আয়া সোফিয়া একটি আবেগের নাম। মহাকাব্যের নাম। কত কোটি কোটি স্মৃতি একে ঘিরে। কত রাজা-মহারাজার স্মৃতি মিশে আছে এর সঙ্গে। এর ইতিহাস পড়লে বিস্ময় জাগে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হাত ঘুরে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সম্পদে পরিণত হয় এটি। একসময়ের গির্জা ইস্তাম্বুল জয়ী সুলতান ফাতেহ মুহাম্মদ মসজিদে পরিণত করেন। সেক্যুলার কামাল আতার্তুক মসজিদ হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে জাদুঘরে রূপান্তর করেন।
২০২০ সালের ১০ জুলাই তুরস্কের একটি আদালত ১৯৩৪ সালের মন্ত্রিসভার একটি ডিগ্রি বাতিল করেন। ফলে আয়া সোফিয়া আর মসজিদে পরিণত করতে বাধা থাকে না।
বস্তুত তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তর করেন। বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে গ্রিস ও যুক্তরাষ্ট্র তীব্র প্রতিবাদ করে। এরদোয়ানের নির্বাচনের মেনিফেস্টো ছিল এটি। তিনি বহিরাগত এসব চাপের কাছে মাথা নত করেননি। আয়া সোফিয়া গ্র্যান্ড মসজিদ হিসেবে তার আগের গৌরব পুনরুদ্ধার করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ান মসজিদের ভেতরে ৮৬ বছর পর প্রথম শত শত মুসল্লি নিয়ে নামাজ আদায় করেন।
সেই ২০২০ সাল থেকে আমার খুব ইচ্ছা আয়া সোফিয়াতে নামাজ পড়ার। ইস্তাম্বুলে আসার আগে ইস্তাম্বুলের কিছুই চিনি না আয়া সোফিয়া ছাড়া। এখানে আসার পর থেকেই মনটা আনচান করছিল আয়া সোফিয়াতে যাব। আমার হোটেল থেকে আয়া সোফিয়া বেশ দূরে। ট্যাক্সি ছাড়া মেট্রোরেল বা বাসের যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল না। তারপরও মন পড়ে ছিল আয়া সোফিয়ার সঙ্গেই।
বড় ভাই ইস্তাম্বুলে আসার পর সিদ্ধান্ত নিই আয়া সোফিয়া দেখতে যাব। বড় ভাইয়েরও খুব ইচ্ছা যাওয়ার। পরের দিন সকালে উঠতে বেশ দেরি হয়। অ্যাপার্টমেন্টের পাশে লাজ দ্রুম রেস্টুরেন্ট। সেখানে গেলাম সকালের নাশতা করতে। দোকানি আমাদের বয়সী হাসান। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে চালিয়ে নেওয়া যায়।
দুজনের নাশতা অর্ডার করলাম। কিছুক্ষণ পর অনেক খাবার নিয়ে হাজির হাসান। এত্ত ধরনের খাবার দেখে আমরা অবাক হলাম। তবে খাবার খুবই স্বাস্থ্যসম্মত।
খেয়ে দুই ভাই ট্যাক্সি ঠিক করি আয়া সোফিয়ার উদ্দেশে। আমার খুব শিহরণ লাগছিল। আয়া সোফিয়াকে দেখার অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে অবশেষে। নিজের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছিল।
ট্যাক্সি এসে থামল সুলতান আহমেদ স্কয়ার, এ জায়গাটা প্রাচীনকালে হিপ্পোড্রোম হিসেবে পরিচিত ছিল, এটা এখন ইউনেসকোর তালিকাতে সুলতান আহমেত আর্কিওলজিক্যাল পার্ক হিসেবে পরিচিত। তুর্কিরা এ জায়গাকে সুলতান আহমেত মেয়দানি বলে। এখানেই আছে আয়া সোফিয়া, ব্লু মসজিদ ও তোপকাপি প্যালেস। মানে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সবকিছুই এখানে। এখানে শুরুতেই আছে হিপ্পোড্রম মানে বড় বড় মনুমেন্ট। অনেক আগের দিনের। শুরুতে যেটি আছে তা বাইজেন্টাইন সময়ের। কিছু দূর হাঁটলেই চোখে পড়ে আয়া সোফিয়া। মিনারগুলো জৌলুশের সঙ্গে আকাশে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখেই বোঝা যায় আয়া সোফিয়া। এটি দেখে আমি খুব আপ্লুত হয়ে পড়ি। এর পাশেই তুরস্কের আরেক ঐতিহ্য ব্লু মসজিদ। দূর থেকে এর মিনারের নীলাভ আভা চোখে পড়ে।
বড় ভাই বললেন আগে আয়া সোফিয়া দেখে আসি। তারও মনে হয় তর সইছিল না। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি জোহরের নামাজের বেশি সময় নেই। তাই ভাইকে বলি আয়া সোফিয়াতে জোহরের জামাতে নামাজ পড়ব। আগে ব্লু মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ি। পরে আয়া সোফিয়ায় যাব।
আয়া সোফিয়ার সামনে নীল পানির ফোয়ারা। ফোয়ারার পাশে বসে আয়া সোফিয়াকে দেখতে অসাধারণ লাগে। ফোয়ারার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি। আয়া সোফিয়ার সৌন্দর্য ছবির ফ্রেমে বন্দী করি। পরে ব্লু মসজিদের দিকে হাঁটা দিই। ব্লু মসজিদ উসমানীয় সাম্রাজ্যের সেরা স্থাপত্য। অটোম্যান সাম্রাজ্যের ১৪তম সুলতান, প্রথম সুলতান আহমেদ এ মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন এবং বিখ্যাত তুর্কি স্থপতি মোহাম্মদ আগার তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৬০৯ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং সাত বছর ধরে এই মসজিদ নির্মাণকাজ চলে অবশেষে ১৬১৬ সালে নির্মাণ শেষ হয়। অসাধারণ কারুকাজ এ মসজিদের। বাইরের গেট দিয়ে ঢুকেই ভেতরে বিশাল চত্বর। তার পরেই মসজিদ।
এটি ছয় মিনারবিশিষ্ট তুরস্কের একমাত্র মসজিদ। এর মিনার ও গম্বুজগুলো সিসা দ্বারা ঢেকে দেওয়া হয়েছে এবং মিনারের ওপরে সোনার প্রলেপযুক্ত তামার তৈরি ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মসজিদটি নীল, সবুজ ও সাদা মার্বেলে তৈরি। আমরা মসজিদের চত্বর পার হয়ে হাতের ডান পাশ দিয়ে অজুখানায় গিয়ে অজু করি। পরে আবার মসজিদে চলে আসি।
মসজিদের ভেতরটা স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয়। লাল কার্পেট বিছানো। অনেক জানালা আছে, এ জানালাগুলোতে রঙিন কাচ লাগানো। নাম নীল মসজিদ হলেও এটা নীল রঙের না, অনেক নীল টাইলস দিয়ে ভেতরের দেয়াল, গম্বুজ এবং পিলারগুলো মোড়ানো। এ নীল রং থেকেই লোকমুখে এ মসজিদের নাম নীল মসজিদ। ঝাড়বাতি এবং অসংখ্য বাতির আলোতে মসজিদের ভেতর আলোকিত। দেয়াল পিলার এবং গ্যালারিগুলো আরবি ক্যালিগ্রাফিতে পবিত্র কোরআনের আয়াত লেখা আছে।
মসজিদে ঢুকে খুব আপ্লুত হয়ে পড়ি। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ি। নামাজের পর বসে থাকি কিছুক্ষণ।
বের হতে মনে চাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে যেতে থাকি আয়া সোফিয়ার দিকে। আয়া সোফিয়ার প্রবেশপথে পুলিশের প্রহরা। নামাজের সময় মেয়েদের প্রবেশ বন্ধ থাকে। মেয়েরা আয়া সোফিয়াতে ঢুকতে হলে স্কার্ফ জড়াতে হয়। পা খোলা থাকলে লেগিংস পরতে হয়। এগুলোর ব্যবস্থা মসজিদেই থাকে।
প্রবেশপথেই জোহরের নামাজের আজান হলো। অসাধারণ অনুভূতি হচ্ছিল। কত দিনের ইচ্ছা ছিল। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম।
বিশাল দরজা পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই দেখি লম্বা করিডর। এর পরেই আবার লম্বা লম্বা বিশাল আকৃতির দরজা। এরপরই মসজিদ। প্রবেশ করতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কতশত স্মৃতি এ আয়া সোফিয়াকে ঘিরে। পেস্ট কালারের কার্পেট দিয়ে মসজিদের ফ্লোর ঢাকা।
গ্রিক পুরাণে সোফিয়া হচ্ছেন জ্ঞানের দেবী। গ্রিক শব্দ আয়া সোফিয়াকে অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘হলি উইজডম’ বা পবিত্র জ্ঞান। বাইজেন্টাইন শাসক প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসন আমলে ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে আয়া সোফিয়ার নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ৫ বছর ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দের পর এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। সে সময় এটি ছিল এ পৃথিবীর বৃহত্তম স্থাপনা। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় চার্চ হিসেবে আয়া সোফিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে এর আগে একই স্থানে আরও দুটি চার্চ নির্মিত হয়েছিল। প্রথম চার্চটি নির্মিত হয় আনুমানিক ৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটিনোসের শাসনামলে কিন্তু কিছু মতবিরোধের জের ধরে ৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে এক দাঙ্গার জেরে চার্চটিকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আনুমানিক ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন সম্রাট থিয়োডোসিস চার্চটির পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু জাস্টিনিয়ানের ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছর পর এক দাঙ্গায় আবার এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জাস্টিনিয়ান আয়া সোফিয়াকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বৃহত্তম ক্যাথেড্রাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রায় ৯০০ বছর আয়া সোফিয়া ছিলও পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানিটির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এ ছাড়া বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজাদের অভিষেক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানের কাজেও আয়া সোফিয়া ব্যবহার করা হতো। বাইজেন্টাইন রাজাদের রাজমুকুট এখানে সংরক্ষিত ছিলও। যে স্থানে রাজাদের অভিষেক হতো, সেটি এখনো অবিকৃত আছে।
চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা অভিযান চালিয়ে কনসটান্টিনোপল দখল করে নেন। তাঁরা আয়া সোফিয়াকে ক্যাথলিক চার্চে রূপান্তর করেন। ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কনসটান্টিনোপল জয় করেন। এ জন্য তাঁকে বলা হয় সুলতান ফাতেহ মুহাম্মদ।
কনসটান্টিনোপলের নাম পরিবর্তন করে শহরটির নাম তিনি দেন ইস্তাম্বুল। চিরকালের মতো অবসান হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের। বিজয়ী সুলতান ফাতেহ মুহাম্মদ আয়া সোফিয়াতে প্রবেশ করেন এবং আয়া সোফিয়াকে তিনি সংস্কার করে মসজিদে রূপান্তর করার নির্দেশ দেন। অটোমান স্থপতিরা আয়া সোফিয়ার ভেতরের অর্থোডক্স খ্রিষ্টানিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব চিহ্ন সরিয়ে ফেলেন কিংবা একধরনের কালো কাপড় দ্বারা ঢেকে দেন। ভবনের বাইরের অংশে যোগ করা হয় উঁচু মিনার। সুলতান ফাতেহ মুহাম্মদ এ ভবনের ভেতর জুমার নামাজের আয়োজন করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মোস্তফা কামাল আতার্তুক তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মনোনীত হন। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন এবং তুরস্ককে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। মোস্তফা কামাল ছিলেন সেক্যুলার মতাদর্শের একজন রাজনীতিবিদ। তিনি আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন এবং আয়া সোফিয়াতে নামাজসহ সব ধরনের ধর্মীয় আচারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর ২০২০ সালে এরদোয়ান এটিকে আবার মসজিদে পরিণত করেন। এর পর থেকে দিন দিন মুসলিম পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর দেড়-দুই কোটি মানুষ আয়া সোফিয়াতে যান। ইন্দোনেশিয়ার মানুষের সংখ্যাই বেশি।
মসজিদে ঢুকে নফল নামাজ পড়লাম। ইমামের সঙ্গে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। ইমাম নামাজের পর তিলাওয়াত করেন। ইস্তাম্বুলের সব ইমামের কণ্ঠ সুমধুর।
নামাজ পড়ার পর আয়া সোফিয়ার ছবি তুলি। কত বিশাল ভবন। কী জ্যামিতিক জ্ঞানই না ছিল আগের মানুষের। আমরা নাকি সভ্যতার, বিজ্ঞানের চরম শিখরে তাহলে ওরা এত সূক্ষ্মভাবে বানাল কীভাবে।
মসজিদের দুই পাশে ব্যালকনির মতো। এখান থেকে মেয়েরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজাদের অভিষেক অনুষ্ঠান দেখতেন। পরবর্তীকালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অনুষ্ঠানে এখান থেকে মেয়েরা যোগ দিতেন।
আয়া সোফিয়া থেকে বের হতেই মন চাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ ফ্লোরে শুয়ে আয়া সোফিয়ার ওপরের সৌন্দর্য দেখি। খ্রিষ্টানদের সময়ের ছবিগুলো ঢেকে দিয়েছিলেন সুলতান ফাতেহ মুহাম্মদ। এখনো ঢাকা আছে।
এখন শুধু ছাদে একটি ছবিই দেখা যায়। পুরো মসজিদ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খালি সেই প্রতাপশালী রাজদের কথা মনে পড়ছিল। দোয়া করি ইস্তাম্বুল জয়ী সেই মহান সন্তান সুলতান ফাতেহ মুহাম্মদের জন্য, যাঁর কথা হজরত মুহাম্মদ (সা.) হাদিসে বলেছেন। এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। এখনো তো তোপকাপি দেখা বাকি। চলবে...
* লেখক: হুমায়ুন কবীর হিমু, সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস, আগারগাঁও, ঢাকা
* দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]