শারদ অপরাহ্ণে
‘দস্যু বনহুর’ বইটা বুকের ওপর নিয়েই তন্দ্রামতন এসেছে। কখন বই পড়তে পড়তে ওনার চোখ লেগে এসেছিল, টের পাননি। বাইরের আঙিনার স্টিলের দরজায় কেউ ধাম ধাম করে বাড়ি দিচ্ছে। উনি ভাবলেন, এত রাতে আবার কে এল? ডাকাত নাকি?
শরতের সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। শরতের সন্ধ্যাবেলায় অপরূপ মেঘমালা গোধূলি আলোর সঙ্গে মিশে এক অসাধারণ চিত্র এঁকেছিল। উনি আকাশের দিকে চেয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তার প্রশংসায়। এখন বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার। ঝিঁঝি পোকার শব্দ ছাড়া তেমন কিছুই কর্ণগোচর হয় না।
মফস্সলে হুট করেই রাত্রি নামে। পাবনা শহরে রাস্তায় তখন বৈদুতিক আলোর সুবিধা ছিল না। বড় রাস্তায় আলো থাকলেও এই বাড়ির সামনে বৈদ্যুতিক খুঁটি তখন আসেনি।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছেন, ওনার স্ত্রী বললেন, ‘নকশালদের উপদ্রব আছে। সাবধানে যাবেন।’
সৌম্যদর্শন মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোক এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বললেন, ‘এই কে রে? ডাকাত পড়ছে নাকি? এত রাতে দরজা ভেঙে ফেলবি?’
ওনার স্ত্রী বাইরের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। এত রাতে একা ছেড়ে দেননি।
দরজার ওপাশের মানুষ তখন হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিল, ‘কাকা, সর্বনাশ হয়ে গেসে। দাঙ্গা লাইগে গেসে কাকা।’
‘বলিস কী তুই সুবল?’
‘হ্যাঁ কাকা। অনেকে অস্ত্র নিয়ে বাইর হইছে। এই পাড়ার হিন্দুরা ভয়ে দরজা লাগায়ে লুকায়ে আছে। কোথায় লুকোবে, বুঝতে পারতিছে না। নিরুপায় হয়েই আপনার কাছে আসলাম কাকা। আপনি নিশ্চয় একটা উপায় বাতলে দেবেন।’
‘আচ্ছা, আমি দেখিতিছি কী করা যায়।’
তখন মুঠোফোন তো দূরের কথা, টেলিফোন ছিল না কারও বাড়িতে। উনি দ্রুত ভাবছেন কী করা যায়।
ওনার স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, ‘ওদের বাড়ির পেছনে লুকায়ে রাখা যায়। কী বলো?’
‘হ্যাঁ। আপনার দোনলা বন্দুকটা বের করেন।’
‘হ্যাঁ। দাঁড়াও, আমি সুবলরে কই বাকি সবাইকে নিয়ে আসতে যাক।’
সুবল অদূরেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল।
‘শোন। সবাইকে বল আমার এখানে চলে আসতে। আমি এখানে থাকতে কারও কোনো ক্ষতি হবে না।’
‘আপনার আরেকটা বন্দুক থাকলি খুব ভালো হতো।’
‘ক্যান?’
‘আমিও তো চালাতে পারি। এক কাজ করি শোনেন, মেয়েদের পুরোনো রান্নাঘরের কাছে লুকাতে বলব। আর আপনি সামনের বারান্দায় বসবেন। সঙ্গে গফুরকে নিয়ে বসেন। আর পুরুষ মানুষদের বৈঠকখানায় বসতে বলেন।’
‘হ্যাঁ। তুমিও তো চালাতে পারো। আসলে লাইসেন্স তো একটারই আছে। আচ্ছা, সেদিন তুমি যে বললে বাড়ির ছাদে হনুমান উঠেছিল, তুমি ঠিক দেখেছিলে?’
‘বলতে পারিনে। রাতের বেলায় খুব শব্দ হচ্ছিল। আমি বানর বা হনুমান ভেবেই ফাঁকা গুলি চালিয়েছিলাম।’
‘অস্ত্র খুব খারাপ জিনিস। তোমাকে বলা হয় নাই, আমি পাখি শিকার বাদ দিয়ে দেব বলে ঠিক করেছি। সেদিন পাখি শিকারে গেছি। পানির কাছে অনেক পাখি দেখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। আমার মাথায় একটা অদ্ভুত খেয়াল আসল। এই যে নিজেদের বাড়ি ফিরছে, ওদের সন্তানেরা নিশ্চয় মায়ের অপেক্ষায় আছে। অথচ দেখো, আমি বন্দুকের এক গুলিতে সব শেষ করে দিলাম। পাখির বাচ্চাগুলো হয়তো না খেয়ে অপেক্ষা করছে। অবলা বোবা প্রাণীর কষ্ট তো মানুষ হয়ে বুঝি না।’
‘তা ঠিক আছে। নিরীহ পাখি না মেরে খেলেও চলবে। তবে কি জানেন? খারাপ মানুষের ভয়েই রাখতে হয়।’
‘এখানে তোমার ট্রিগারের আঙুলে মুহূর্তের মধ্যে অন্য আরেকজনের প্রাণ নিয়ে নিল। আমরা যা সৃষ্টি করতে পারি না, তা ধ্বংসের অধিকার কি আমাদের আছে?’
ওনার স্ত্রী কথা বন্ধ করে হারিকেন ধরাতে ব্যস্ত হলেন। আলো জ্বালতে হবে বাড়িতে। হারিকেনের আলোতে ওনার শ্যামলা বরন মুখ ভারী মায়াময় দেখায়। নাকে নাকফুল চিকচিক করে।
‘এই ব্রিটিশরাজ অনেক ঝামেলা করে দিয়ে গেছে। এই হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা কিন্তু ওরাই শুরু করে দিছে।’
‘নিজেরা ঠিক না থাকলে বাইরের লোকে তো সুযোগ নেবেই। ধর্মের নাম দিয়ে এসব চলে বলেন?’
ওনাদের কথার মাঝেই আবার দরজায় শব্দ হলো। প্রায় ১৫ জনের একটা বড় দল আশ্রয় নিতে বাড়িতে এসেছে। নারী-পুরুষ দুই দল ভাগ হয়ে গেল।
ভদ্রলোক বললেন, ‘মা জননীরা, আপনারা আমার বউয়ের সঙ্গে বাড়ির পেছন দিকে যাবেন। কোনো ভয় নেই। রান্নাঘরের পেছনে আপনাদের কেউ দেখবে না। বেশি বিপদ দেখলে বাড়ির পেছনে আরেকটা রাস্তা আছে। সেদিক দিয়ে বের হওয়ার পথ আছে।’
মেয়েরা বাড়ির পেছনে চলে গেলেন। টিমটিম করে একটা হারিকেন জ্বলছে। রান্নাঘরে চুপ করে বসে আছেন সবাই। শরৎকালে রাত বাড়লে একটু হিম পড়ে।
ঘণ্টাখানেক পরই আবার দুমদাম শব্দ দরজায়। পুরুষেরা নড়েচড়ে বসলেন। ভদ্রলোক ওনার উইনস্টন কোম্পানির বন্দুক নিয়ে বের হলেন।
‘কে ধাক্কা দেয় এত রাতে দরজায়?’
‘কাকা, আপনার বাড়িতে কেউ আছে নাকি?’
‘মানে বুঝলাম না। খোলাসা করে বল।’
লাইসেন্স করা অস্ত্রের আসলেও ক্ষমতা থাকে।
‘না মানে। কিছু শোনেননি আপনি? আসলে হিন্দুপাড়ার কিছু মানুষ নাকি...
‘শোন। হিন্দু-মুসলমান জানি না, তবে মানুষের গলার শব্দ আমিও শুনছি। এ জন্য দরজা দিয়ে বন্দুক বের করে বসে আছি। আর কিছু বলবি? রাত অনেক হয়েছে। বাড়িতে যা।’
উনি ঘরে ঢুকে ইশারা দিলেন। বিপদ কেটে গেছে। পাঁচিল টপকে এই অন্ধকারে বাড়িতে কেউ আর ঢুকবে না।
রান্নাঘরে মেয়েরা এতক্ষণ দম বন্ধ করে চুপ করেছিল। একটা বাচ্চা মেয়ে তার মাকে বলল, ‘এই বাড়ির কর্তা মা কী সুন্দর গো মা? কপালে সিঁদুর পরেন না কেন?
‘আমাকে তুমি খালা ডাকবা’, বলে হেসে ফেললেন উনি। হেসে মেয়েটার গালে আদর দিলেন।
একটু পরে ফজরের আজান দিল। ওনার স্ত্রী জায়নামাজ নিয়ে বসলেন। বাকি সবাই তখন ঝিমাচ্ছে।
আঁধার কেটে নতুন সূর্য উঠল। সেই আলোতে বোধ হয় ধর্মবর্ণের ভেদাভেদ বাদ দিয়ে মানুষ পরিষ্কার দেখতে পেল। আশ্রয় প্রার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে ফেরত গেলেন।
পুনশ্চ
এ গল্প সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা। গল্পের পাত্র-পাত্রীর নাম ইচ্ছা করেই লিখিনি। তবে ভদ্রলোক আমার মায়ের নানা আর ওনার স্ত্রী আমার মায়ের নানি। এই গল্প আমার নানুর মুখে শোনা। এই গল্প শুনে আমি একটা ব্যাপার ছোটবেলাতে শিখেছিলাম, ধর্ম, বর্ণ আর পোশাকের আড়ালে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সবাই আমাদের মতো মানুষ। ওনার স্ত্রী আসলেই বন্দুক চালাতে পারতেন। পুরোনো দিনের নায়িকাদের মতো একটা ছবিও দেখেছি আমরা। আমরা ছোটরা ওনাকে মা ডাকতাম। আমার মায়ের নানাকে আমরা আপন দাদা ডাকতাম। আমাদের বুদ্ধি হওয়ার আগেই উনি গত হয়েছিলেন।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]