বিহ্বল সময়: পর্ব-৪
অফিস থেকে ফিরতি পথে মনকে বলে রাখি বাসায় ফিরেই লিখতে বসে যাব। কেন লিখতে বসতে পারব না? বাসায় কেউ নেই পথ চেয়ে বা জরুরি কোনো কাজও নেই। সব কাজ গুছিয়ে রেখেছি আগেই। আজ তো শুক্রবার বিকেল, সারা সপ্তাহে মাত্র একটা বিকেল নিজের জন্য বরাদ্দ পাব না?
যে কথা সেই কাজ, লিখতে বসেছি ‘বিহ্বল’ হয়ে পার করা জীবনের কয়েকটা মাত্র সেরা মুহূর্তের কথা, মাত্র কয়েকটা ফেলে আসা এমনই কিছু শুক্রবারের কথাই, ধরুন। পিছে ফেলে আসা এই শেষ শুক্রবার মানে জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে এতক্ষণে আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে নিউইয়র্ক থেকে টরন্টো ফিরছি। হ্যাঁ, ঠিক এই মুহূর্তে বিমান ঠিক কোন জায়গায় ছিল কী করে বলব?
কিন্তু তার আগের শুক্রবারে মানে জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে, ডালাসে ছোট বোন কনার সেই পার্কার রোডের বাসায়, এখন ঘড়িতে পৌনে তিনটা বাজে। আমরা তিন বোন আর মা মিলে, বিশাল বেডরুমের মেঝেতে বিছানা করে আকাশ পাতাল আড্ডা মারছি চূড়ান্ত ঝগড়া করছি, এমনকি বড়পা আর আমি হাতাহাতি অবধি করছি—ভাবা যায় না সেই সব ফেলে আসা মুহূর্ত। প্রতিবার এমন ফ্যামিলি গ্যাদারিংয়ে কয়েকশবার করে বলি—আর জীবনেও তোদের সঙ্গে দেখা করব না, জীবনেও না, কোনো দিন ডাকবি না। বড়পা হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই বলল মরিস না কেন তুই লুনা? এত মানুষ মরে তুই মরিস না কেন? অথচ মন পড়ে থাকে এই সব দিনের কাছে, কবে আবার ফিরে পাব এমন সব দিন?
আমার বাবা-কাকা–খালুরা কুষ্টিয়ায় কাছাকাছি বাসায় থাকতেন। আশপাশের অনেক আত্মীয়েরা নাকি মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, আচ্ছা এরা এই ১১টা মেয়ে নিয়ে কী করবে। এখন জানতে ইচ্ছা করে—যারা এসব বলেছে, তারা কি ১১টা মেয়ের একজনের দায়িত্বও পুরোপুরি নিয়েছিল বা তারা কি মাটির হাঁড়িতে একটা টাকা জমিয়ে বলেছিল ‘এই যে তোমাদের মেয়েদের জন্য দিয়ে রাখলাম?’
এভাবেই ‘বিহ্বল সময়’গুলো বেরিয়ে যায় জীবন থেকে। বোনেদের জীবন থেকে, আমাদের মায়ের জীবন থেকে, এমনকি যে বাবা চলে গেছেন, তাঁর জীবনেও এই সব বিহ্বল মুহূর্ত ছিল। খুব জানতে ইচ্ছা করে আসলেই কি বাবা দেখতে পান আমাদের মরণের ওপারে বসে?
আজকে আরও একটা শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, হ্যাঁ এভাবেই প্ল্যান করা ছিল—আজকে অফিস থেকে ফিরব, লিখতে বসব, তাই করছি, তবু কি লিখতে পারছি সব?
১৩ জানুয়ারি, শুক্রবার পেরিয়ে ১৪ তারিখ শনিবার সকাল ১০টায় আমরা দুই পরিবার মিলে রওনা করেছিলাম ডালাস শহর থেকে ৬ ঘণ্টা দূরে ক্রিস্টাল সৈকতে। সেখানে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল একটা গোটা বাড়ি, আধুনিক ভাষায় এআরবিএনবি। সেখানে কাটবে শনি/রবি দুই দিন, আম্মা নর্থ আমেরিকা ছেড়ে যাওয়ার আগে শেষ উৎসব।
জীবন কত বিচিত্র, তাই না?
চিংড়ি মাছ বারবিকিউ করে খাওয়ার আনন্দ বা মাংস পুড়ে খাওয়ার আনন্দ পাওয়া যাবে বা মেক্সিকো উপসাগরের সঙ্গে লাগোয়া বাড়িতে অবকাশ যাপনের জন্য সময় কাটানো, এই জন্ম কি পেয়েছিলাম আমি? নাকি সেটা তৈরি করতে আব্বাকে দিতে হয়েছিল মাত্র ৮৪ বছর?
আব্বা চলে যাওয়ার পরে আম্মা বেশ কয়েকটা জায়গায় আব্বা কিছু টাকা জমাতেন, সেই খোঁজ পেয়েছিলেন। আব্বা তো নিজের জীবনকে কিছুই দেননি—এ তো নিজের চোখেই দেখা, তাহলে সেই নির্মম কষ্ট করে যে জীবন আব্বা গড়েছিলেন, তার ফসলই তুলছি আমরা মেক্সিকো উপসাগরের উপকূলে বসে?
আমাদের আত্মীয়দের ভেতরেই একজনকে চিনতাম, যাকে নানা ডাকতাম ছোটবেলায়, সেই নানা এমন কৃপণ ছিলেন যে সন্ধ্যায় কিছুটা কম দামে সদাই কিনবেন বলে বসে থাকতেন সারা দিন, ঢাকা থেকে সাভারে চলে আসতেন আম্মার কাছে গেঞ্জি সেলাই করে নেবেন বলে।
সেই নানা মারা যাওয়ার পরে তাঁর তোশক আর বালিশের নিচে পাওয়া গিয়েছিল তিন–চার লাখ টাকা আর আজকে নানার নাতি/নাতনিরা ঢাকা শহরে কয়েকটা দামি ফ্ল্যাটের মালিক অথচ একটা ভালো গেঞ্জি বা একটা ভালো ফল নানা মুখে দেননি বেঁচে থাকতে। আর তাঁর উত্তরাধিকাররা অর্ডার করা ফুড ছাড়া খেতে পারে না, টাকা খরচ করে কাগজের নোটের মতো, কী চাই আমরা আসলে এই জীবনের কাছে? খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলে মনে হয় পাগল হয়ে যাব, তাই না?
ফিরতে হবে আরও ৫৬ বছর আগে।
তখনো এই দেশে শুক্রবার, শনিবার, রোববার সব ছিল। জন্মেছিলাম আর মাত্র তিন দিন পরে—৩১ জানুয়ারি। রংপুরের কনকনে শীতে এক দাইমাকে (মিডওয়াইফ) খবর দেওয়া হয়েছিল সেদিন প্রায় অন্ধকার শীতের রাতে, সময়ের আগেই আম্মার ব্যথা উঠেছিল। রংপুর কারমাইকেল কলেজের জিএল হোস্টেলের কাছে ধূ–ধূ প্রান্তরের মতো জায়গায় হয়তো আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই সাদা বাড়ি—১৯৬৯ সালের ৩১ জানুয়ারি এসেছিলাম এই নশ্বর দুনিয়ায়। সেই রাতেই রওনা করেছিল রাশিয়া থেকে উড়োজাহাজ ‘লুনার’ চাঁদের উদ্দেশে। বাবা তাই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের দ্বিতীয় মেয়েসন্তানের (ছেলে হওয়ার আশায় যে বাবা/মায়ের পরপর চারটে মেয়ে হয়েছিল) নাম দিয়েছিল লুনা।
হ্যাঁ, সেই লুনা বা লুনাদের গল্পের ভেতরে লুকানো আছে কোটি কোটি ‘বিহ্বল মুহূর্ত’। আমি একা না বরং বাংলাদেশের বেশির ভাগ লুনাদের একই গল্প। সেসব মুহূর্ত অনেক ‘নিকষ কালো’ অন্ধকার দিয়ে মোড়ানো। মেক্সিকো উপসাগরের কাছে গিয়ে আমরা এই রকম ৪টা মেয়ে উগড়ে দিয়েছিলাম পেটের ভেতরে জমাট বাঁধা সব ‘নীল অভিমানের’ হাঁড়ি।
মেয়ে হওয়ার পথে পথে কী কী দেখতে হয়েছিল আমাদের, সেই পথে ফিরেছিলাম আমরা কয়েকটা বিহ্বল মুহূর্তের জন্য। সেখানে অভিভাবক একমাত্র আমার মা। যদি ভিডিও করে রাখতে পারতাম সেই দুই–তিন ঘণ্টার আড্ডা, তাহলে পাঠক জানতে পারতেন এই নর্থ আমেরিকাতেও যাঁরা থাকেন, তাঁরাও কোনো কষ্ট/দুঃখের বাইরে বাস করেন না, তাঁরাও সফল হতে গিয়ে বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নেন, কতবার তাঁকে জীবন পিষে দিয়ে গেছে বুলডোজার দিয়ে, আর যতবার তাঁরা সেই নিষ্পেষিত জীবন দেখেন তাঁরা আরও বেশি প্রমিস করে ওপরে ওঠার জন্য।
অনেক অনেক মুহূর্তের কথা হয়তো নিজে মনে করলেও গা শিঊরে ওঠে। তবু সেই সব মুহূর্তও তো এই যাপিত জীবনেরই অংশ, বরং মাত্র কয়েকটা সফলতার মুহূর্তের কথা না বলে সেই সব অন্ধকারময় মুহূর্তের সত্য কথা বলে ফেলাই শ্রেয় মনে হয়।
মেক্সিকো উপসাগরের কিছু ছবি, মাংস পুড়িয়ে খাবার কিছু ছবি বা বিশাল বিশাল ব্র্যান্ডের গাড়ির ছবিও দেওয়া যাবে এই লেখায়; কিন্তু আজকের এসব দিন কি সেই ৫৩ বছর আগেই রচিত হয়েছিল?
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সেই সত্য জানতে ইচ্ছা করে খুব।
আমাদের এক কাকা আছেন, সেই কাকারও চার মেয়ে, আরও এক খালু ছিলেন, তাঁরও তিনটে মেয়ে। স্বাধীনতার পরে পরে আমার বাবা–কাকা আর খালুরা নাকি কুষ্টিয়ায় কাছাকাছি বাসায় থাকতেন আর আশপাশের অনেক আত্মীয় নাকি মাথায় হাত দিয়ে বলতেন—আচ্ছা এঁরা এই ১১টা মেয়ে নিয়ে কী করবেনে, এগের বিয়ে দিবেনে ক্যাম্বা? (মাগুরা অঞ্চলের ভাষা)
আজকে অনেক দিন পরে জানতে ইচ্ছা করে—যারা এসব কথা বলেছে তারা কি এই ১১টা মেয়ের একজনের দায়িত্বও পুরোপুরি নিয়েছিল বা তারা কি একটা মাটির হাঁড়িতে একটা টাকা জমিয়ে বলেছিল—‘এই যে তোমাদের মেয়েদের জন্য দিয়ে রাখলাম?’
কথা বলা সবচেয়ে সহজ, কারণ কথা বলতে তো পয়সা দিতে হয় না।
পরিবারে বা বন্ধুবান্ধব মহলে বা আশপাশের অনেকের কাছে আমার কিছু অন্য নাম আছে—সবচেয়ে বিখ্যাত যে নাম তা হলো লুনা বেয়াদপ, মুখে মুখে কথা বলে, ছেলে/মেয়ের তুলনা করে, লুনাকে সত্য বলার দায়িত্ব কে দিছে? এভাবে কথা বললে জীবনে সংসার করতে পারবে না, এই কারণেই তো ওর সংসার হয় না—।
৫৬ বছরে পা দিয়েছি। নিজেকে বদলে ফেলতে পারব না, মানুষ তো নিজের চিবুকের কাছেই খুব একা তাই না, তাহলে আর ভয় কিসে?
‘বিহ্বল মুহূর্ত’গুলোতে ফিরতে গিয়ে কেবলই বরাবরের মতো চোখের পানি ফেলে চোখ পরিষ্কার করা হলো—এবার কিছু ছবি উপভোগ করা যাক। চলবে...