বুনো অর্কিড আর লিলিথের গল্প-৩

প্রিয়ম ওর কালো পাঞ্জাবির গলার কাছটা ঠিক করল। আয়নায় সুখী দম্পতির চেহারা দেখা যাচ্ছে। অণিমা আয়নার প্রিয়মকে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী দেখছে? প্রিয়ম নিরুত্তর; একটু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে সরে গেল।

বসার ঘরে গমগম করছে লোকজন। অণিমার ভালোই লাগছে আসরের মধ্যমণি হয়ে সবার সঙ্গে গল্প করতে। প্রিয়ম নিজেও মিশুক।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে অণিমা একটা জরুরি ফোন সারছিল। অণিমার মনে যখন বিরক্তি উঁকি দিয়েছে, তক্ষুনি মারজুক কলবেল দিল। প্রিয়ম দরজা খুলেছে। অণিমা অবশ্য মনে মনে অপেক্ষা করছে মারজুকের। ছেলেটার সময়জ্ঞান একেবারেই নেই দেখি। নিজেরাই পরিচিত হয়ে নিল। প্রিয়ম মারজুকের হাত থেকে অর্কিডটা নিল। মারজুক অণিমার খোঁজ করতেই বারান্দার দিকে ইশারা করল প্রিয়ম।

অণিমার কথা শেষ হয়েছে তক্ষুনি ঘুরে দেখল মারজুককে। হাসিমুখে বলল, ‘দুঃখিত, দেরি করে ফেললাম। আপনার জন্য একটা বেগুনি রঙের অর্কিড কিনতে গিয়ে দেরি হলো।’

মারজুকের কথায় অণিমা হাসল। ওর বাঁ গালে টোল পড়ল। ওর গজদাঁতের মিষ্টি হাসি যেন সন্ধ্যার আকাশের অনুষঙ্গ।
‘শুধু শুধু কষ্ট করলেন। ধন্যবাদ।’
‘আপনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজকে।’
‘ধন্যবাদ।’
মারজুক অণিমার মরা গাছের গুঁড়ির ওপর অর্কিডটা দেখে বলল, ‘এটা কি আপনার করা? হুট করে দেখে মনে হচ্ছে গাছটার মধ্যেই অর্কিড হয়েছে। সুন্দর করে টবটা আড়াল করে রাখা।’

অণিমা একটু চমকাল। হেসে ফেলল, ‘সৌন্দর্য দেখার চোখ থাকতে হয়, বুঝলেন?’
‘আপনি কি সব সময় কমপ্লিমেন্ট পেলে এ রকম অস্বস্তিতে ভোগেন?’
অণিমা হেসে ফেলল আবারও।
‘চলুন, ভেতরে বসবেন। সন্ধ্যার পর এখানে মশার উৎপাতে টিকতে পারবেন না।’
অণিমা একটু তাড়া দিল। ডিনার সার্ভ করবে। যদিও সব খাবার কেটার করানো; তবু অণিমা অতিথিদের তুলে খাওয়াতে ভালোবাসে।

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

ডাইনিং টেবিলে সবার জায়গা হলো না। ওখানে বসল প্রিয়মের অফিসের লোকজন। জুলি মেয়েটাকেও চোখে পড়ল অণিমার। হালকা কুশলবিনিময় করে সরে এল। প্রিয়ম আর মারজুকের জায়গা হলো ওপেন কনসেপ্ট রান্নাঘরের লাগোয়া ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জায়গায়।

অণিমা দাঁড়িয়ে দুজনকেই খাবার পরিবেশন করছে।

মারজুক চুপচাপ খাচ্ছে। রান্নার প্রশংসা করতে অণিমা হাসি দিয়ে বলল, ওগুলো বাইরে থেকে বানানো।
প্রিয়ম অণিমাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘ওর রান্না অসম্ভব মজা। আপনি যা খাচ্ছেন, তা ওর রান্নার ধারেকাছেও নয়।’
মারজুক বলল, ‘আবার তো একদিন আসতেই হচ্ছে।’
‘নিশ্চয় আসবেন আবার। আজকে তো প্রথম পরিচয় হলো।’

আরও পড়ুন

খাওয়ার পর্ব শেষে অণিমা প্রিয়মের বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করল। যে জমাট নিস্তব্ধতা বাড়ির হাওয়ায় মিশে থাকে, তা সবার হাসি-গল্পে যেন জানালা দিয়ে পালাচ্ছে। ভালোই লাগছে অণিমার।

জুলিকে চোখে পড়ল না। একটু পরে অণিমা দেখে, জুলি মারজুকের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে। প্রিয়ম বোধ হয় খাওয়ার পরের সিগারেট খাচ্ছে ওখানে দাঁড়িয়ে। অণিমা যোগ দিল ওদের সঙ্গে। জুলি গল্প করছে মারজুকের সঙ্গে। অণিমা চুপ করে আছে। মারজুকের চোখ ঘুরে ঘুরে অণিমার মুখের ওপর নিবদ্ধ। অণিমা একটু অস্বস্তিতে পড়ল। যদিও ব্যাপারটা নির্দোষ, তবু ওর প্রিয়মের সামনে অস্বস্তি হচ্ছে।

প্রিয়ম যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিছু বলবে না। পেটের ভেতরে কথা রেখে দেবে। পরে তর্কের সময় ঠিক টেনে আনবে। প্রিয়মের একটা অদ্ভুত বাজে অভ্যাস আছে। ঝগড়ার সময় পুরোনো কথা তুলবে। দেখা গেল, কবে কোথায় অণিমা ঝগড়া করেছিল, দিব্যি ভুলে বসে আছে। প্রিয়ম ঠিক মনে করে রাখবে। শব্দগুলো অস্ত্র হিসেবে পরে প্রয়োগ করবে।
অণিমা যেমন ভেবেছিল, তেমন কিছুই হলো না। বুদ্ধিমান পুরুষ ঠিক তার প্রতিদ্বন্দ্বী চিনে নেয়। অণিমা ভেবেছিল, প্রিয়ম বোধ হয় ওকে মারজুককে নিয়ে প্রশ্ন করবে। তেমন কিছু তো করল না; বরং নিয়মের বাইরে একটু বেশি ভালোবাসাবাসি হলো সেদিন। ঠিক দিন ধরে ঘড়ি দেখে ওভুলেশনের সময় মেনে নয়; উদ্দেশ্যবিহীন প্রেমের প্রকাশ।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অণিমা ইচ্ছা করেই তারপর বেশ কয়েক দিন মারজুকের মেসেজগুলোর উত্তর দিল ছাড়া ছাড়াভাবে। অন্যের চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখতে সবার ভালো লাগে। সে পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর এগোনোর সাহস অণিমার নেই। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। সবচেয়ে বড় কথা, ওদের পরিচয় হয়েছে আর্ট গ্যালারিতেই। প্রফেশনাল সম্পর্কে ব্যক্তিগত কিছু থাকতে নেই। এমন যদি হয়, ওর কারণে মারজুক আর্ট গ্যালারিতে আসা বন্ধ করে দেয়, এ নিয়ে কথা হবে।

আরও পড়ুন

মারজুক আবার দিন সাতেক পর হাজির অণিমার গ্যালারিতে। এবারে দৃষ্টি যেন একটু উদ্‌ভ্রান্ত। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে বেশ রোগা দেখাচ্ছে। অণিমা এই দৃষ্টি চেনে। আগেও ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অনুরাগীদের চোখে এমন দৃষ্টি দেখেছে।
মারজুক কথাপ্রসঙ্গে ভণিতা না করেই বলল, ‘আই থিংক আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ।’

অণিমা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার ভুল হচ্ছে। ইউ লাইক দ্য আইডিয়া অব মি। প্রতিদিন যার সঙ্গে মানুষ থাকে, তার রূপ দেখলে এমন প্রেম জানালা দিয়ে পালাবে।’

‘আমি কি টিনএজার? আর বিনিময়ে কিছু কি চেয়েছি বলুন? আমার কথাটা জানানোর ছিল আপনাকে। এতটুকুই ব্যাপার। আসি আমি।’

মারজুক আর কখনো আসেনি ওর গ্যালারিতে। একটা ফোনও আসেনি। অণিমা ভেবেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওর মোহ কেটে যাবে।

একদিন মনীষা ফোন করতেই অণিমা বলল, ‘তোর ধারণা ভুল। অল্পবয়সী ছেলেরাও ফালতু প্রেম করতে আসে। বিবাহিতদের সঙ্গে তো দায়িত্বের ব্যাপার থাকে না।’
‘কী যে বলিস না? হতেই পারে বেচারার ভালোবাসা হয়েছে। তুই তো পছন্দ করার মতো মানুষ।’
‘তো, আমাকে কী করতে বলিস? প্রেম করে ফেলব?’
‘আমি এটা কখন বললাম? শুধু বললাম অন্যের অনুভূতির দাম দিতে জানতে হয়।’
মাসখানেক পর।

অণিমা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে প্রিয়মের। ডাক্তারের অফিসে গিয়েছিল। প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট এসেছে পজিটিভ। ফোনে জানাতে চাচ্ছে না। ওর মনে হচ্ছে বিশ্রী যে মন খারাপের গুমোট মেঘটা ওদের বাড়িতে জানালা দিয়ে ঢুকে পাকাপাকি আস্তানা গেড়েছিল, সেটা পাকাপাকিভাবে বিদায় নেবে নতুন প্রাণের আগমনে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বেল বাজল। দরজায় ডেলিভারি ম্যান। অণিমার কাছে বড় একটা বাক্স আর একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে গেল। বাক্স খুলে অবাক হলো অণিমা। লেডি লিলিথ ছবির অনুরূপ একটা ছবি। মুখটা অবশ্য অণিমার। পেছনে ফুলগুলোর জায়গায় বুনো অর্কিড। সঙ্গে একটা চিঠি।

বুনো অর্কিডের সৌন্দর্য নিয়ে নয়
লিলিথের প্রস্থানের মতন নয়,
এর পরের বার গাঙচিল হয়ে এসো
আমি তোমার জন্য আকাশ হব।
দিনের প্রথম প্রহরে নয়,
শেষ প্রহরের অন্ধকারে নয়
গোধূলিবেলায় এসো;
কন্যাসুন্দরী আলোয় তোমার রূপ দেখে
হিংসায় জ্বলবে স্বর্গের অপ্সরাগণ। (শেষ)

*লেখক: ফারহানা সিনথিয়া, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ক্যালগারি, কানাডা