বিহ্বল সময়–১
দোলাচলের মতো বা বিহ্বল হয়ে ফেরা ঘোরলাগা জীবন থেকে আরও একটা বছর চলে যাচ্ছে, সামনে আরও একটা বছর। এখন কী এমন বয়সে পৌঁছে গেলাম যে কেবল অতীতের দিকে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে? বা খুব নীরব হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা করে? বা খুব একান্ত হয়ে ‘না–বলা কথা’ বলে ফেরার জন্য খুব বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজতে থাকি? বা এমন কী হয়, ‘কেন ফেলে এলাম এমন অসাধারণ দিন’ এমন ভাবনা জড়িয়ে থাকে অনেকটা সময় জুড়ে?
বা এই যে আজকে রাতের মতো রাত, বিদেশবিভূঁইয়ে প্রচণ্ড বরফের তাণ্ডব, বাইরে এক মিনিটের জন্য বের হলে হাত–পা জমে যায়, হাত আগুনে পুড়ে গেলে যেমন জ্বলতে থাকে, তেমনি সঠিক হাতমোজা না থাকলে একইভাবে হাত জ্বলতে শুরু করে ফ্রিজিং বরফে। যেমন জ্বলেছিল আজকে বিকেলে ৫টার দিকে। চোখ দিয়ে নোনাপানি ঝরছে, আমি হাত নিয়ে গাড়ির হিটিং পয়েন্টের কাছে ধরি, তবুও জমে যাওয়া হাত কিছুতেই নরমাল হতে চায় না, যেন নিজের হাত বোবা হয়ে গেছে।
এমন বরফেও তো কাটালাম ১৮ বছর। খুব মনে পরে, বিহ্বল এক সময়ের কথা। সেই ২০০১ থেকে ২০০৪—এই পুরো সময় জুড়েই যেন দোলাচলের শেষ নেই।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
১৮ বছর আগে এমন মানসিক অবস্থায় দেশ ছেড়েছিলাম, মাত্র সাড়ে তিন বছরের সন্তান নিয়ে। একদম অপ্রস্তত অবস্থায় স্তূপাকার বরফের ভেতরে এসে পড়েছিলাম টরন্টো শহরে।
২০০৪ সালের ২০ ডিসেম্বরে তো এমনি এক রাত ছিল, সেই রাতে টরন্টো শহরের বাঙালি–অধ্যুষিত এলাকা স্কারবোরোর ওয়ান মেসি স্কয়ারে ছোট বোন কণা মনজুরের বাসায় উঠেছিলাম।
খুব স্পষ্ট মনে আছে সেই রাত। স্কুল বন্ধু বিন্দু সেই রাতে মুরগির মাংস রান্না করে এনেছিল। বিন্দুর বর শ্যামল আমাদের বন্ধু, ও গিয়েছিল বিমানবন্দরে আমাদের আনতে। কী অসম্ভব বিহ্বল সময় ছিল সেটা, খুব মনে পড়ে। মাত্র চার–পাঁচ দিন পরে বড়দিনের ছুটি শেষে কণা মনজুর একদিন ভোরে কাজে বের হচ্ছে, আমি সেই কনকনে সকালে পাশের ঘর থেকে উঠে এসে কণাকে বললাম, আমি কাজে যেতে চাই। আমি এভাবে বাসায় বসে থাকার জন্য বাংলাদেশ থেকে আসছি নাকি? তুই আমাকে কাজ খুঁজে দে কণা।
কণা অসহায় চোখে চেয়ে বলল, মেজপা, তুই মাত্র এসেছিস, এখনো সাত দিন হয়নি, এত তাড়াতাড়ি কাজ পাবি কীভাবে আর আমিই–বা তোকে কাজ দেব কোথা থেকে?
এই যে লিখছি, দম আটকে টাইপ করে যাচ্ছি। কত দূর ফিরেছি? মাত্র ২১ বছর আগে, তা–ই না?
কিন্তু আজও মনে হয়, এই সেদিন, মাত্র সেদিন আমি ঢাকা থেকে খুব ভোরে প্লেন ধরার জন্য রাত সাড়ে তিনটায় বিমানবন্দরের দিকে রওনা করেছিলাম। নাইয়া কাদা হয়ে ঘুমিয়ে ছিল আম্মার বুকের ওপর। আব্বা মধ্যরাতে নয়তলা থেকে লিফটের কাছে নেমে এসে আমার মাথায় হাত দিয়েছিলেন, আহা! আমার সেই মা! বুঝি, সারা দিন আম্মা চোখের দুই পাতা এক করতে পারেনি, কণার বাসায় রাত শেষ হয়নি তখনো। খুব ভোরে আম্মা ফোন করে নাইয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে গেল, কিন্তু এপাশের ছবি তখন একদম অন্য।
মাত্র এক রাতের ব্যবধানে নাইয়া বদলে গেছে, কণার ছেলে কিশানকে খেলার সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেছে নাইয়া, আর আম্মার ফোন ধরতে চায় না কিছুতেই। কারণ ও খেলা নিয়ে মত্ত। আর আমি হাপুস হয়ে কাদছি, দেশে ফিরে যাব, একমুহূর্ত থাকব না টরন্টোতে। কী ভীষণ দোলাচল এই জীবনজুড়ে, বিহ্বল প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা ঘণ্টা কাটে দেশে কথা বলে। ওই যে সেই প্রথম কয়েকটা দিন, তখন কার্ড ফোন কিনে ঢাকায় কথা বলতে হতো, তখন মনেপ্রাণে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি কোনো দিন কানাডায় ডলার উপার্জন করতে পারি, তাহলে ফোন কার্ড কিনে দেশে কথা বলব, যেন–বা দেশে কথা বলা ছাড়া এই জীবনের কাছে আর কিছুই চাওয়ার নেই।
মাত্র কয়েকটা বিহ্বল অনুভূতি দিয়ে ছেয়ে থাকা এই জীবন। কতটা পথ পাড় হলে মানুষ থিতু হয় নিজের কাছে?
এখন বাইরে ঘন অন্ধকারের বরফের রাত। মাইনাস ২৪ ডিগ্রি শীত এই রাতে। আগামীকাল রাত সাড়ে ১১টায় কাজ থেকে ফিরব। তাই আজকে রাত জেগে থাকতে ইচ্ছা হলো।
এমন কোনো কোনো রাতে হঠাৎ বাবার চেহারাটা সামনে চলে আসে। একদম চোখের সামনে। আব্বা বেরিয়েছিলেন বাসা থেকে অপ্রস্তুত হয়ে, সামান্য একটা রক্ত পরীক্ষা (ব্লাড টেস্ট) করাবেন বলে, বাবা আর বাসায় ফেরেননি। জীবন এক অনিশ্চিত যাত্রা, যা আমরা কেউ মানতে চাই না।
আমিও বাংলাদেশ থেকে কানাডায়, প্রস্তুতিবিহীন বেরিয়েছিলাম।
প্রিয় মানুষদের বলেছিলাম, মাত তিন বছরেই দেশে ফিরব, কবিতার বই, প্রিয় গল্প–উপন্যাস সব সাজানো ছিল ধানমন্ডির বাসায়। কিন্তু বিহ্বল হয়ে ২১ বছর কাটালাম। এই ‘বিহ্বল সময়’ কোথায় নেয় জীবনকে? চলবে...