বিহ্বল সময়: পর্ব–৩
আমাদের চার বোনের কিশোরবেলার অনেক স্মৃতি, কথা, ঘটনা, আনন্দ–বেদনা বা অনেক অনেক মানুষের সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গ সময় বা আমাদের চার বোনের এই ‘ব্রিগেড’কে আম্মা কী করে সামলে এত দূর অবধি আনলেন, সেসব কথা শেয়ার করতে খুব ইচ্ছা করে।
‘ক্রাচের কর্নেল’ নামের যে আলোচিত এবং চমকপ্রদ বই গল্পকার শাহাদুজ্জামান লিখেছেন, সে বইটা পড়তে পড়তে অনেকবার নিজের মায়ের কথা মনে পড়েছে। ফিরে গেছি নিজের ফেলে আসা সময়ের কাছে। লেখক মুন্না ভাই (শাহাদুজ্জামানের আরেক নাম) যখন খুব ছোট ছোট পারিবারিক ঘটনা দিয়ে কর্নেল তাহেরকে আঁকেন—যেমন তাহের কলেজে পড়ার সময় নিজের মা তাহেরুন্নেসার জন্য ‘আউট বই’ আনতেন বা তাহেরের মা (তাহেরুন্নেসা) সন্ধ্যা হলে সার ধরে নিজের ছেলেমেয়েদের পড়তে নির্দেশ দিতেন বা তাহেরদের ৯ ভাইবোনের বিশাল গ্রুপ যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাসা বদল করে গেলে সবাই নিজের হাতে সব কাজ করতেন বা তাঁদের মা তাহেরুন্নেসা যখন বলতেন ঘরের সব কাজ করা সব ছেলেমেয়েকে বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হবে, তখনো নিজের মায়ের কথা মনে পড়ত।
‘ক্রাচের কর্নেল’ বই পড়তে পড়তে নিজের ফেলে আসা জীবনে ঢুকে যেতাম তাহেরদের জীবনের ভেতর দিয়ে। সে কারণেই ব্যক্তিগতভাবে আমি মুন্না ভাইয়ের লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত।
যে চার মেয়ে নিয়ে কলেজশিক্ষক বাবার সামান্য বেতনে আম্মা আজীবন লড়েছেন, আজকে সেই মায়ের এক মেয়ের এক মাসের বেতনই তো বাবার সারা জীবনের বেতন ছিল—তাহলে আম্মাই বা নতুন করে ভাবতে বসবেন না কেন?
কিন্তু ‘ক্রাচের কর্নেল’-এর তাহের এবং মহীয়সী মাতা তাহেরুন্নেসা বেঁচে থাকতেই যে তাঁর ছেলে তাহেরের বীরোচিত ইতিহাস জেনে যেতে পেরেছেন বা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাহের যে বীরগাথা রচনা করেছেন এবং একটা দেশের ইতিহাসের সঙ্গে তাহের ও তাঁর মা যেভাবে রয়ে গেছেন, সেখানে আমি লুনা সামান্য কলেজশিক্ষকের মেয়ে, জীবনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে না পেরে পলায়নপর প্রবাসজীবন বেছে নিয়েছি। যে মানুষের জীবনের ৯০ শতাংশ সময় কাটে কী করে চাকরিতে মুখ গুঁজে থেকে দিন গুজরান করা যায় সেই চিন্তায়—সেই অতিসামান্য মানুষের সঙ্গে বীরের জীবনের তুলনা কিসের?
তবু আমাদের সবার জীবনই আমাদের সবার কাছে সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে একক এবং সবচেয়ে সেরা জীবন। অবশ্যই এই একটামাত্র জীবনকে শত শত অনুভূতির মালা দিয়ে না সাজালে বেঁচে থাকার প্রেরণা পাব কোথা থেকে? না হোক সেটা বীরের জীবন, কিন্তু একটা অসাধারণ জীবন তো বটেই।
আমরা চার বোন পিঠাপিঠি বয়সের। এক বা দেড় বছরের ফারাক আমাদের চার বোনের ভেতরে। আম্মা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছেন, দিয়েছেন বা বলেছেন; যার মর্ম যত দিন যাচ্ছে ততই যেন বুঝতে পারছি। সব মানুষের জন্যই এটা সত্য। কিন্তু সেটা সে সময় বুঝতে পারিনি, যখন আম্মা বারবার বলতেন। তখন মনে হতো, আম্মা এসব বলেন কেন? আম্মা পড়তে বলেন কেন? যেমন শাহিন আর আমি গল্প করছি আরও কয়েকজন সমবয়সী মেয়ের সঙ্গে, হুট করে কথা উঠল ছেলেমেয়ে নিয়ে—সমাজে ছেলেমেয়েদের মা–বাবারা কী করে বড় করেন। একটা মেয়েকে বড় করতে গিয়ে মায়েরা কী কী বলেন। একটা ছেলেকে বড় করতে গিয়ে মায়েরা কী কী বলেন।
আম্মা আমাদের সেই ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের সঙ্গে সহজ করে মিশতে দিয়ে, ছেলেদের ব্যাপারে মেয়েদের ভেতরে যে আলাদা একটা ‘প্রগলভতা’ থাকে সেটা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এটা যে আমাদের চার বোনের জীবনের মোড় কী ভীষণভাবে বদলে দিয়েছিল সেটা যেন দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। কী করে ৫০ বছর আগে আম্মা এতটা উদার চিন্তার মানুষ ছিলেন, সেটা আজও বিস্মিত করে।
দুপুরে বাসা পরিষ্কার করছিলাম। ঘর ঝাড়ু দেওয়া, মোছা, বাথরুম ধোয়া, ঘরের সেটিংস বদলে ঘর থেকে আরও ময়লা বের করে ঝাড়াপোছা করা, সব ব্যবহার করা পাপোশ বদলে আবার নতুন সেট বিছানো, এমনকি ময়লা ফেলার যে বিন সেটাও আগাপাছতলা ধুয়ে আবার পলি বিছিয়ে ব্যবহার করা, এসব আমরা দেখে দেখে শিখেছি।
মানে জীবনের ৩৬ বছর (বিদেশে আসার আগপর্যন্ত) ধরে আম্মাকে দেখেছি সপ্তাহে রুটিন করে এ কাজগুলো করতে। স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পুরোটা সময়ে, আমাদের বাসায় বেসিক তিনটি কাজ—ঘর ঝাড়ামোছা, বাথরুম ধোয়া ও কাপড় ধোয়া—এসব হবে না কিন্তু আমরা ভাত খেতে বসব, এটা ভাবলেও আমাদের ভয় করত।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
লক্ষ করুন, এই কাজগুলোর ভেতরে কিন্তু রান্না করা নেই। আম্মা আমাদের কোনো দিন ডেকে বলতেন না রান্না শেখো, সংসার করতে গেলে রান্না শিখতে হবে, কোনো দিন না। আমার তো মনে পড়ে না। কিন্তু আম্মা বারবার বলতেন, অর্গানাইজ হয়ে কাজ করা শেখো, সব কাজ শেষ করে কীভাবে পড়তে বসতে হবে সেটা শেখো, ঘরের কাজ সেরে কী করে অফিসে যেতে হবে সেটা শেখো। রান্না কোনো জাদু না, এমনি রান্না পারা যায়।
আরও একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল আম্মার। বোনদের ভেতরে যে পড়াশোনায় বেশি ভালো, তার কাজের লোড অটো কমে আসবে। এসব বিচারে আমার শাস্তি আজন্ম বেশি। একে পড়াশোনায় খারাপ, আবার মুখে মুখে কথা বলছি, নানা ধরনের শয়তানি কাজে আমার শতভাগ যোগাযোগ। তাহলে কোন দিক থেকে শাস্তি মাফ হবে?
দুপুরে ঘর ঝাড়ু দেওয়ার পরে পায়ের নিচে কোথায় যেন একটু বালু বালু ঠেকল, মনে পড়ল আম্মাকে। আমাদের মা ঘর ঝাড়ু দিয়ে পুরোনো কাপড় দিয়ে ঘর মুছে আবার সারা ঘরে হেঁটে পরীক্ষা করে দেখতেন যে খালি পায়ে হাঁটলে পায়ে ময়লা বাধে কি না। আজ এই ৫৫–এর পরে যখন নিজের ঘর এভাবে পরিষ্কার করি, নিজের ঘরে একা একা হাঁটি আর চারপাশে তাকাই, কোথাও কোনো কাজ বাকি থাকল কি না, তখন ফেলে আসা দিনের কথা ভীষণ মনে পড়ে।
কিন্তু সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। অনেক অনেক বদলে যায় সেই মানুষই, যাকে অন্য রকম দেখা গিয়েছিল যখন শরীরে শক্তি ছিল।
২০২২ সালে আম্মা আমার বাসায় থাকলেন তিন সপ্তাহ। ঘরের কাজ নিয়ে এমন পাগলপারা থাকি, আম্মা সেটা খুব পছন্দ করলেন না। বারবার কঠিন করে বললেন, ‘আমার উপায় ছিল না তাই আমি সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, কিন্তু তুমি কেন এসব কাজে এত সময় দাও? এর চেয়ে আরও পড়াশোনা করে আরও বড় চাকরি করলে তো টাকা দিয়েই এসব ঘরের কাজ করানো যায়। খামোখা এসব কাজে সব শক্তি শেষ করা।’
জীবনের শেষ দিকে এসে আম্মা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মেয়েদের জীবন দেখে হয়তো ভাবেন, কত কত সুযোগ একটা মেয়ের সামনে। একমাত্র সঠিক দক্ষতা অর্জন করলে জীবন তো স্বর্গের কাছাকাছি।
যে চার মেয়ে নিয়ে কলেজশিক্ষক বাবার সামান্য বেতনের সঙ্গে আম্মা আজীবন লড়েছেন, আজকে সেই মায়ের এক মেয়ের এক মাসের বেতনই তো আমার বাবার প্রায় সারা জীবনের বেতন ছিল—তাহলে আম্মাই বা নতুন করে ভাবতে বসবেন না কেন?বিহ্বল হয়ে আম্মা হয়তো নতুন দুনিয়া আরও একবার দেখে নেন।
হয়তো জীবনসায়াহ্নে এসে আম্মা নিজের দিকেও ফিরে তাকান। সমাজের দিকে আরও একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখেন দুনিয়া কত বদলে গেছে, মানুষের দক্ষতা মানুষকে কত বিশাল ব্যাপক জীবন দিয়েছে। সেখানে আমি যদি বারবার ঝাড়ু হাতে তুলে নিই, আম্মা সেটা পছন্দই বা করবেন কেন?
কিন্তু ওই যে কথা, ‘তোমার যাতে আনন্দ তুমি যেন তাই পাও।’
নিজের হাতে পরিষ্কার করা ঝকঝকে ঘরে থাকতে ভালো লাগে। অফিস থেকে ফিরে পরিপাটি একটা সংসার আমাকে চুম্বকের মতো ঘরের দিকে টানতে থাকে। যা নিজের মাকে দেখেছি আজন্ম।
সেসব ‘বিহ্বল সময়’ থেকে যে কিছুতেই বের হতে পারি না, কী করব এসব অনুভূতি নিয়ে?
চলবে...
*লেখক: লুনা শিরীন, টরন্টো, কানাডা