বুনো অর্কিড আর লিলিথের গল্প-১

প্রতীকী ছবি

আকাশে উড়িছে বকপাঁতি
বেদনা আমার তারই সাথী
আকাশে উড়িছে...
বারেক তোমায় শুধাবারে চাই
বিদায়কালে কী বল নাই
সে কি রয়ে গেল গো
সিক্ত যূথীর গন্ধবেদনে, মনে
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে
একটা পুরোনো অভ্যাস আছে অণিমার। গানের মাঝখান থেকে শুরু করে। অনেক দিনের চর্চার অভাবে গলা বেশি উঁচুতে উঠতে চায় না। বারান্দার গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে অণিমা। কিছু গাছে বালতি থেকে জল ঢালা হলো। আর কিছু গাছে স্প্রে বোতলে করে পানি দিচ্ছে। যেগুলোতে নতুন ফুল এসেছে সেগুলোতে পানি দেওয়ার বেলায় অতিরিক্ত সাবধানতা। বেশি জোরে পানি ফেললে যদি পাপড়ি ছিঁড়ে যায়?
প্রিয়মের গলার আওয়াজে যেন সংবিৎ ফিরল, ‘আমার নীল শার্ট দেখেছ?’
বাড়ির কাজের সহকারীকে জিজ্ঞেস করছে। অণিমা গান বন্ধ করল না। প্রিয়মই এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিল। বিরক্তি নিয়ে অণিমা ভাবল খুঁজুক আজকে একটু। আজকে নিজে থেকে গিয়ে ও এগিয়ে দেবে না।

প্রিয়ম কখনো নিজে থেকে গান শুনতে চায়নি অণিমার কাছে। এমনিতেও অণিমা নিজের মনেই গুনগুন করে। তার শ্রোতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ যে এসে বারান্দার দরজা টেনে দিয়ে গেল তাতে অনিমার অহংয়ে একটু আঘাত লেগেছে।

প্রিয়ম কোন শার্ট খুঁজছে, অণিমা খুব ভালো করেই জানে। রয়েল ব্লু রঙের নতুন শার্টটা ও বোধ হয় ক্যাটস আই থেকে নিয়েছে। ইদানীং ওই শার্টটা প্রিয়মের জাতীয় পোশাক। সপ্তাহে দুই দিন পরে অফিসে যায়। প্রিয়মের এ অদ্ভুত একটা অভ্যাস আছে। একটা নতুন জিনিস বা কাপড় কিনলে সেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন মেতে থাকে। ধীরে ধীরে তার কদর কমে আসে। এরপরে হয়তো দেখা যাবে ওই শার্ট তার আলমারির কোনো এক কোনায় অযত্নে পড়ে আছে।

অর্কিডগুলো বোধ হয় ভেতরে নিয়ে রাখতে হবে। যদিও বারান্দার ছায়া ছায়া কোনায় রাখা তবু বেশি শুকিয়ে যাচ্ছে কি? একটা সুন্দর মরা গাছের ডালের ওপরে অর্কিডের পটটা এমনভাবে রাখা দেখলে হুট করে মনে হয় গাছের ওপরেই পরগাছার মতো হয়েছে অর্কিডের গাছ। অণিমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ওদের সম্পর্কটাও ইদানীং এমন মরা একটা ডালের ওপরে ভর দিয়ে রয়েছে; ও বেঁচে আছে ওই অর্কিডটার মতন।

অণিমার গান শেষ হলো। প্রিয়মের গলার আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। শোবার ঘরে ঢুকে বুঝল প্রিয়ম বেরিয়ে গেছে। যাক একদিন অণিমার কাছে বিদায় না নিয়ে অফিসে। আলমারি খুলে নিশ্চিত হলো অণিমা, শার্টটা খুঁজে পায়নি প্রিয়ম। অসুবিধা নেই ওর প্রিয় রেস্তোরাঁয় খাইয়ে দেবে এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে।

একটা আর্ট গ্যালারিতে কিছুদিন হলো জয়েন করেছে অণিমা। ওদের ইভেন্টগুলো কো-অর্ডিনেট করে। নিত্যনতুন শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয় অণিমার। বেতন এমন আহামরি কিছু না। তবে সময়টা ভালোই কাটে। মাস শেষে হাতে কিছু টাকা আসে, সেটাও বেশ ভালো ব্যাপার।

ব্রেকফাস্টে তেমন কিছু খায় না অণিমা। ব্ল্যাক কফি ফ্লাস্কে নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়ি পার্ক করে গিয়ে বসল ওর ডেস্কে। লাঞ্চের সময় ফোন এল ওর পুরোনো বন্ধু মনীষার। কোনো একটা বিচিত্র কারণে স্কুলের বন্ধুত্ব এখনো অটুট আছে। মনীষা ভ্যানকুভারে থাকে। প্রায় ১০ ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত কথা হয়।

মনীষা ফোনে বলল, ‘অনু একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে জানিস?’
‘লটারি জিতেছিস?’
‘বলতে পারিস লটারি। গতকাল রাত্রে আমি বিল দিতে গেছি। আসলে কালকে স্যালারি এসেছে। যা–ই হোক। দেখি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার দলের ডিপোজিট। কে পাঠিয়েছে বুঝতে পারছি না।’
‘তারপর তুই কী করলি?’ অনুর গলায় উত্তেজনা।

‘কী আবার করব? ব্যাংকে ফোন করে জানতে পারলাম কেউ একজন ডোনেশন বা চ্যারিটি করতে একটা অ্যাকাউন্টে জমা দিতে গিয়েছিল ভুল করে আমার কাছে এসেছে। ফোন করে ফেরত দিলাম।’

‘ও এই তবে কাহিনি? আমি তো ভাবলাম তোর কোনো সিক্রেট অ্যাডমায়ারার আছে।’
‘সিক্রেট অ্যাডমায়ারার না ছাই! যারা এখন প্রেম করতে আসে বেশির ভাগ হয় বুড়া ভাম। আমার স্ত্রী আমাকে বুঝতে পারে না ইত্যাদি ভংচং।’
‘তারপর তুই কী করলি?’ অনুর গলায় উত্তেজনা।
‘আহা রে। কত দুঃখ মনে।’ বলে হাসছে অণিমা।

‘ঠিকই তো বললাম,’ বলে হাসছে মনীষা, ‘ইদানীংকালের ছেলেরা আপুদের প্রেমে পড়ে না। তোর কী খবর?’
‘চলছে আগের মতোই। চল আমরা দুইজন ইজিপ্ট যাই। তুই এবার কিছুদিনের এক্সট্রা ছুটি জমিয়ে আসতে পারবি না?’
‘নাহ। তাই কি আর হয়? দুই দিকের দাওয়াত আর আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে করতেই ছুটি শেষ হয়ে যায়। তারপর রায়ান ঢাকায় এলে অসুস্থ হয় প্রতিবার। ওর বাবা বিরক্ত হয়। মনে হয় না এবার আমি ম্যানেজ করতে পারব।’

একটু অপ্রতিভ হলো অণিমা। ওর তো আর প্ল্যান করে বের হতে হয় না। ওর তো ছেলেমেয়ে নেই। হুট করে তো আর মনীষা ওর সঙ্গে বেরিয়ে পরতে পারে না। ওর ছেলের বয়স পাঁচ।

‘উফফ একটু ধর তো। রায়ান উঠে গেল মনে হয়। ওকে আলাদা ঘরে দিয়েছি। দশ মিনিট পরে ফোন করছি।’ মনীষা ফোন রাখল। ওর ১০ মিনিট আর হবে না শেষ। হয়তো আগামী সপ্তাহে ফোন দেবে আবার।

অণিমা রিসেপশনের দিকে গেল একবার। একটা অল্পবয়সী ছেলে এসেছে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা ওর সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে।
অণিমাকে দেখে হেসে বলল, ‘ম্যাম, দেখুন উনি খুব স্পেসিফিক একধরনের আর্টওয়ার্ক খুঁজছেন।’

‘জি বলুন। আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘এখানে মেটালিক কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টওয়ার্ক হবে। গত বছর ভেগাসে দেখেছিলাম। দাঁড়ান আপনাকে একটা স্যাম্পল দেখাচ্ছি।’

আগন্তুকের ছবি নিয়ে এলেও বেশ আগ্রহ আছে। ফোন বের করে ছবি দেখাল অণিমাকে। খুব উজ্জ্বল রং আর আলোছায়ার খেলা আছে ছবিতে, ভাবল অনিমা। এই শিল্পীর নাম ও আগেও শুনেছে। ক্রিস ডিরুবি খুব সম্ভবত নাম। ফেলে দেওয়া এরোপ্লেনের ধাতব অংশে উনি ছবি আঁকেন। এই স্টাইল নকল করে যদিও আরও অনেকেই এঁকেছেন, তবু অণিমা ক্রিসের ছবি দেখলে চিনতে পারে। চলবে...
*লেখক: ফারহানা সিনথিয়া, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ক্যালগারি, কানাডা