বিবাহবিচ্ছেদ মানে শুধু সম্পর্কের ভাঙন নয়, সন্তানের জীবনের চিরস্থায়ী ক্ষত

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আমাদের সমাজে মা–বাবার বিবাহবিচ্ছেদকে সাধারণত শুধু একটি সম্পর্কের ভাঙন হিসেবে দেখা হয়। অথচ এর সবচেয়ে গভীর আঘাতটা লাগে সেই সব শিশুদের জীবনে, যাদের বেড়ে ওঠা হয় এই ভাঙনের মধ্যে দিয়ে। মা–বাবা আলাদা হয়ে গেলে তাঁদের সন্তানদের ভেতরে তৈরি হয় এক অদৃশ্য ক্ষত, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায় না, বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে আরও তীব্র হয়। সমাজের মানুষ এ বিষয়ে খুব সহজভাবে বলে দেয়, ‘ও তো ভাঙা সংসারের সন্তান।’ এই একটি বাক্যই তাদের মনে তৈরি করে অপরাধবোধ, লজ্জা আর অসহায়তা। অথচ তারা কোনো দোষ করেনি।

একটি সন্তানের জন্য জীবনের সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত হলো সেই উপলব্ধি—এই পৃথিবীতে যত দিনই সে বেঁচে থাকুক না কেন, তার মা–বাবা আর কখনো এক হবে না। একসঙ্গে বসে গল্প করা, ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, নানুবাড়িতে মা–বাবা দুজনকে নিয়ে আনন্দ করা—সবই স্মৃতিতে পরিণত হয়। এই উপলব্ধিই শিশুটিকে সারাজীবনের জন্য একাকিত্বের ভারে ডুবিয়ে রাখে। অন্য কারও কাছে এটি হয়তো সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু একজন একা বড় হওয়া শিশু জানে—এই শূন্যতা কতটা গভীর কষ্টের।

ছোটবেলায় যখন স্কুলে বন্ধুরা বলে, ‘আমার মা–বাবা আমাকে নিয়ে ঘুরতে গেছে’ বা ‘আমার মা–বাবা আমাকে নিয়ে শপিং করেছে’, তখন বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তান শুধু নিঃশব্দে হাসে, কিন্তু ভেতরে কান্না চেপে রাখে। তাদের মনে হয়, কেন আমি এই আনন্দগুলো থেকে বঞ্চিত? কেন আমারও স্বাভাবিক পরিবার নেই? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

সময় যত এগোয়, সেই ট্রমা আরও কঠিন হয়। কৈশোরে কিংবা যৌবনে এসে তারা প্রায়ই সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদের প্রতি বিশ্বাস করতে ভয় পায়। মনে হয়, যাকে ভালোবাসব, সেও হয়তো একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। মা–বাবার ভাঙন যেন তাদের মনে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি করে দেয়। তারা সম্পর্কের গভীরে যেতে চাইলেও ভিতরে ভয় কাজ করে—‘যদি আবার ভেঙে যায়?’

আরও পড়ুন

সমাজ এই আঘাতকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেকে তির্যকভাবে বলে বসে, ‘ডিভোর্সের ছেলে–মেয়েরা নাকি সংসার সামলাতে জানে না।’ অথচ এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। সন্তানরা বিচ্ছেদের জন্য দায়ী নয়, বরং তারা সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। তবু সমাজ তাদের দিকে সহানুভূতির চোখে তাকানোর বদলে অবজ্ঞার চোখে দেখে।

যাদের মা–বাবা একসঙ্গে আছে, তারা আসলেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসা, রাতে গল্প করে ঘুমানো, ঈদ বা পূজায় পরিবারের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া—এসবই আসলে জীবনের আসল সুখ। যাদের পরিবার ভাঙা, তারা জানে এই স্বাভাবিক মুহূর্তগুলো আসলে কত বড় সম্পদ। একজন মানুষ যত বড় সফলই হোক না কেন, যত টাকাপয়সার মালিকই হোক, শৈশবের এই শূন্যতা সারা জীবন তার ভেতরে হাহাকার হয়ে বাজতে থাকে।

আরও পড়ুন

মা ছাড়া পৃথিবীতে বড় হওয়াটা সবচেয়ে কষ্টের। মা-ই সন্তানকে নিরাপত্তা দেয়, মমতা দেয়, নিঃশর্ত ভালোবাসা দেয়। কিন্তু বিচ্ছেদের কারণে অনেক শিশু সেই ভালোবাসার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়। আবার বাবা থেকেও বঞ্চিত হয় কেউ কেউ। এই বঞ্চনা তাদের ভেতরে তৈরি করে অদৃশ্য শূন্যতা, যা কোনো সাফল্য, কোনো অর্জন, কোনো সম্পদ দিয়েই পূরণ করা যায় না।

আমাদের সমাজে এখনো বিচ্ছেদকে কলঙ্কের চোখে দেখা হয়। ফলে সন্তানেরা শুধু পরিবার ভাঙনের কষ্টই পায় না, এর সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক চাপ ও তিরস্কার। মানুষ যখন বলে, ‘ও ভাঙা সংসারের মেয়ে’ বা ‘ওর চরিত্র কেমন হবে কে জানে’, তখন সেটাই হয়ে ওঠে আরেক ধরনের মানসিক নির্যাতন। অথচ এগুলো তাদের হাতে ছিল না, তাদের দোষও ছিল না।

তাদের পাশে দাঁড়ানো, বোঝা, ভালোবাসা দেওয়াটাই আমাদের দায়িত্ব। মা–বাবার সম্পর্ক ভাঙতে পারে, কিন্তু সন্তানের প্রতি দায়িত্ব কোনো দিন ভাঙে না। সমাজকেও শেখাতে হবে—ডিভোর্স মানেই সন্তানরা ‘অসম্পূর্ণ’ নয়। বরং তাদের আরও বেশি ভালোবাসা, গ্রহণযোগ্যতা, এবং সমর্থন দরকার।

একজন একা বড় হওয়া শিশুর ভেতরে হয়তো সারা জীবন একটি হাহাকার বেঁচে থাকবে। কিন্তু যদি আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই, তবে সেই হাহাকারকে অন্তত কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। তাদের জীবনেও আলো ফিরতে পারে, যদি আমরা সমাজ হিসেবে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হই।

লেখা: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়