পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পেরে একটা ফাঁকা জায়গায় গাড়ি ঘুরিয়ে দাঁড় করালাম। গাড়িতে বসে প্রথমে দেখলাম আসলে কোন দিকে আমাকে এখন মোড় নিতে হবে।
আরেকবার ম্যাপেও দেখে নিলাম। শুরু করলাম গাড়ি ঘোরানো। কিন্তু এবার ওই জায়গায় পৌঁছে বোধগম্য হলো, এদিক থেকে সরাসরি বাসার পথের যে হাইওয়ে, সেটাতে যাওয়া যাবে না। এর জন্য গোল চক্কর দিয়ে ঘুরে যেতে হবে সোজা পথে। এরপর পুরো পথ ঘুরে আবার আগের জায়গায় আসতে হবে। পরের বার তাই কোনোভাবেই ভুল করা চলে না। ভুল হয়নি আর পুরো রাস্তায় বেশ স্বচ্ছন্দেই বাসায় ফেরত আসি।
এসব ছোটখাটো ভুল আমাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পথে চিন্তা করে এগুতে শিখিয়েছে। একই পথে সুমন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। আমরা গিয়েছিলাম রেজিউমে জমা দিতে। ঘটনাটা অবশ্য ড্রাইভিং শেখার প্রথম দিককার। পরিস্থিতি তখন এমন ছিল যে কোনো নতুন পথে আমাকে কেউ নিয়ে না গেলে সাহস জুগিয়ে চলা মুশকিল হতো। এ ক্ষেত্রে শুরুটা জুয়েলের হাত ধরে হলেও পরে সুমন আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে আর যাওয়ার সময় বরাবরই পথের দিক নিদের্শনা বুঝিয়ে দিত। কিন্তু আমার সাহস গাড়ি চালানোর ব্যাপারে বরাবরই ছিল বেশ টলমল। এ ক্ষেত্রে সাহস জুগিয়ে চললেও চূড়ান্ত আত্নবিশ্বাসী হওয়া আর হয়ে ওঠেনি।
আরও একদিনের কথা মনে পড়ছে। তখন চাকরির বাজারে রীতিমতো আগুন জ্বালিয়েছে করোনা অতিমারী। হন্যে হয়ে ঘুরলেও চাকরির কোনো বন্দোবস্ত করতে পারছিলাম না। সেই সূত্রে নোভা স্কসিয়া ওয়ার্কসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম সকালে। এখানকার সরকারি সংস্থা চাকরি খোঁজার ব্যাপারে সাহায্য সহায়তা করে থাকে। যদিও কানাডিয়ানরাই মূলত এদের মাধ্যমে উপকৃত হয় বেশি। এর মূল কারণ হচ্ছে সরকারি প্রণোদনা।
প্রবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও এখানকার স্থায়ী নাগরিক, স্থানীয় লোকজনের জন্য এ সুবিধা দিয়ে থাকে কানাডিয়ান সরকার। যদি কোন স্থানীয় চাকরিপ্রত্যাশী নোভা স্কসিয়া ওয়ার্কসের বরাতে কাজ পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সরকার ওই প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। অনেকেই বলে, চাকরিতে ভাগ্যের কোন প্রয়োজন নেই! তবে এ ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করে বলব, আপনার চেষ্টায় যদি ৭০ ভাগ কাজ হয়, আর বাকিটা অবশ্যই ভাগ্যের ছোঁয়া লাগবে। কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও চেষ্টা করছিলাম যাতে কিছু একটা হয়। বলা তো যায় না, কোথায় লুকিয়ে আছে সোনার হরিণ!
আগেই জানা ছিল ওদের অফিসের সামনে বা পেছনে পার্কিংয়ের কোন জায়গা নেই। মোটামুটি কাছাকাছি দূরত্বের মধ্যে ছিল কফির দোকান র্টিম হর্টনস। এর আগেও এখানে বহুবার পার্কিং করেছি। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। হয়তো সেদিন অন্যরকম কোন অস্বস্তিকর সময় অপেক্ষায় ছিল।
প্রতিদিনের মতো ওই দিনও গাড়ি টিমের পার্কিংয়ে রেখে কর্মকর্তার কাছে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আসার পথে বাধলো বিপত্তি। ফিরে এসে গাড়ি ঘুরিয়ে ওখান থেকে বের হওয়ার আগেই এক ষণ্ডামার্কা কানাডিয়ান লোক এসে বেশ ঝাঁজালো গলায় আমাকে ইঙ্গিত করে বলে, ‘তুমি যদি এখানে গাড়ি পার্ক করো, তাহলে এখানকার কফি কিনতে হবে, আমি এই জায়গায় ট্যাক্স পরিশোধ করি। তোমরা এসে বিনা মূল্যে পার্কিং করে চলে যাওয়ার জন্য করি না! আমার কথা বুঝেছ?’
আমি বেশ হম্বিতম্বি খেয়ে সরি বলে সটকে পড়লাম ওই যাত্রায়। তখন পর্যন্ত এভাবে কোনো কানাডিয়ান এতটা খারাপভাবে কখনো কিছু বলেছে বলে মনে পড়ে না। চলবে...
দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]