বিহ্বল সময়–২

লেখক ও পালোয়াশাছবি: লেখকের পাঠানো

১৭ বছরের টরন্টোর জীবনে ১৫ বছর ধরে একই অফিসে কাজ করছি। এর মধ্যে মাত্র আট বছর ধরে ফুল টাইম চাকরির পাশাপাশি নানান ধরনের খণ্ডকালীন কাজ করছি। কিন্তু একটা ফুল টাইম চাকরির পাশাপাশি এই শহরের ৬০ ভাগের ওপরে মানুষ যে দ্বিতীয় চাকরি করে, সেটা জানতে পারলাম ২০১৩ সাল নাগাদ। যে বছর নতুন গাড়ি কিনে এবং গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে নবজন্ম হলো এই শহরেই দ্বিতীয়বারের মতো।

যেকোনো বড় বিপদ বা বাধা মানুষকে আমূল বদলে দেয়, সেই সত্য কি আমরা সবাই উপলব্ধি করেই জীবন থেকে বিদায় নিই? কারণ, অনেকেই জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে চাই না বলেই অনেকের জীবন ঘাটে ‘বাধা নৌকা’র মতো এক জায়গায় ঘুরপাক খেতে থাকে, বা হয়তো সামনে নানান চ্যালেঞ্জ আসবে, এই ভয়ে বর্তমানের সব একঘেয়ে দুঃখ–কষ্টের সঙ্গে লড়তে থাকি কিন্তু তবুও নিজেকে বলতে পারি না, দেখি না, গা ঝাড়া দিয়ে একবার উঠে দাঁড়াই, দেখি না একা চেষ্টা করে, বাচতে পারি কি না?

নিত্য বয়ে যাওয়া বিহ্বল সময়ের কথা লিখতে ইচ্ছা করে ভীষণ। গল্পের মতো করে বলে যেতে ইচ্ছা করে যাপিত জীবনের সব অনুভূতি। কিন্তু লেখা অর্ধেক না আগাতেই দেখি, কিছুই বলা হয়নি কিন্তু লেখা শেষ করা দরকার, লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে এই অনুভূতি জাপটে ধরে।

রাত জেগে ৩১ ডিসেম্বরের আনন্দ কোনো দিনই করিনি, না দেশে না বিদেশে। কিন্তু ক্যামেরুন থেকে আসা ৩২ বছরের রোজ টলতে টলতে অফিসে আসে সাড়ে আটটায়। আমি বলি, তুমি আজকে কাজ নিয়েছ কেন? রোজ হেসে বলে, পাগল নাকি তুমি? জানো না, আজকে প্রায় ডাবল পে করবে? বিহ্বল হয়ে নিজের ভেতরে রোজকে দেখতে পাই।

২০১৩ সালে গাড়ির বাড়তি ইনস্যুরেন্স টানার জন্য খণ্ডকালীন কাজ খোঁজার দরকার হয়ে পড়েছিল ভীষণভাবে। নানান ধরনের অড জব বা মিনিমাম পের জব করার এক বছরের মাথায় একজন বলল, লুনা, আপনি কানাডিয়ান সিকিউরিটি লাইসেন্স করে ফেলেন, আরামের চাকরি। ছুটির দিনে চেয়ার–টেবিলে বসেই কাজ করতে পারবেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ অব্ধি মোট দুইটা সিকিউরিটি কোম্পানির সঙ্গে ‘উইকেন্ড কনসিয়ারজ’ হিসেবে কাজ করেছি।

সেই সময় আবার নতুন করে ‘ওয়ান অ্যান্ড হাফ পে’ নামক বিষয়ের সঙ্গে নতুন মিতালি। ডিসেম্বর মাস, অর্থাৎ ডিসেম্বরের ২৫ থেকে জানুয়ারির ২ অব্ধি প্রায় ৫–৬ দিন যদি কেউ মিনিমাম পেমেন্টে কাজ করে, তবুও এই কয়টা বিশেষ ছুটির দিনে সেই কর্মী ঘণ্টায় পেমেন্টের সঙ্গে আরও এক ঘণ্টার অর্ধেক ডলার পাবে। এই টরন্টো শহরের কত পারসেন্ট মানুষ এই দিনগুলোতে কাজ পাওয়ার জন্য বসে থাকে, সেটা কি জানি আমরা?

২০২২ সালে সবচেয়ে বড় অর্জন কষ্টির ফুল টাইম কাজের পাশাপাশি আরও একটা শেল্টারে উইকেন্ড কাউন্সেলর হিসেবে কাজ শুরু করেছি ২০২২–এর এপ্রিল থেকে, ডিসেম্বর মাসের ২৪ থেকে জানুয়ারি ২ অব্ধি সরকারি ছুটি আর আমার কাজ আছে প্রায় প্রতিদিন।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

গ্রিন হাউস শেল্টারে সকাল পৌনে আটটায় পৌঁছে যাই। কারণ, রাত জেগে ৩১ ডিসেম্বরের আনন্দ কোনো দিনই করিনি, না দেশে না বিদেশে। কিন্তু ক্যামেরুন থেকে আসা ৩২ বছরের মেয়ে রোজ টলতে টলতে অফিসে আসে সাড়ে আটটায়। বলে মাহমুদা, ভোর সাড়ে ছয়টা অব্ধি পার্টি করেছি, আগামী দুই ঘণ্টা টেবিলে বসে না ঘুমালে মারা যাব। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বলি, তুমি আজকে কাজ নিয়েছ কেন? রোজ হেসে বলে, পাগল নাকি তুমি? জানো না, আজকে প্রায় ডাবল পে করবে? বিহ্বল হয়ে নিজের ভেতরে রোজকে দেখতে পাই।

লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো

আরও একটা বছর শেষ হয়ে গেল। ৩০–এর আগপর্যন্ত নতুন বছর পেরিয়ে আরও একটা বছর এলে তেমন বিহ্বল লাগত না। কিন্তু ৫০–এর পরে কি বেশি বিহ্বল লাগে? এখন কি মনে হয়, জীবন থেকে যে বছর চলে গেল, তা আসলেই বিয়োগ হয়ে গেল। কিন্তু ২৫–এ তো এমন হাহাকার করত না মন? বিহ্বল চোখ বোবা দৃষ্টি নিয়ে লম্বা পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এ বছরে কষ্টিতে হারাব, অ্যান্ডেস মোভালেস আমাদের হাউজিং কাউন্সিলর, ৪০–এর কোটায় বয়স হবে, মূল বাড়ি ভেনেজুয়েলা। ওকে ছোট করে অ্যান ডাকি আমরা। পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলে অ্যান। অফিসে কারও সঙ্গেই অ্যান ঘনিষ্ঠ নয়। কিন্তু অ্যান কথা বলে আমার সঙ্গে, অনেক অনেক কথা বলে দেশ, রাজনীতি, সমাজ, মানুষ, পড়াশোনা নিয়ে। গুগুল ঘেঁটে ঘেঁটে বাংলাদেশের নানান ইস্যু বের করে অ্যান।

এই ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে অ্যান বলে, মাহমুদা তুমি জানো না, আমি কষ্টির চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি? আমি চার বছরের জন্য স্পেনে চলে যাব। আমার ফ্যামিলি ও আমি কয়েকটা দেশে ঘুরব, আলতামিরা গুহা দেখব। অ্যান ওর জমজ ফুটফুটে দুই মেয়ের ছবি দেখায়।

আমি হা করে বলি, কী বলো? এই চাকরি ছেড়ে দেবে তুমি?

অ্যান হেসে বলে, তোমার সঠিক স্কিল থাকলে জব তুমি পাবেই, কিন্তু দেশ ঘোরার মতো বয়স কি তোমার সব সময় থাকবে? আমি হচ্ছি সেই তেলাপোকা, যে হারানোর ভয়ে সব আকড়ে থাকি, আমি অ্যানের লজিক বুঝতে যাব কেন? বিহ্বল হয়ে অ্যানের সঙ্গে ছবি তুলি। কিন্তু অ্যান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ওর ছবি দেওয়া যাবে না, কিছুতেই না। কিন্তু তবুও অ্যানকে ধরে রাখার জন্য একটা ছবি দেব এই লেখার শেষে।

২০২২ সালে শেল্টারে এসেছিল আফগানি পরিবার পালওয়াশা। ৩৪ বছরে পালোয়াশা জন্ম দিয়েছে ৫টা সন্তান। এক বর্ণ ইংরেজি জানে না, কিন্তু পালওয়াশা আমাকে ভালোবাসে জান দিয়ে, মাত্র চার মাসের মাথায় ওর ১১ বছরের মেয়ে মারিয়াম পটপট ইংলিশ বলে। ২৩ ডিসেম্বর পালওয়াশা ছবি তুলবেই। সেই ছবিও বিহ্বল সময়ের ডাইরিতে তোলা থাকুক।

আরও পড়ুন

২০২২ সালে গিয়েছিলাম মেক্সিকোতে। নানান জায়গায় ঘুরে ফ্রিদা কাহলোর মিউজিয়ামে গিয়ে মনে হয়েছিলো, মানুষই পারে সব জয় করতে। ২০টার ওপরে অস্ত্রোপচার হয়েছে ফ্রিদার শরীরে, তবুও ফ্রিদা থামেননি—এই তো গতি, এই তো মানুষ।

২০২২–এ ভ্যাঙ্কুভারে গিয়েছিলাম নাইয়াকে নিয়ে টাফিনো নামের একটা পয়েন্টে। এরপর আর কোনো দেশ নেই, সীমানা নেই—সেটাও ছুঁয়ে এসেছি।

নাইয়া ২০২২–এ দুই বছরের এম এ কোর্সে ভর্তি হয়েছিল, শেষ হয় ২০২৪–এ।

আর ২০২২ শুরু হয় আমার আরও এক জীবন। আরও দুই সন্তানকে পৃথিবীর জন্য যোগ্য করে তোলার কাজ হাতে নিয়েছি। সেই অপেক্ষায় শুরু হয় ২০২৩। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুরা বলেছিল,‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হচ্ছে সে, যার অপেক্ষা আছে।’ বিহ্বল হয়ে কাজ থেকে ফিরতি পথে লম্বা টিটিসি বাসে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে মনের অজান্তেই, ভাবতে থাকি, তাহলে আমিই কি সেরা সেরা সুখী মানুষদের একজন?—চলবে...