পিঙ্ক শার্ট ডে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আমার পিঙ্ক শার্টটা দেখেছো? জলদি খুঁজে দাও। বের হতে দেরি করলে আবার ট্রাফিক জ্যামে পরতে হবে,’ রাহাত কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে অনুরোধ করল। রাফাও তাড়াহুড়া করেই বের হচ্ছে। ওর পরনেও গোলাপি শার্ট। আজকে পিঙ্ক শার্ট ডে। ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে কানাডাতে এদিনে এন্টি বুলিয়িংয়ে সচেতনতা বাড়াতে আলাদা করে বলা হয় পিঙ্ক শার্ট ডে।

রাফা আর রাহাতের একমাত্র সন্তান রিয়াদ এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। ও বলল, ওর নাকি দেরি হয়ে যাবে, তাই ও একাই স্কুলবাসের স্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে যাবে।

স্কুলে পড়া শিশুরা যেন একজন আরেক জনকে ঠাট্টার ছলে ধর্ম, বর্ণ, আকার বা অন্য যেকোনোভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা না করে, সে জন্যই এই দিবসের অবতারণা। এদিনে সবাই গোলাপি রঙের জামা পরে।

রাহাত তৈরি হয়ে এসে বলল, ‘উন্নত দেশে আছি বলেই এসব দিবস সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি।’

রাফা বলল, ‘একদম ঠিক। বাংলাদেশে কি আর এসব জানতে পারতাম।’

দুজনের ব্যস্ততার অন্ত নেই। কানাডার ক্যালগারি শহরের অদূরে এক শহরতলিতে তাদের বাড়ি। ফেসবুকের সেলফি আর ঘোরাঘুরির ছবি বাদ দিলে চিত্র অন্য রকম। সপ্তাহের প্রতিটি মিনিট হিসাব করে খরচ করে তারা দুজন। সবচেয়ে দামি হচ্ছে সময়। ভোরে অফিসের উদ্দেশে বের হয় দুজনে। সারা সপ্তাহ অফিসের কাজ। কখনো সপ্তাহান্তে বন্ধুদের বাড়িতে বাঙালি খাবার আর আড্ডার আয়োজন থাকে।

তাদের ছেলে রিয়াদেরও ব্যস্ত রুটিন। প্রতিদিন স্কুল। তারপরে কুমন নামের একটা প্রোগ্রামে যায় অঙ্ক শিখতে। শনিবার যায় সাঁতারের ক্লাসে। আর রোববারে থাকে কারাতে ক্লাস।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদেশের জীবনের যা ছবি সবাই দেখে, তা আসলে খণ্ডচিত্র। বাড়ির সামনে বরফ পরিষ্কার। প্রতিদিনের ঘরের কাজ। অসুস্থ হলে খোঁজ নেওয়ার কেউ থাকে না। ফেসবুকের নীল–সাদা আসলেই মরীচিকা।

বিকেল পাঁচটার সময় রিয়াদ বাড়ি ফেরে। আধঘণ্টা পরই ওর কুমন ক্লাসের সময় হয়। যেহেতু দুই ধরনের কালচারে সে বড় হচ্ছে, বয়োসন্ধির পাশাপাশি এ–ও এক অদ্ভুত পরিবর্তন। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ছেলের এ দেশের আলো–হাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হয়।

তবে সে চেষ্টা করে এখানকার ছেলেমেয়েদের মতো করে ইংরেজি বলতে।

রাফা আজকে বাড়ি ফিরে দেখে, ছেলে তখন কুমন ক্লাস থেকে ফেরেনি। তার জন্য ম্যাগি নুডলস বানিয়ে রাখল। আর কাপড় ভাঁজ করতে শুরু করল। আধঘণ্টা বাদেই বাড়ি ফিরবে রিয়াদ। ওর ঘরটা একটু পরিপাটি করা যাক, ভাবল রাফা। রাফা বিছানা ওল্টাতেই তার তলায় শক্ত কিছুতে হাত আটকাল।

বিছানার চাদরের তলায় এত শক্ত কী, ভেবে পেল না সে। ম্যাট্রেসের ওপরই একটা ডায়েরি মতো রাখা। দোনোমোনো করে পড়তে শুরু করল রাফা। এত লুকোচুরি কিসের। ডায়েরিটা এভাবে খাটের কাছে লুকিয়ে রাখা কেন?

সেখানে পিঙ্ক শার্ট ডে শিরোনাম দিয়ে একটা এন্ট্রি লিখেছে ওর জার্নালে রিয়াদ, মা–বাবা দুজনেই আজকে গোলাপি জামা পরে বাইরে গেছে। কয়েক দিন আগেই বাবা সাফিন আঙ্কেলকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন অন্যদের কাছে। সাফিন আঙ্কেলের নাকি মানসিক রোগ আছে। বউ নাকি তাকে বাইরের কারও সঙ্গে মিশতে দেন না—এমন অনেক হাবিজাবি কথা। মানসিক রোগ নিয়ে হাসাহাসি করা যে বুলিং করা, এটা বাবা বোঝেন না। সাফিন আঙ্কেলকে মুখের ওপর যখন বলেন, তুমি তো খোরমা খেজুর খাইয়ে বউ এনেছো, ব্রাদার। আমার মতো সাত দিনের অনুষ্ঠান করে তো ঘরে বউ তোলোনি। এটাকেও বুলিং করা বলে। এসব আচরণের জন্যই সাফিন আঙ্কেল বাবাকে অ্যাভোয়েড করেন।

তা ছাড়া তার ঢাকার বাড়ি–গাড়ির গল্প নিয়ে একটা আলগা অহংকার বাবার চোখে–মুখে ফুটে থাকে। মায়ের গয়নার জন্য কত টাকা জাকাত দিয়েছেন বাবা, শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন সাফিন আঙ্কেলের সামনে। উদ্দেশ্য, তাকে একটা ধারণা দেওয়া, মায়ের কত ভরি গয়না আছে। দিনা আন্টি কখনো গয়নার গল্প করেন না।

মায়েরও একই রকম অভ্যাস আছে। কোনো এক আন্টি সুতি শাড়ি পরে দাওয়াতে আসেন। তাকে চিপ বলে হাসাহাসি করছিলেন মা। আমার খুব বিশ্রি লেগেছিল। আমার মায়ের হাসি ভারী সুন্দর। তবে সেদিন কদর্য মনে হচ্ছিল। ফেসবুকের কোনো এক দাওয়াতের পোস্টে বাবা আর মা বিশ্রিভাবে অন্য এক ফ্যামিলিকে ইঙ্গিত করে হাসাহাসি করছিলেন। দুজনেই আমার ফেসবুকে আছে। আমি খুব ভালো করেই জানি, যে পরিবারকে ইঙ্গিত করে তারা হাসছিলেন, তারাও মন্তব্যগুলো পড়েছিলেন। আমার লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছিল। এসব কেউ করে?

আজকে দুজনেই পিঙ্ক শার্ট পরে অফিসে গেছে। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা মনে হয়েছে, ব্যাপারটা ভণ্ডামি। অথবা নিজের সঙ্গে করা ছলচাতুরী।

ডায়েরিতে এতটুকুই লেখা। রাফার আর পড়তে সাহস হলো না। সে যেখানে পেয়েছে, ঠিক সেখানেই ডায়েরিটা ফেরত রেখে দিল।

সন্তানের মধ্যে নিজেদের ছায়া খোঁজেন মা–বাবা। সন্তান আর মা–বাবা যেন একে অপরের কাছে দর্পণস্বরূপ। আজকে বুঝল রাফা, সেই আয়নাতে ময়লা জমেছে। তাদের সন্তান তাদের কুৎসিত আচরণে যে ছায়া দেখছে, তাতে সে একটা ধাক্কা খেয়েছে। সন্তানের ধরা আয়নায় নিজের রূপ দেখে চমকে গেল সে। জার্নালটা লুকিয়ে রেখে সে ঠিক করল, এমন আচরণ আর কখনো করবে না।